শেষ পর্যন্ত মা আমাকে মাছ খেতে দেয়নি

মায়ের সঙ্গে লেখক। ছবি: সংগৃহীত
মায়ের সঙ্গে লেখক। ছবি: সংগৃহীত

১৯৭১ সাল, স্বাধীনতাযুদ্ধ চলার সময়ের কথা বলছি। বর্তমান গাজীপুরের (পুরাতন জয়দেবপুর) অন্তর্গত ভাওয়াল রাজার বাড়ির আশপাশে হিন্দু–অধ্যুষিত এলাকায় বিভিন্ন বাড়িঘরে পাকিস্তানের সেনারা দেশে তাদের সহযোগীদের সহায়তায় আগুন ধরিয়ে দেয়। ফলে এলাকাবাসী নিজেদের বাড়িঘর ফেলে রেখে যে যার মতো পালিয়ে প্রাণে বাঁচে। তখন অনেকেই আমাদের গ্রামে, বাড়ির পাশে গির্জা ও স্কুলঘরে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন পরিবার সেখান থেকে সুবিধা অনুযায়ী গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে থাকতে শুরু করেন। তাদের মধ্যে কিছু সম্ভ্রান্ত পরিবার বাড়িতে এসে আমাদের ঘরে আশ্রয় নেয়।

বাড়িতে তখন মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি ছিল। তাঁদের রান্নাও হতো বাড়িতে, তবে একসঙ্গে এক পাতিলে নয়। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সবই ছিল আলাদা।

একদিন বাজার থেকে বাবা অনেক বড় এক বোয়াল মাছ কিনে আনলেন। পরের দিন সেটা ভেজে কারিতে দেওয়ার জন্য মা চুলার কাছে সিলভারের বড় বোলে রাখলে আমি চোখ বড় করে সেই ভাজা মাছের টুকরার দিকে একনজরে তাকিয়েছিলাম। মাছ দেখে এত বেশি খেতে ইচ্ছে হচ্ছিল যে চোখ আর সরছিল না ভাজা মাছ থেকে। ভাজা মাছের টুকরাগুলো কারিতে দেওয়ার জন্য রাখা হলেও আমি এক টুকরা মাছ খাওয়ার জন্য বেশ আবদার করছিলাম। আমার আবদার দেখে বারবার মা বলছিল, আগে পুকুরে গিয়ে গোসল করে আসতে। গোসল করে এলে পরে আমাকে ভাজা মাছ খেতে দেবেন। আমি মনে হয় মাছের জন্য এতটা আবদার এর আগে কখনো করিনি। করলেও মনে পড়ে না। এরপরও কখনো ভাজা মাছ খাওয়ার জন্য অন্তত এতটা আবদার করেছি বলে মনে পড়ে না।

সেদিন রান্নাঘরের সামনে ঘরে যাওয়ার বা ভেতরে ওঠার সিঁড়ির মধ্যে মাটিতে (আমরা সেমা বলি) খালি গায়ে বসে গড়াচ্ছিলাম আর মাছ খাওয়ার জন্য আবদার করছিলাম। মা আমাকে কোনোভাবেই মাছ খেতে দিতে চাইল না, তাই (সঙ্গের নারী, যিনি জয়দেবপুর থেকে এসে আমাদের বাড়িতে আশ্রয় নিলেন, তাকে মাসিমা ডাকতাম।) মাসিমা আমাকে আদর করে মায়ের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বলছিলেন, যাও বাবা, তোমার মা না দিলে আমি দিমু। আগে পুকুরে গিয়ে দিদিদের সঙ্গে গোসল করে আসো।

বাড়িতে তখন মাটির কালো গামলা বা চাড়িতে প্রতিনিয়ত নিজেদের জন্য এবং মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য শোল, কই, মাগুর মাছ জিইয়ে রাখা হতো। সেই মাছই খেতাম প্রতিদিন। শুধু তা–ই নয়, বাড়িতে দুধ দেওয়ার মতো গাভি ছিল বলে প্রতিদিন চুমুক দিয়ে দুধ খেতে পারতাম। এসবের কখনো অভাব বোধ করিনি ছোটবেলায় আমরা। বলতে পারি, অন্য কোনো খাবার নিয়ে কখনো আবদার করলেও মাছ নিয়ে এত আবদার আর আগে পরে করা হয়নি আমার।

