শুভ্র বোস্টন ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েক দিন

হার্ভার্ড স্কয়ার
হার্ভার্ড স্কয়ার

বোস্টনে বিমান যখন অবতরণ করল, ঘড়ির কাঁটা তখন মাত্র ১১ পেরিয়েছে। বেলা ১১টা বেজে ১০ মিনিট। বাইরের তাপমাত্রা ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আমি চেক ইন শেষ করে হাতব্যাগ থেকে ইনার ও ওভারকোটটা বের করলাম। একটা টয়লেট খুঁজে নিয়ে ইনারটা পড়ে ফেলতে হবে। হিম আবহাওয়ার সঙ্গে যুদ্ধের প্রস্তুতি।

এ বছর বোস্টনে তুষারপাত আগের রেকর্ডকে হার মানিয়েছে। জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত তুষারপাতের পরিমাণ ছিল ২৫-৩০ ইঞ্চি। যে ট্যাক্সিতে করে হোটেলে যাচ্ছি, সেই ক্যাবচালক বিষাদ বিতৃষ্ণায় বললেন, গড এবার আমাদের একটুও রেহাই দিতে চাচ্ছেন না। চার মাস ধরে এই বিশ্রী ওয়েদারে জীবন অতিষ্ঠ হয়ে গেল। রাস্তার দুই দিকেই ভয়াবহ তুষারপাতে প্রায় সবকিছুই ঢাকা। ডুপ্লেক্স বাড়িগুলোয় প্রবেশ পথটা কোনো রকমে পরিষ্কার করা হয়েছে। ছাদ থেকে জানালা সব বরফে ঢেকে আছে। গাছগুলো পাতাহীন। শুভ্রতার মাঝে বিষণ্নতা। তার মধ্যেও এক অন্যরকম সৌন্দর্য।
আমি বোস্টনে এসেছি হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলে এক সপ্তাহের একটি কোর্স করতে। বিষয়: উন্নয়নে উদ্ভাবনের প্রভাব। কাসরুম কোর্সের পাশাপাশি আমরা দুটি রিসোর্ট ও দুটি ইনকিউবেটর ভিজিট করব। আরও থাকবে দুইটি স্পেশাল ডিনার। হার্ভার্ডের অধ্যাপকদের সঙ্গে।
প্রথম দিনে বাকি সময়টুকু কাটল হোটেলের আশপাশটা ঘুরে দেখে। ডান পাশে Whole Foods Market, TJ Super market, একটি সেপাটস ও আর অতি অল্প সময়েই আমরা অতি প্রিয় কপিশপ হয়ে ওঠা Penria Bread Shop. যেখানে আশি ভাগ কাস্টমারই দিনের যে কোনো সময়ে কোনো না কোনো বই পড়েছেন কফি অথবা স্যান্ডউইচ সহযোগে।
হোটেলের শাটল বাস করে পরদিন সকাল ৮টায় চলে এলাম হার্ভার্ড স্কয়ারে। বাস থামল হার্ভার্ড কুপের সামনে। হার্ভার্ড কুপ নিয়ে একটু পরেই লিখছি। হার্ভার্ড স্কয়ার থেকে তিন মিনিটের হাঁটা দূরত্বে আমরা এসে ঢুকলাম কেনেডি স্কুলের এক বিল্ডিংয়ের সামনে। এই বিল্ডিংয়ের দোতলায় আমাদের ব্যাচের ওরিয়েন্টেশন হবে।
২০৯ একর জমির ওপর স্থাপিত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়। একাডেমিক ভবন ছাড়াও এখানে আছে হার্ভার্ড মিউজিয়াম, স্টেডিয়াম, মেমোরিয়াল হল, চার্চ, অ্যাথলেটিক সেন্টার, কোট হাউস আর হার্ভার্ডের প্রাণকেন্দ্র হার্ভার্ড স্কয়ার। এই স্কয়ারের সবগুলো স্টেশন থেকে বোস্টনের ডাউনটাইনে যেতে সময় লাগে মাত্র ১১ মিনিট।

