শ্বশুরবাড়ি সমাচার

ছবি: প্রথম আলো

আমার শ্বশুরের চার ছেলে, কোনো মেয়ে নেই। আমি বাড়ির বড় বউ। ক্রমিক সংখ্যায় বড় হলেও বউ হিসেবে আমার বাড়িতে প্রবেশের অবস্থান ছিল তৃতীয়। অবশ্য বয়সের দিক দিয়ে আমিই বড়। তাই বড় বউ হিসেবে শ্বশুরবাড়ির অনেক বড় বড় সিদ্ধান্ত আমি দিয়ে থাকি। আমার ভালোলাগাটা এখানেই যে আমার শ্বশুর-শাশুড়ি আমার সব সিদ্ধান্ত সাদরে গ্রহণ করেন। তবে এ কথা ঠিক শ্বশুরবাড়ি গিয়ে একেকজনের একেক ধরনের অভিজ্ঞতা হয়। এই যেমন ধরুন, কোনো মেয়ে শ্বশুরবাড়িতে নতুন নতুন গেলে অনেকেই নতুন বউয়ের পেছনে লেগে থাকে তাঁর ভুল ধরার জন্য, সেদিক দিয়ে আমি অনেক সৌভাগ্যবতী। শ্বশুরবাড়ির শুরুর দিন থেকে আজ অবধি সবার ভালোবাসায় আমি সিক্ত।

তবে এ কথাও ঠিক দু–একজন আমার কাছে আমার শ্বশুর-শাশুড়ির নামে দু–একটা কথা বলার চেষ্টা করেছে। আমি বুঝতাম, আমাকে বিভ্রান্ত করার জন্য এগুলো আমাকে বলা হতো। কিন্তু যেহেতু আমি সব সময় নিজের বুদ্ধি বিবেচনা কাজে লাগিয়ে পথ চলি। তাই আমার শ্বশুর–শাশুড়ির নামে কেউ নেতিবাচক মন্তব্য করলেও আমি সেটা বিশ্বাস করতাম না। শ্বশুরবাড়ি জায়গাটাই আসলে এমন, পরের কথায় কান দিলে সেখানে শান্তি থাকে না। আর পরের কথায় কান না দিয়ে নিজের বিবেক–বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে চললে সম্পর্কের সুতোয় কখনো টান পড়ার আশঙ্কা থাকে না। এসব কথা থাক, আজ বরং যা বলতে এসেছি, তা–ই বলি।

আমার শ্বশুরের মনে মনে একটা আক্ষেপ ছিল, তাঁর চার ছেলে অথচ তাঁর একটা ভালো বাড়ি নেই। আল্লাহর অশেষ রহমতে তাঁর এই মনঃকষ্ট আজ আর নেই। আমার শ্বশুরের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দুই বছর পূর্বে যে বাড়ির কাজ শুরু করা হয়েছিল, সেই বাড়ির কাজ অবশেষে শেষ হয়েছে। আমিও আজ জোরেশোরে বলতে চাই, শ্বশুরবাড়িতে নির্মিত এ বাড়ির স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলাম আমি। ফারুক হোসেন (আমার স্বামী) বলেছিল, দুই কক্ষের ওয়াল করা টিনশেড ঘর করতে। কারণ, ফারুক হোসেন অস্ট্রেলিয়া আসার পূর্বে আমার আর আমার মেয়ে তাজরির প্লেনের টিকিট কেটে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট শূন্য করে চলে এসেছিল। এমতাবস্থায় ফারুক হোসেনের এর চেয়ে বেশি কিছু বলার ছিল না। তবে বিশেষ একটা কারণে আজকের এই ছোটখাটো অট্টালিকা করার সাহস সেদিন আমিই শুধু দেখিয়েছিলাম। এর কারণ হলো ঠিক সেই সময়ে আমার মা–বাবা হজে যাওয়ার পূর্বে আমারই ছোট বোনের বিয়ে বাবদ আমার হাতে তিন লাখ টাকা রেখে গিয়েছিল।

আমি জানতাম, টাকাটা এখন বাড়ির কাজে ব্যয় করলেও ছয় মাস পর ফারুকের বেতন জমা হলে এই টাকা আব্বাকে ফেরত দিতে পারব। তা ছাড়া আমার মা–বাবাকে না জানিয়ে এমন সিদ্ধান্ত এ জন্যই নিতে পেরেছিলাম যে আমি জানতাম আমার এমন কাজে মা–বাবা আমার চেয়ে বেশি খুশি হবেন। এসব ভেবেচিন্তে আমার শ্বশুরকে যখন বললাম, এ বাড়িতে টিনশেড নয়, বিল্ডিং হবে। খুব খুশি হয়ে এক বাক্যে তিনি সেদিন রাজি হয়েছিলেন। তবে হ্যাঁ, এই বাড়ি করতে গিয়ে একটা জিনিস খেয়াল করেছি, অনেকেই অনেক নেতিবাচক মন্তব্য করেছে আমার অগোচরে।

