সাত পাহাড়ের শহরে মেট্রোরেলের আদ্যপান্ত

লিসবনের মেট্রোরেল
ছবি: লেখক

দুনিয়ায় সব বড় বড় শহরের মতো পর্তুগালের রাজধানী শহর লিসবনের গণপরিবহন মেট্রোরেলনির্ভর। এর অধিকাংশই মাটির নিচ দিয়ে চলাচল করে। লিসবন অনেকের কাছে সাগরকন্যা শহর হিসেবে পরিচিত হলেও তার আরও একটি পরিচয় হয়তো আমরা অনেকেই জানি না। এ শহরকে অনেকে সাত পাহাড়ের শহর হিসেবেও চেনে। কারণ লিসবন ছোট বড় সাতটি পাহাড় নিয়ে আটলান্টিক পাড়ে গড়ে ওঠা এক অপরূপ মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক শহর।

এই শহরের মানুষের যোগাযোগ সহজ করতে প্রথম ১৯৫৯ সালে মেট্রোরেল সেবা শুরু হয়েছিল। তখন মাত্র সাড়ে ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ একটি পথে যা বাইশা থেকে জারদিম জুলোজিকা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। বর্তমানে চারটি লাইনে ভাগ হয়ে এখন তা ৪৬ কিলোমিটার হয়েছে এবং ৫৫টি স্টেশন রয়েছে শহরজুড়ে। সকাল সাড়ে ৬টা থেকে শুরু হয়ে রাত ১টা পর্যন্ত সেবা মেলে মেট্রোরেলে। প্রতি ৪-১২ মিনিট পরপর স্টেশন ছেড়ে যায় একেকটি মেট্রোরেল।

যদিও লিসবনের মেট্রোকে দুটি জোন বা অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে। তবে বেশির ভাগ স্থাপনা, দর্শনীয় স্থান ও বিমানবন্দরসহ গুরুত্বপূর্ণ সবকিছু জোন এক–এর মধ্যে পড়েছে। নীল, হলুদ, সবুজ এবং লাল এই চার রঙের ও নামের মেট্রো রয়েছে লিসবনে, যার একক একটি ভ্রমণ টিকিটের মূল্য দেড় ইউরো। তা ছাড়া ৬ ইউরো ৪০ সেন্টে ২৪ ঘণ্টার টিকিট সংগ্রহ করা যায়, যা দিয়ে অসংখ্যবার ভ্রমণ করা যায় লিসবনের সব মেট্রো, বাস ও ট্রামে।

লিসবনের মানুষের যোগাযোগ সহজ করতে ১৯৫৯ সালে মেট্রোরেল সেবা শুরু হয়েছিল
ছবি: লেখক

এক কার্ড ব্যবহার করা যায় গণপরিবহনে

লিসবনের মেট্রো পরিষেবা শহরের পূর্বে ও উত্তরে বিস্তৃত এবং পশ্চিমে এর পরিষেবা নেই। যদি কাউকে বেলেম যেতে হয় তাহলে ট্রাম হলো তার বিকল্প। প্রত্যেক যাত্রীকে একটি ভিভা ভিয়াজেই (কার্ড) টিকিট সংগ্রহ করতে হয়, যা ৫০ সেন্ট খরচ পড়ে। পরে একক অথবা ২৪ ঘণ্টার টিকিট সংগ্রহ থেকে শুরু করে নির্দিষ্ট পরিমাপ টাকা রিচার্জ করা যায় এই কার্ডে। এই কার্ডটি আবার লিসবনের সব গণপরিবহনে ব্যবহার করা যায়। তা ছাড়া পার্শ্ববর্তী শহর কাসকাইস বা সিন্ত্রার ট্রেন ভ্রমণেও এটি ব্যবহার করা যায়।
সাধারণ একক টিকিটের চেয়ে ৩ ইউরো থেকে ৪০ ইউরো রিচার্জে খরচ একটু কম পড়ে। যেমন একক একটি টিকিটের মূল্য ১.৫ ইউরো কিন্তু কার্ডে রিচার্জ থাকলে তা প্রতিবার ব্যবহারে ১.৪ ইউরো কাটবে। তা ছাড়া ট্রাম ভ্রমণে ২.৮৫–এর পরিবর্তে ১.২৫ ইউরো চার্জ করে। টিকিট কাউন্টার বা সরাসরি অটোমেটিক ভেন্ডিং মেশিনের সাহায্যে টিকিট অথবা নির্দিষ্ট পরিমাপ ইউরো রিচার্জ করা যায়। তা ছাড়া রয়েছে সাপ্তাহিক এবং মাসিক ভিত্তিক রিচার্জ যা নিয়মিত চলাচলের জন্য অনেক সুবিধাজনক।