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়

কি নেই হার্ভার্ড স্কয়ারে? হোটেল, শপিং, থিয়েটার, রেস্টুরেন্ট, স্টুডিও, নাইটক্লাব, বুকস্টোর—সবকিছুর জমজমাট আয়োজন এই স্কয়ারে। প্রতিটি রেস্টুরেন্ট, ক্যাফে, বুকস্টোর মুখরিত তরুণ–তরুণীদের তরতাজা আড্ডায়। হার্ভার্ড এমআইটির ছেলেমেয়েরা ছাড়াও আছেন অনেক টুরিস্ট। এই ভয়াবহ ঠান্ডা আবহাওয়াতেও মানুষের কমতি নেই। ঠান্ডা থেকে একটু রেহাই পাওয়ার আশায় আমি গিয়ে ঢুকলাম পিটস কফি শপে। বসার জন্য কোনো আসন ফাঁকা নেই। টেবিল ভর্তি কফি, কেক আর ল্যাপটপে ছেলেমেয়েদের গভীর মনোযোগ। দেখা গেল কয়েকজন বয়স্ক। তারাও গভীরভাবে মগ্ন আড্ডায়। দেখে মনে হচ্ছে অধ্যাপকদের নিজস্ব সময়।
হার্ভার্ডের বেশির ভাগ কফি শপেই এই রকম একটি পরিবেশ দেখা যায়। সবাই পড়ছেন। ল্যাপটপে কাজ করছেন। গ্রুপ ডিসকাশন করছেন। পিপল অ্যান্ড ফুল অব আইডিয়াস। হার্ভার্ড বলে তাদের স্টুডেন্টরা বিশ্বজয় করবে। এই সব ছেলেমেয়েদের দেখে আমার খুব সহজেই সেটা বিশ্বাস করে ফেলতে ইচ্ছে করছে।
হার্ভার্ডের ছেলেমেয়েরা যে শুধু সুগন্ধি নয়, বোধ হয় তা প্রমাণ করার জন্যই এই স্কয়ারে প্রতিবছর আয়োজন করা হয় অনেক কিছু। ফুড, মিউজিক ফেস্টিভ্যাল, মে ফেয়ার, অক্টোবর ফেস্ট, চকলেট ফেস্টিভ্যাল, নিউ ইয়ারস পার্টি ইত্যাদি। সামার টাইমটা উৎসবের।
স্কয়ারে আমার অন্যতম প্রিয় জায়গাটা ছিল দ্য কুপের বুকস্টোর। বই আর বই। ফিকশন–নন ফিকশন। দোতলা এই বইয়ের দোকানে ঢুকলে অবলীলায় কয়েক ঘণ্টা কাটিয়ে দেওয়া যাবে। এদের বিজনেস বুক কালেকশনস সবচেয়ে ভালো। বুকস্টোরের পাশে আছে কফি শপ আর পেছনে কুপ হার্ভার্ড স্যুভেনির শপ। হার্ভার্ডে এসে এই শপে না ঢুকে ও কিছু না কিনে কেউ নিজে দেশে ফিরে গিয়েছেন কিনা সন্দেহ। এমআইটিতেও এই রকম কুপশপ আছে। টি-শার্ট পেন, স্টেশনারি আইটেম ছাড়াও আছে হার্ভার্ড নাম ও লোগো খোদাই করা জুয়েলারি, রিং, কম্বল, বালিশ এমনকি হার্ভার্ডের স্পেশাল কাঠের চেয়ার, যার দাম ৭০০ ডলার পর্যন্ত।

মন্ত্রমুগ্ধ লেকচার টাইম
রিকার্ডো হসম্যান ক্লাসে ঢুকলেন জিন্স, চেক শার্ট ও সোয়েটার পরে। কাঁচা পাকা দাঁড়ি, ছয় ফুট লম্বা। অর্থনীতি ও উন্নয়নের বিভিন্ন দিক নিয়ে তিন ঘণ্টার ক্লাস আমরা শুনলাম মন্ত্রমুগ্ধের মতো। ভেনেজুয়েলার সাবেক এই পরিকল্পনা মন্ত্রী বললেন একটি দেশের জ্ঞান আহরণের ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে তার উন্নয়নের মাত্রা। যে জাতি যত দ্রুত জ্ঞান আহরণ করতে পারবে, তার উন্নয়নও তত দ্রুত হবে। জ্ঞান আহরণের ক্ষমতা (Knowledge absorbing capacity) বাড়ানোর জন্য দরকার প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ও টেকনিক্যাল স্কুলস। একটি দেশের কর্মদক্ষতা ও ব্যবহারিক জ্ঞান বাড়াতে হবে উন্নয়নের প্রবৃদ্ধির জন্য। অল্প সম্পদ ব্যয় করে বেশি উৎপাদন করতে হবে। আর তার জন্য প্রয়োজন অনেক বেশি দক্ষতার বৈচিত্র্য ভিন্ন ক্ষেত্রে বিনিয়োগ ও উদ্ভাবন।

