সাইপ্রাসে চুক্তিভিত্তিক বিয়ে: দালালদের খপ্পরে প্রবাসী বাংলাদেশিরা

বিয়ে
প্রতীকী ছবি

ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত দেশ সাইপ্রাস একটি ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্র। দেশটির গুরুত্ব অনেক বেশি। বিশেষ করে এশিয়ানদের কাছে স্বর্গরাজ্য হিসেবে পরিচিত এ দেশ।

এশিয়ানদের মধ্যে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল এবং ভারতীয়দের জন্য আশীর্বাদ সাইপ্রাস। কেননা, এখানে এ চার দেশ থেকে যারা আসে, বেশির ভাগের উদ্দেশ্য একটাই, এখান থেকে সহজভাবে সেন্ট্রাল ইউরোপে পাড়ি দেওয়া। এখান থেকে সেনজেনের দেশগুলোতে যেতে হলে দুভাবেই যাওয়া যায়। ভিজিট ভিসা এবং সাইপ্রাসের বিয়ের কাগজধারী হলেই সাইপ্রাস থেকে সহজে সেনজেনে প্রবেশ করা যায়। সাইপ্রাস থেকে কোথাও ভিজিট ভিসার জন্য আবেদন করতে হলে তাঁকে অবশ্যই সাইপ্রাসের স্টুডেন্ট ভিসাধারী হতে হবে। তবে ভিজিট ভিসা যে সহজভাবে হয় তা–ও নয়৷ হাতে গোনা মাত্র কয়েকজন সেনজেন এবং ইউকের ভিসা পেয়েছেন।

বর্তমানে সাইপ্রাসে যেসব বাংলাদেশি আছেন, বিশেষ করে চার–পাঁচ বছর ধরে যাঁরা সাইপ্রাসে গেছেন, তাঁদের অধিকাংশই সাইপ্রাসের পার্শ্ববর্তী দেশ নর্থ সাইপ্রাস থেকে অবৈধভাবে প্রবেশ করেছেন। তাঁরা সেখানে অ্যাসাইলাম আবেদন করে বসবাস করলেও এটা বেশি দিন স্থায়িত্ব হচ্ছে না। আগে সাইপ্রাসে অ্যাসাইলাম আবেদন করে চার–পাঁচ বছর নিশ্চিন্তে থাকা গেলেও করোনা আসার পর থেকে সেটা বন্ধ হয়ে গেছে।

সাইপ্রাস সরকার এখন কঠোর৷ তারা কোনোভাবেই চাচ্ছে না, তাদের দেশে আর কোনো অ্যাসাইলাম থাকুক। ইতিমধ্যে সাইপ্রাস সরকার বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপালসহ বেশ কিছু দেশকে নিরাপদ দেশ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। এসব দেশের কেউ সাইপ্রাসে রাজনৈতিক আশ্রয় চাইতে পারবেন না।

এদিকে নর্থ সাইপ্রাস থেকে যেসব বাংলাদেশি সাইপ্রাসে ঢুকে পড়েছেন, তাঁরা পড়েছেন মহাসংকটে। অ্যাসাইলাম আবেদন করার এক মাসের মধ্যেই ফাইল রিজেক্ট করে দেওয়া হচ্ছে, আপিল করলে আবার স্বল্প সময়ের মধ্যে রিজেক্ট করা হচ্ছে। তারা বিয়ে করে কাগজ করার জন্য অনেকেই করোনা শুরু হওয়ার আগে দালালদের একেকজন চার–পাঁচ হাজার ইউরো করে অগ্রিম দিয়ে রেখেছেন। কিন্তু করোনা শুরু হওয়ায় সাইপ্রাসে বিয়ে বন্ধ হয়ে যায়, বিশেষ করে চুক্তিভিত্তিক বিয়ে (কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ) সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে গেছে বললেই চলে। আর সে সুযোগ কাজে লাগিয়েছে দালালেরা।

তারা আর কাউকেই টাকা ফেরত দেয়নি। টাকা ফেরত চাইলে দালালেরা টাকা মেরে দেওয়ার বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে সবার টাকা আত্মসাৎ করে খেয়ে ফেলে।

