লয় ক্রাথং

প্যারামাট্টা নদীতে ভাসছে প্রদীপ
প্যারামাট্টা নদীতে ভাসছে প্রদীপ

কয়েক দিন আগে সিডনির প্যারামাট্টা নদীর পাশে হয়ে গেল থাইল্যান্ডের সবচেয়ে বড় উৎসব ‘লয় ক্রাথং’। এটাকে পানির উৎসবও বলা হয়। রয়েল ইনস্টিটিউট ডিকশনারির (১৯৯৯) মতে ‘লয়’ মানে ভাসানো আর ‘ক্রাথং’ শব্দের অর্থ পদ্ম আকৃতির ঝুড়ি। অর্থাৎ পানিতে পদ্মফুলের ঝুড়ি ভাসানো। ঐতিহ্যবাহী থাই ক্রাথং বানানো হতো কলাগাছের পাতা অথবা স্পাইডার লিলি ফুল দিয়ে। কিন্তু বর্তমানে প্লাস্টিক বা ফোম দিয়ে পদ্ম আকৃতির ফুলের ঝুড়ি বানানো হয়। তাতে প্রদীপ বা মোমবাতি আর সঙ্গে কিছু কাঁচা ফুল দিয়ে সাজানো হয়। কেউ কেউ আবার কয়েন ও আগরবাতিও যোগ করেন। পূর্ণিমার রাতে নদী, পুকুর বা জলাশয়ে এই প্রদীপ ভাসানো হয়। পাশাপাশি বিশ্বাস করা হয় এর সঙ্গে পুরোনো বছরের সব দুঃখ চলে যাবে এবং নতুন বছর নিয়ে আসবে অনাবিল আনন্দ। থাই লুনার ক্যালেন্ডার মতে, ১২তম মাসের পূর্ণিমাতে এই উৎসব হয়। সেই হিসাবে পশ্চিমা ক্যালেন্ডার মতে, নভেম্বর মাসে এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।

ফুলের ঝুড়ি হাতে দুই থাই তরুণী
ফুলের ঝুড়ি হাতে দুই থাই তরুণী


সিডনিতে প্রতিবছরের নভেম্বর মাসে এই থাই ফেস্টিভ্যাল লয় ক্রাথং হয়ে থাকে। অনুষ্ঠানটি সিডনিতে বসবাসরত থাই অধিবাসীরা আয়োজন করেন। একে সিডনির সবচেয়ে বড় ওয়াটার ফেস্টিভ্যালও বলা হয়। এ বছরও গত ২২ নভেম্বর লয় ক্রাথং উপলক্ষে প্যারামাট্টা নদীর পাড়ে মেলা বসেছিল। বিকেলবেলা গিয়ে দেখা গেল নদীর দুই ধারে বিভিন্ন সামগ্রীর পসরা সাজিয়ে বসেছেন থাই তরুণ-তরুণীরা। নদীর একদিকে সমতল ও অন্যদিকে পাহাড়ঘেরা। ওপরে যাওয়ার জন্য আছে লম্বা সিঁড়ি। এর পাশে ছিল বাচ্চাদের খেলার জন্য নানা গেম শো। মেলায় বসেছিল থাইল্যান্ডের ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন খাবারের দোকান। চারদিকে খাবারে গন্ধে ম ম করছিল। প্রতিটা খাবারের দোকানে ছিল লম্বা লাইন। সবাই সারিবদ্ধ হয়ে খাবার কিনছেন। এ ছাড়া হেনা পেন্টিং, বিভিন্ন থাই আর্ট প্রদর্শনী, থাই কাপড়ের দোকান, বাচ্চাদের খেলনা, শোপিস, তৈজসপত্র ইত্যাদির দোকান বসেছিল মেলায়। থাই পোশাক পরে ছবি তোলার ব্যবস্থা ছিল। আরও ছিল বাচ্চাদের জন্য পাপেট শো। ছিল লটারির আয়োজন, টিকিট জিতলে ছিল সিডনি-থাইল্যান্ড ট্যুর।
বিকেল থেকে শুরু হয় মেলা আর সঙ্গে স্টেজ শো। সেখানে প্যারামাট্টা শহরের মেয়রসহ থাই রাষ্ট্রদূত বক্তব্য দেন। এরপর থাই তরুণীরা তাঁদের ঐতিহ্যবাহী নৃত্য প্রদর্শন করেন। পরে চলে গানের আয়োজন। মেলায় আসা মানুষের আনন্দের জন্য চলে বক্সিং খেলা। সূর্যাস্তের পরে শুরু হয় মূল অনুষ্ঠান প্রদীপ ভাসানো বা লয় ক্রাথং।
প্রথমে প্যারামাট্টা সিটির মেয়র উদ্বোধন করেন পানিতে প্রদীপ ভাসিয়ে মূল অনুষ্ঠানের। এরপর ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে থাই তরুণীরা তাঁদের প্রদীপ ভাসানো শুরু করেন পানিতে। একের পর এক এসে প্রদীপ বা ক্রাথং ভাসাতে থাকেন এবং সেই সঙ্গে ছিল ঢাক-জাতীয় বাদ্যের শব্দ। এই প্রদীপ ভাসানোর অর্থ হলো পুরোনো সব দুঃখ-বেদনা প্রদীপের সঙ্গে চলে যাবে এবং আসছে বছর নিয়ে আসবে অনাবিল সুখ ও শান্তি। সবার হাতে শোভা পায় পদ্ম আকৃতির ফুলের বাটি, তার মাঝখানে একটি মোমবাতি। আবার কেউ কেউ তার মধ্যে কয়েন রেখে আগরবাতি জ্বালিয়ে দেন। থাই অধিবাসীদের পাশাপাশি ভারতীয়, বাংলাদেশি ও অনেক শ্রীলঙ্কানও প্রদীপ ভাসান।

