শিকল ভাঙ্গা কল
নজরুলকে অনেকেই বলেন বিদ্রোহী কবি, অনেকেই বলেন নজরুলের রচনা বেশ কঠিন। আমার কাছে কিন্তু কাজী নজরুল ইসলাম মানে এমন একজন মজার মানুষ, যিনি জীবনকে অনেক সহজভাবে চেনাতে পারেন।
ছোট্ট বেলায় ‘খুকি ও কাঠবিড়ালি’ পড়তে গিয়ে মনে হতো, আচ্ছা, কাঠবিড়ালি কি আসলেই গুড়–মুড়ি, দুধভাত এগুলো খায়? সে ব্যাটা কাঠবিড়ালি কি এতই লোভী, যে খুকুকে সে একটা পেয়ারা দিতে পারে না? আবার ‘লিচু চোর’ কবিতার ছেলেটির জন্য ভীষণ মায়া হতো। আহারে, বেচারা মালির পিটুনি, কুকুরের তাড়া সবকিছুই খায়, লিচু আর খেতে পারল কই? ‘প্রজাপতি’ গানটা গাইতে গিয়ে মনে হতো, ইশ্, আমার এমন এক প্রজাপতি বন্ধু থাকলে মন্দ হতো না।
শিশুর কল্পনাশক্তিকে এত প্রভাবিত করার ক্ষমতা একমাত্র কবি নজরুলের কলমেই ছিল হয়তো। আর কারও ছড়া পড়লে তো এত মজা পেতাম না, কখনোই।
গান আমার পরম বন্ধু হলেও নজরুলসংগীত ঠিকভাবে গাইতে হলে শাস্ত্রীয় সংগীতে যে পরিমাণ তালিম প্রয়োজন, আমার তা নেই। সে তুলনায় আমার জন্য আমার প্রথম প্রেম, বিশ্বকবিই ভরসা।
তবে মানতেই হবে, নজরুলের মতো হামদ-নাত কেউ লিখতে পারবেন কি না জানি না। অন্য গানগুলো না গাইলেও নজরুলের ইসলামিক গানগুলো আমায় ভীষণভাবে টানে। বিশেষ করে যদি কোনো গানের পেছনে কোনো গল্প থাকে, তবে তা আমাকে আরও টানে। তেমনি একটি ভীষণ প্রিয় ইসলামিক গান, ‘হে নামাজী, আমার ঘরে নামাজ পড়ো আজ।’ গানটি নজরুল নির্দিষ্টভাবে লিখেছিলেন শিল্পী আব্বাস উদ্দিন আহমেদের জন্য। নজরুলের বাড়িতে একদিন অতিথি হয়ে এসেছিলেন আব্বাস। অতিথির সঙ্গে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা থেকেই এই গানের জন্ম।
আজও কি সমাজে লিঙ্গবৈষম্য নেই? তবে দুখু মিয়া সেই কবেই বলে গেছেন, ‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী/ অর্ধেক তার নর’ নজরুলের গানের একটি লাইন জীবনের সঙ্গে বেঁধে রেখেছি: ‘এ তো শিকল বাঁধা পা নয়, এ শিকল ভাঙ্গা কল।’ শিকল বাঁধা পা নিয়ে জন্মানো মানুষকে জানতেই হয় শিকল ভাঙার মন্ত্র, কেবল নিজের জন্য নয়, চারপাশের জন্য! বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল, আপনার সৃষ্টিতে লুকিয়ে থাকা অজস্র মণিমুক্তা কুড়িয়েই পথ চলি।
*লেখক: কাজী ফাল্গুনী ঈশিতা, ক্যালিফোর্নিয়া, আমেরিকা