সাইপ্রাসে যেসব বাংলাদেশি বিয়ের দালাল আছে, তাদের নিজেদেরই কোনো কাগজ নেই। তারা নিজেরাই অ্যাসাইলাম আবেদন করে রিজেক্ট খেয়েছে। নিজেরাই অসহায় জীবন যাপন করছে। তারা নিজেরাও জানে না তাদের ভবিষ্যৎ কী! অথচ তারা মানুষকে চুক্তিভিত্তিক বিয়ে করিয়ে কাগজ করে দেবে বলে লাখো টাকা আত্মসাৎ করছে। আর তাদের পাতানো ফাঁদে পা দিচ্ছেন নর্থ সাইপ্রাস থেকে আসা বাংলাদেশিরা। অনেকেই বাংলাদেশ থেকে জমি বিক্রি করে, ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে সাইপ্রাসে টাকা এনে দালালদের দিয়েছেন। টাকা দেওয়ার পর তাঁরা এখন অসহায়। আগে সাইপ্রাস থেকে কন্ট্রাক্ট বিয়ে করে কোনোভাবে সেনজেনে যাওয়া গেলেও বর্তমানে সেটা অসম্ভব বলা যায়।

প্রতীকী ছবি

সাইপ্রাসে একদিকে সরকারের কঠোরতা, অন্যদিকে দালালদের প্রতারণার ফাঁদে পড়ে নিঃস্ব হচ্ছেন সাইপ্রাসপ্রবাসী বাংলাদেশিরা। এ বিষয়ে কয়েকজন অ্যাসাইলাম আবেদনকারী বাংলাদেশির সঙ্গে কথা বললে তাঁরা জানান, এভাবে তো সাইপ্রাসে এসে জীবনের মূল্যবান সময় নষ্ট করা যায় না। একবার ছয়–সাত লাখ টাকা দিয়ে সাইপ্রাসে এলাম, আবার পাঁচ–ছয় লাখ টাকা বিয়ের জন্য দিয়ে দালালের হাতে ধরা খেলাম। নেই কোনো ভালো একটা কাজ, নেই কোনো পেপার। সাইপ্রাসের ভবিষ্যৎ একেবারেই অন্ধকার। তার চেয়ে দেশে ফিরে যাওয়াই ভালো। দালালদের বিরুদ্ধে থানায় কোনো অভিযোগও তাঁরা করতে পারছেন না নির্যাতনের ভয়ে।

বাংলাদেশি দালালদের বিরুদ্ধে অনেকেই সাইপ্রাসে বাংলাদেশ কমিউনিটির কাছে বিচার নিয়ে গেলেও কোনো সমাধান পাননি। সাইপ্রাসে বাংলাদেশ কমিউনিটি কেবল নামেমাত্র, বাস্তবে এটার কোনো ভিত্তি নেই। কমিউনিটির অনেকের বিরুদ্ধে দালালদের আশ্রয়–প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগও আছে। তাই এখন কোনো বাংলাদেশি প্রতারণার শিকার হলেও কমিউনিটির কাছে যায় না।

এ ব্যাপারে সাইপ্রাসপ্রবাসী জ্যেষ্ঠ নাগরিক মোজাম্মেল হোসেনের সঙ্গে কথা বললে তিনি জানান, কেউ যেন চুক্তিভিত্তিক বিয়ের জন্য আর কোনো দালালের সঙ্গে টাকাপয়সার লেনদেন না করেন। প্রবাসী সুজন ভুঁইয়া জানান, দালালদের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগের কোনো সমাধান নেই। একমাত্র সমাধান হচ্ছে সচেতনতা তৈরি করা।

কোনো বাংলাদেশি যেন সাইপ্রাসে বিয়ে করে পেপার করার আশায় নর্থ সাইপ্রাস থেকে না আসেন। বর্তমানে নর্থ সাইপ্রাস থেকে আসা মানে নিজের জীবন ধ্বংস করা।