শিক্ষার আলোয় উদ্যমী তারুণ্য

১.
চাঁদের আলোয় কয়েকজন যুবক, লিখেছিলেন জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ স্যার। তারুণ্যের উচ্ছ্বাসে সদা কৌতূহলী যুবকদের মধ্যে আলোর বিচ্ছুরণ থাকবেই। কৌতূহলী মনে জানার আগ্রহ বাড়ায়। হাজারো অজানা বিষয়কে আয়ত্তে আনতে তাই বইয়ের পাতায় চোখ রাখা, আর কখনোবা সিনিয়রদের কাছে ছুটে যাওয়া। জীবন পথের অনন্ত এই ছুটে চলাতে অনেক চড়াই-উতরাই আর ঘাত-প্রতিঘাতের মুখোমুখি হয়ে নিজেদের এগিয়ে নিয়ে তরুণেরা পৌঁছান উচ্চতর শিক্ষার উম্মুক্ত পরিবেশে। শিক্ষাঙ্গনের উম্মুক্ত পরিবেশে নিজেদের নতুন করে জানা।
     
২.
জীবনের আঁকাবাঁকা পথে মানুষকে জানার আগে নিজেদের চেনা বেশি প্রয়োজন। অজানা বিষয়ে জ্ঞানপিপাসা বাড়িয়ে আর হীনম্মন্যতা থেকে বেরিয়ে এসে মুক্ত চিন্তা দিয়ে প্রতিযোগিতায় নেমে পড়াই বুদ্ধিমত্তার কাজ। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকাতেই আনন্দ। সংগ্রামমুখর আগামী দিনে সব প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুত হতে শিক্ষাঙ্গনের বিভিন্ন স্তরে সময়কে যথোপযুক্ত কাজে লাগাতে হয়। উচ্চতর পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে প্রতিটা মুহূর্ত যেন একেকটি শিক্ষা সোপান। এসব শিক্ষা সোপানে হতাশাকে প্রশ্রয় না দিয়ে, জ্ঞানার্জনে মনোযোগ দিয়ে, পরিশ্রম করে জীবন পথের আগামী দিনগুলোকে সুন্দর করাই মানুষের চাওয়া। উত্তম ভাবনা। এই চাওয়া নিজের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য ও পরিবারের শান্তির জন্য। আর সুন্দর সমাজ গঠন করে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য।
নিজেদের ছাড়িয়ে সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রেখে দেশকে ভালো কিছু উপহার দিতে শিক্ষার সুন্দর আলোয় আলোকিত উদ্যমী তরুণেরা ভলান্টারি কাজ করেন। প্রচারবিমুখ তাঁরা, কাজ করেন নীরবে–নিভৃতে। কচি বয়সী ছাত্রছাত্রীদের আলোর পথ দেখানো বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া অনেক উদ্যমী তরুণকে দেখেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার ফাঁকে একটু অবসরেই নিজেদের ব্যস্ততা ফেলে বিভিন্ন শহর থেকে তাঁরা ছুটে যান নিজ নিজ গ্রামে। নিজ এলাকায় ছাত্রছাত্রীদের সামনে এগিয়ে নিতে কাজ করেন। সেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে কচি শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় আরও আগ্রহী করতে গঠনমূলক আলোচনা, পরামর্শ, আর সহযোগিতা করেন তাঁরা। শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করতে বিভিন্ন সময়ে সাধারণ জ্ঞানের কুইজ, পুরস্কার বিতরণী ও গুণীজনদের সঙ্গে নিয়ে আলোচনা করেন। খুব উৎসাহব্যঞ্জক এসব উদ্যোগ। একটা দেশের জন্য এটা অত্যন্ত বড় আশার কথা।
৩.