তাদের উদ্দেশে বলতে চাই, শতভাগ ভালোবাসা নিয়ে যদি কোনো কাজ শুরু করা হয়, তবে তা সফলভাবে শেষ হবেই। তা ছাড়া ভালোবাসা ও বিশ্বাস—দুটোই অন্তর থেকে আসে, কারও মুখের কথায় নয়। তাই আমি যা করি, আমার বিশ্বাস ও ভালোবাসা থেকেই করি। আরও বলে রাখি, আমার কাছে আমার মা–বা ও শ্বশুর–শাশুড়ি সবাই সমান গুরুত্বপূর্ণ। তাই তাঁদের ভালো–মন্দ এবং ইচ্ছা-অনিচ্ছার দাম আমি সমান গুরুত্বের সঙ্গে দেখি।

জানি, অনেক শ্বশুর-শাশুড়ি আছেন, যাঁরা ছেলে–বউয়ের কোনো ভালো গুণ চোখে দেখতে পান না। ঠিক একইভাবে অনেক মেয়ে আছেন, যাঁরা শ্বশুর-শাশুড়ির কোনো কথাই ভালোভাবে মেনে নিতে পারেন না। তবে আমার মনে হয়, যেকোনো সম্পর্কই পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও বিশ্বাসের ওপর টিকে থাকে, অন্যথায় বালুর বাঁধের মতো যেকোনো সময় তা ভেঙে যায়। আমি আমার এই সংক্ষিপ্ত জীবনে যতটুকু সুখের সন্ধান পেয়েছি, সেই সুখের সঙ্গে অর্থবিত্তের কোনো সম্পর্ক নেই। গাদাগাদা চুক্তি ডিগ্রি নিয়ে চাকরি না করার কষ্ট আমার নেই। তার কারণ আমার শিক্ষা আমাকে শিখিয়েছে, একা একা সেরাটা ভোগ করার চেয়ে সবাইকে নিয়ে ভাগেযোগে ভোগ করার আনন্দ অপার। আমি বিয়ের পর যতবার শ্বশুরবাড়ি গিয়েছি, ঠিক ততবার সবাইকে নিয়ে আনন্দে মেতেছি, কখনো পাড়া বেড়িয়ে, কখনো নৌকাভ্রমণ করে, কখনোবা নতুন শেখা কোনো রান্না সবাইকে খাইয়ে। চাকরি করা না–করা নিয়ে আমার যেমন মাথাব্যথা নেই, আজ পর্যন্ত আমার শ্বশুরবাড়ির কারও মুখেও কোনো আক্ষেপ শুনিনি।

আবার শ্বশুরবাড়ির বাড়ি নির্মাণের কথায় আসি। ওই যে বললাম, শ্বশুরের কাছে তিন লাখ টাকা দিয়ে বাড়ির কাজ শুরু করতে বলে এসেছিলাম। তারপর অবশ্য আব্বা (শ্বশুর) তাঁর সঞ্চয়ের সবটুকুসহ, ফারুক হোসেনের চাকরির বাকি যা বেতন জমা হয়েছিল, সেটা এবং দেবরেরা যে যার মতো পেরেছে, তা দিয়ে এই বাড়ির কাজ শেষ করেছে। যেকোনো ভালো কাজই সাহসের অভাবে শুরু হয় না, অথচ একবার শুরু করলে তার শেষ হবেই।

আমরা যারা শ্বশুর–শাশুড়ির জন্য টাকা খরচ করতে বিরক্ত হই বা দিই না, তারা হয়তো জানি না, আমাদের সেই টাকা কোনো না কোনোভাবে হাত থেকে বেরিয়ে যাবেই। ঠিক একই ধারাবাহিকথায়, আমরা যদি তাঁদের জন্য কিছু করি, সেটাও সুদে-আসলে আল্লাহ আমাদের ফিরিয়ে দেবেন। বিশ্বাস না হলে এমনটা করেই দেখুন। তার চেয়ে বড় কথা, এই মানুষদের হারিয়ে হায় হায় না করে বেঁচে থাকতে তাদের জন্য কিছু করতে পারার সুযোগটা কাজে লাগানো বেশি জরুরি নয় কি?

আমার নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, অস্ট্রেলিয়া এসে খুব বেশি দিন আমি কাজ করতে না পারলেও, যতদিন করেছি এবং যে কয় টাকা আয় করেছি, তাতে মনে হয়েছে, আব্বার হাতে তিন লাখ টাকা না দিয়ে এলে এই অর্জনটুকু আমার হতো না। আলহামদুলিল্লাহ সবকিছুর জন্য। ভালো কথা, আমার শ্বশুরের ঘরে কিন্তু আমার উদ্যোগে একটি এসি লাগিয়ে দিয়েছি। আধুনিক নগরায়ণের সর্বোচ্চ সুযোগটুকু দেওয়ার প্রত্যাশায়। এখন আপনারাই বলেন, আমি ভালো থাকব নাতো কে ভালো থাকবে। পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেট না হয়েও আমি বাপের বাড়ি ও শ্বশুরবাড়ি—দুই জায়গাতেই হোম ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বে আছি। এটাইবা কম কি

  • সেন্ট্রাল কোস্ট, নিউ সাউথ ওয়েলস, অস্ট্রেলিয়া