টিকিটের মেশিন
ছবি: লেখক

চারটি মেট্রো লাইন (নীল, হলুদ, লাল ও সবুজ) শহরটিকে অনেক ছোট করেছে তার বাসিন্দা এবং আসা পর্যটকদের কাছে। নিমেষেই শহরের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে ছুটে চলা যায় কোনো ধরনের ট্রাফিক ছাড়া। নীল লাইন যার পুরোটাই মাটির নিচ দিয়ে চলাচল করে। এই মেট্রো লাইন সান্তা পলোনিয়া থেকে রিভোলেইরা পর্যন্ত বিস্তৃত, যা পথিমধ্যে লাল লাইন সাও সিবাসতিও, হলুদ লাইন মারকেস পম্বল ও সবুজ লাইনে বাইশা সিয়াদো অতিক্রম করে।

হলুদ লাইনটি রাটো থেকে ওডিভেলাস পর্যন্ত বিস্তৃত, যা মারকেস পম্বলে নীল লাইন, সালদানাতে লাল লাইন এবং কাম্পো গ্রান্দেতে সবুজ লাইন অতিক্রম করে। এরপর লাল লাইনটি যা ওরিয়েন্ট লাইন হিসেবেও পরিচিত তা সাও সিবাস্টিও থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত বিস্তৃত। মাঝখানে সালদানাতে হলুদ লাইন এবং আলামিদাতে সবুজ লাইনকে অতিক্রম করে। তা ছাড়া সবুজ লাইন কাইস ডো সোডরে থেকে তেলহেরেস পর্যন্ত চলাচল করে এবং মাঝখানে বাইশা সিয়াদোতে নীল লাইন আলামেদাতে লাল লাইন এবং কাম্পো গ্রান্দেতে হলুদ লাইনকে অতিক্রম করে।

নীল, হলুদ, সবুজ এবং লাল চার রঙের ও নামের মেট্রো রয়েছে লিসবনে, যার একক একটি ভ্রমণ টিকিটের মূল্য দেড় ইউরো
ছবি: লেখক

লিসবন ভিভা কার্ড, যা একটি স্থায়ী কার্ড এবং এটি শুধু এর অধিকারীরা ব্যবহার করতে পারেন। এটি প্লাস্টিকের একধরনের কার্ড, যা সাধারণ টিকিট কাউন্টার বা অটোমেটিক ভেন্ডিং মেশিন থেকে নেওয়া যায় না। এই কার্ডে একটি চিপ এবং গ্রাহককে ছবি সংযুক্ত থাকে তাই নির্দিষ্ট কিছু স্টেশন বা কাউন্টারে তার জন্য আবেদন করতে হয়। আবেদনের সময় ছবি পাসপোর্ট এবং টিন নম্বর অপরিহার্য। বিশেষ করে কাম্পো গ্রান্দে বা মারকেস পম্ভলে এক্সপ্রেস সেবার মাধ্যমে ১২ ইউরো খরচে পরের দিনই এই নির্দিষ্ট কার্ড পাওয়া যায় অথবা সাধারণ নিয়মে ৭–১০ কর্ম দিবসে মাত্র ৭ ইউরো খরচে এই সার্ভিস পাওয়া যায়।

চারটি মেট্রো লাইন (নীল, হলুদ, লাল ও সবুজ) লিসবন শহরকে অনেক ছোট করেছে তার বাসিন্দা এবং আসা পর্যটকদের কাছে
ছবি: লেখক

মাসিক ভিত্তিতে মেট্রো ব্যবহারের জন্য দুটি আলাদা অফার রয়েছে। প্রথমটি শুধু লিসবন মিউনিসিপ্যাল, যা ৩০ ইউরো খরচ পড়ে এবং দ্বিতীয়টি মেট্রোপলিটন, যা ৪০ ইউরো খরচ পড়ে। খুব সহজেই টিকিট কাউন্টার অথবা অটোমেটিক ভেন্ডিং মেশিন থেকে নগদ অর্থ, কয়েন বা ব্যাংক কার্ডের মাধ্যমে রিচার্জ করা যায়। মোটামুটি সব স্টেশনের কাউন্টারে ইংরেজি জানা সার্ভিস অফিসার থাকে এবং সহজে যেকোনো বিষয়ে সহযোগিতা পাওয়া যায়।
*লেখক: মো. রাসেল আহম্মেদ, লিসবন, পর্তুগাল