শিক্ষার সুন্দর আলোয় আলোকিত আরও কিছু উদ্যমী যুবকদের কথা জানা গেল। বয়সে তাঁরা বেশ তরুণ, আর অন্তরে তাঁদের তারুণ্যের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস। অল্প বয়সেই বড় বড় স্বপ্ন দেখার শুরু। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া কিছু স্বপ্নচারী যুবক তাঁরা। রসায়নের শিক্ষার্থী। করোনাভাইরাসের তাণ্ডবে ২০২০ সালের শুরুটায় যখন বিশ্বময় মানুষের মধ্যে আতঙ্কের ছড়াছড়ি, দেশেও তখন বন্ধ হয়ে যায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। অলস সময় হতাশার, কর্মহীন জীবন নিরানন্দের। সেই আলসেমি আর কর্মহীনতাকে বিতাড়িত করে ভালো কিছু করার তাড়নায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের কিছু শিক্ষার্থী ডিজিটাল মিডিয়ায় একত্র হয়ে প্রতিষ্ঠা করেন কেমফিউশন।
 কেমফিউশন কী? নিউক্লিয়ার কেমিস্ট্রিতে দুই বা ততোধিক পারমাণবিক নিউক্লিয়াসের বিক্রিয়ায় এক অথবা একাধিক অন্য পারমাণবিক নিউক্লিয়াস তৈরি করে এবং এসবে পারমাণবিক বন্ধন শক্তির পার্থক্যের কারণে এই সময় সাধারণত প্রচুর পরিমাণ শক্তির সৃষ্টি হয়। এ রকম প্রাণশক্তিই কেমফিউশনের রসায়নবিদ তরুণদের মধ্যে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া রসায়নের একঝাঁক ছাত্রছাত্রী একত্র হয়ে দেশের মাটিতে ছাত্রছাত্রীদের জন্য রাসায়নিক শিক্ষাকে আনন্দময় করতে আর উচ্চতর গবেষণাকে সহজ করে বুঝতে সৃষ্টি করেন কেমফিউশন। ইতিমধ্যেই এতে প্রায় পাঁচ হাজার রসায়নের ছাত্রছাত্রী সেবা পেয়ে আসছেন। বেসিক বিজ্ঞানে রসায়ন খুবই বড় এক শাখা। দেশে আমাদের রাসায়নিক শিল্পকে অত্যাধুনিক করতে, আর উচ্চতর গবেষণায় বেশি সাফল্য আনতে উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে রসায়ন বিজ্ঞানের উচ্চতর শিক্ষা অপরিহার্য।
৪.
বিশ্বের উন্নত দেশের সঙ্গে তাল মেলাতে আমাদের দরকার শিক্ষা ও গবেষণায় প্রতিনিয়ত অগ্রগতি। উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত প্রাণোচ্ছল তরুণদের হৃদয়ে এই অগ্রগতির যে বাসনা সেটি স্পষ্ট শোনা যায়। অগ্রজদের প্রাণেও তখন সে রকম সুন্দরের দোলা অনুভূত হয়, আর মনে শক্তি জোগায়। দেশে যুবসমাজের মধ্যে শিক্ষার সুন্দর আলো ছড়িয়ে যাক, ভালো কাজে লেগে থাকার নেশাটা থাকুক, আর সুন্দর কিছু সৃষ্টির প্রতি আগ্রহ থাকুক। বিপদে হতাশা নয়, অর্থসংকটে ভেঙে পড়া নয়। বিশৃঙ্খলতাকে না, অমঙ্গলকর সবকিছুকে না। মানবতার তরে, পরিবারের জন্য, সমাজের নিমিত্তে, আর দেশের স্বার্থে সার্বক্ষণিক যতটা সম্ভব নিজেদের সেরাটা দেওয়া দরকার। এই সেরাটা দিয়েই দেশ ছাড়িয়ে বৈশ্বিক উন্নয়নেও আমাদের ছেলেমেয়েরা বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখবে। আশাবাদী।
লেখক: পিএইচডি, রিসার্চ সায়েন্টিস্ট (জৈব রসায়ন), কানাডা