সেদিন মায়ের কথায় রাজি না হলেও যেই না মাসিমার কথায় রাজি হয়ে পুকুরঘাটে গোসল করতে যাওয়ার জন্য রাজি হলাম, তখনই দক্ষিণপাড়ার মুক্তিযোদ্ধা মমতাজ উদ্দিন ঘরের সামনে এসে চিৎকার দিয়ে প্রথম বাবাকে চাচা চাচা বলে ডাকতে শুরু করেন। মা যখন ভেতর থেকে উত্তর দিয়ে বলল, তোমার চাচা তো বাড়িতে নেই। তখন মাকে চাচি চাচি বলে ডাকতে শুরু করে দেন। এরপর চিৎকার দিয়ে বলল, চাচি, শত্রুরা বাড়ি ঘেরাও করে ফেলছে। বোনেরা কই। জলদি ওদের নিয়ে বাড়ি ছেড়ে পালান। মা লাফ দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে বলল, তোমার বোনেরা তো সবায় পুকুরঘাটে গেছে গোসল করতে। পরের ঘটনা আমার স্বাধীনতাযুদ্ধের ওপর লেখা ‘পোড়া বাড়ি’ উপন্যাসে লেখা হয়েছে।

তখনই মমতাজ উদ্দিন দৌড়ে গিয়ে বোনদের ডেকে নিয়ে আসেন। বাড়িতে এসে দাঁড়ানোর সুযোগ পর্যন্ত পায়নি। সঙ্গে সঙ্গেই সবাই মিলে দৌড়ে বাড়ি ছেড়ে পালাতে থাকি। এর মধ্যে হইহই আওয়াজ আর গুলির শব্দে আমরা যে যার মতো সবকিছু ফেলে রেখে জান নিয়ে পালাতে শুরু করি। কিসের মাছ আর কিসের কি, মা আমাকে টেনে কোলে নিয়ে দৌড়াতে থাকে। সেদিনের সেই মুহূর্তের কথা কখনো ভোলার নয়।

সেদিন আমার সেই ভাজা মাছ আর খাওয়া হয়নি। নিরাপদ আশ্রয়ের উদ্দেশে দৌড়াতে দৌড়াতে গভীর রাতে এক বাড়িতে আশ্রয় মিলল। তার আগে একবার মাঝপথে এক স্কুলমাঠে এলাকার সব লোক জড়ো হয়ে আশপাশের বাড়ি থেকে গুড়–মুড়ি সংগ্রহ করে তা খেয়ে পেট ভরি। গভীর রাতে যখন সেই বাড়িতে আমাদের আশ্রয় হয়, তখন প্রায় ভোর।

মনে আছে, সবাই ক্লান্ত। ঘুমে কেউই চোখ খুলতে পারছিল না। তার মধ্যে ক্ষুধার জ্বালা। মা এবং যে বাড়িতে আশ্রয় মিলল, সেই বাড়ির লোকজন এক হয়ে চাল-ডাল সংগ্রহ করে সেই ভোরেই খাবার রান্না করছিল। মনে আছে, মা রান্নাঘরে রান্না চড়িয়ে আফসোস করে বলেছিল, প্ল্যাসিড এক টুকরো মাছ খেতে চেয়েছিল, তাকে খেতে দিইনি। এক টুকরা মাছ খেতে দিলে কী হতো?। মায়ের সেদিনের সেই আফসোস করে বলা কথা আমার চোখে ভাসে। শুধু তা–ই নয়, কানেও বাজে এখনো। এ নিয়ে মায়ের বেশ দুঃখও ছিল মনে।

মৃত্যুর আগে মায়ের বয়স সম্ভবত ৯৫ হয়েছিল। মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে থেকে স্মরণশক্তি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল মায়ের। তার আগে দেশে গিয়ে গ্রামের বাড়িতে বাবা-মার সঙ্গে বসে যুদ্ধের গল্প শুরু করলে সেই ভাজা মাছের কথাটি কয়েকবার মা বলেছে আমাকে।

যুদ্ধের সেই দিনে বাড়ি থেকে পালানোর সময় যে আমাকে ভাজা মাছ খেতে দেয়নি, সে কথা মা শেষ পর্যন্ত মনে রেখেছিল। আমিও ভুলিনি। এই কথা ভোলার মতো ছিল না যে। চলবে...