লয় ক্রাথং উৎসবের দিন প্যারামাট্টা নদীর পাশে সমবেতরা
লয় ক্রাথং উৎসবের দিন প্যারামাট্টা নদীর পাশে সমবেতরা

উৎসব চলাকালে কথা হলো এক থাই তরুণীর সঙ্গে। তাঁর কাছ থেকে জানলাম, এটা তাঁদের সবচেয়ে বড় সাংস্কৃতিক উৎসব। তিনি পাঁচ বছর ধরে আছেন সিডনিতে এবং প্রতিবছর এই উৎসবে যোগ দিচ্ছেন। কেন প্রদীপ ভাসাচ্ছেন—এর উত্তরে জানালেন, মনের সব পঙ্কিলতা দূর করে নতুন উদ্যমে পথচলার জন্য তাঁরা প্রদীপ ভাসান। প্রদীপ ভাসানো শেষ হলে শুরু হয় আতসবাজি। এর মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটে।
সময়ের স্বল্পতার জন্য আমরা আতসবাজি দেখতে পারিনি। কিন্তু বিকেল থেকে সবগুলো অনুষ্ঠান দেখলাম। আমাদের সঙ্গে ছিলেন আমার শ্বশুর, যিনি আগের রাতে মাত্র বাংলাদেশ থেকে এসেছেন। আমরা ভাবছিলাম তাঁকে নিয়ে। বয়স্ক মানুষ। তা ছাড়া বাংলাদেশ থেকে আসার পথের ক্লান্তি তো ছিলই। আমাদের সঙ্গে সমানতালে হাঁটতে কিংবা এত কোলাহল তাঁর ভালো লাগবে কি না, তা নিয়ে আমাদের কিছুটা দ্বিধা ছিল। কিন্তু আমাদের অবাক করে দিয়ে তিনি সবকিছু দেখেন। তাঁর উচ্ছ্বাস ছিল দেখার মতো। তিনি অনেক আনন্দ পেয়েছেন। তাঁর মতে, সিডনি এসেই এশীয় সংস্কৃতির এরকম একটি অনুষ্ঠান দেখবেন ভাবেননি। তাঁর আনন্দ দেখে আমাদেরও আনন্দে মন ভরে উঠল।
সুস্মিতা পাল জেমী
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া