হার্ভার্ড কুপ
হার্ভার্ড কুপ

রিকার্ডো হসম্যান যেমন গুরুগম্ভীর, ক্যালেসটিয়াস জুমা হচ্ছেন তেমনি হাস্যোজ্জ্বল। কেনিয়ান বংশোদ্ভূত প্রফেসর জুমা খুব স্ট্রাকচারর্ড ক্লাস নিতে পছন্দ করেন না। কিšউদ্ভাবন ও উন্নয়ন বিষয়ে তিনি হচ্ছেন এক জীবন্ত এনসাইক্লোপিডিয়া। বললেন, উন্নতি করতে চাইলে প্রযুক্তিবিদ্যা কোনো বাধা নয়। আজকের পৃথিবীর এক সময়ের সবচেয়ে দরিদ্র দেশ ইথিওপিয়াও মহাকাশে স্যাটেলাইট প্রেরণ করছে। প্রয়োজন হচ্ছে ইচ্ছা ও জাতীয় পর্যায়ে পরিকল্পনা।
কিন এনার্জি নিয়ে সেশন হলো একটা। ডেভিট ক্যাশ জানালেন কিন এনার্জি ক্ষেত্রে এক লক্ষ জব তৈরি হচ্ছে শিরগিরই।
ক্লাসের পাশপাশি আমরা ঘুরে এলাম হার্ভার্ড ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল, ওয়েস ইনস্টিটিউট, বোস্টন চিলড্রেন হসপিটাল। এই হসপিটাল পোলিও ভাইরাস আবিষ্কারের জন্য ১৯৫৪ সালে নোবেল প্রাইজ অর্জন করে।

বোস্টনের উইকএন্ড
শনিবার যুক্তরাষ্ট্রে সাপ্তাহিক অবকাশ। আমার হার্ভার্ডের ক্লাস শেষ। আমি একদিন পরই উড়াল দেব। ওয়েদার চ্যানেলের মতে পরদিন দুপুরে তুষারপাত হবে। এদের ওয়েদার চ্যানেলের ভবিষ্যদ্বাণী প্রায় এক শ ভাগ মিলে যায়।
শনিবারটা একটু ঘুরব প্ল্যান। আন্ডারগ্রাড ইউনিভার্সিটির এক ছোট ভাই আসবে ওর গাড়ি নিয়ে। নাসের এখন আমেরিকান সিটিজেন। আমি সকালে চলে গেলাম Penria Bread শপে। উইকএন্ড বলে শপ আজকে লোকে লোকারণ্য। আমার সামনে ও পেছনে দুজন মা–বাবা তাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে বসেছেন। পেছনের আসনের মা আর তার ৫-৬ বছরের ছেলের কথোপকথন পরিষ্কার কানে আসছে। মা ছেলেকে প্রশ্ন করছে, সে স্যান্ডউইচ খেতে পছন্দ করে কিনা। কি ধরনের স্যান্ডউইচ তার পছন্দ। উইকএন্ডে তার প্রিয় কাজ কি, মায়ের সঙ্গে ঘুরতে ভালো লাগে কিনা। কফি শপটা কি সুন্দর ইত্যাদি ইত্যাদি।
মা-ছেলের কথোপকথন শুনলে মনে হবে দুজন প্রাপ্তবয়স্ক কথা বলছেন। পারিপার্শ্বিক বিষয়াদি নিয়ে মা তার এত অল্প বয়স্ক ছেলের সঙ্গে খুঁটিনাটি কথা চালিয়ে যাচ্ছেন। জুরিখে দেখেছিলাম রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় এক মা তার ৬–৭ বছরের ছেলেকে রাস্তা পারাপারের বিভিন্ন নিয়ম শেখাচ্ছেন। খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছে ছেলেটি। আমাদের দেশে বাবা-মায়ের সঙ্গে ছোট বাচ্চাদের এই ধরনের বন্ধুত্বসুলভ কনভারসেশন হয় কিনা আমার জানা নেই।
নাসের গাড়ি নিয়ে এসে পড়ল। আমরা লাঞ্চ করার জন্য গেলাম একটা সি-ফুড রেস্টুরেন্টে। ফিস অ্যান্ড চাপস এদের সবচে জনপ্রিয় মেনু। বরফ পড়া শুরু হয়েছে। আমরা গাড়ি দিয়ে যাচ্ছি খুব ধীর গতিতে। সামনে দেখতে পেলাম এক গাড়ি থেকে মাটিতে লবণ ছিটানো হচ্ছে। লবণ বরফ গলতে সাহায্য করে।

লেখক
লেখক

ফিশ অ্যান্ড চাপস খেতে খেতে নাসের বলল, বোস্টনের কমিউনিটি খুবই ভালো। সবাই কমবেশি শিক্ষিত, নম্র, ভদ্র ও সহনশীল। অধিকাংশই জড়িত বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। স্টারবাকস থেকে শুরু করে কমবেশি সবগুলো কফিশপেই দেখা যাবে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা কাজ করছে। হোটেল রিসেপশনেও তাই। আর আছেন অনেক টুরিস্ট। তারা এসেছের কোনো না কোনো কনফারেন্স, সেমিনার বা প্রোগ্রামে।
রোববার দুপুর ১টায় আমার ফিরতি প্লেনের সময়। তুষারপাতের কারণে দুই ঘণ্টা পর বিমান আকাশে উঠল। আমি বিমানের জানালা দিয়ে বোস্টন দেখার চেষ্টা করলাম। চারদিকে শুধু সাদা তুলোর আবেশ। বরফে ঢাকা সব। তার মাঝেও অসম্ভব প্রাণ চাঞ্চল্যে ভরপুর একটি বিদুষী শহর।