সাদা-কালো ছবির চ্যালেঞ্জ-পেছনের নির্মম গল্প

পিনার গুলতেকিন। ছবি: সংগৃহীত
পিনার গুলতেকিন। ছবি: সংগৃহীত

৩২ বছরের বয়সী জিমাল বছর তিনেক আগে তাঁর বান্ধবীর সঙ্গে সামান্য বিষয়ে ঝগড়া করে। এর ব্রেকআপ করে। ব্রেকআপের পর জিমাল আর অপেক্ষা করেনি। ধুম করেই বিয়ে করে ফেলে। তারপর বছর ঘুরতেই তাদের ঘরে এক ফুটফুটে কন্যাসন্তানের জন্ম হয়।

সবকিছু খুব দ্রুত হয়ে যায়। বিয়ে-সংসার-সন্তান—এরপর?

এরপর খুব সম্ভবত একটা শূন্যতা ভর করেছিল জিমালের ওপর। কিংবা কে জানে হয়তো কোনো পুরুষতান্ত্রিক জেদ বা অমূলক দাবি? সেই দাবির জের ধরেই সে হাজির হয় সাবেক বান্ধবী, পিনার গুলতেকিনের ইউনিভার্সিটিতে।

জিমাল কথা বলতে চায়। কিন্তু পিনার রাজি হয় না...সম্পর্কই শেষ, আর কী নিয়ে কথা বলবে? জিমাল এখন বিবাহিত পুরুষ, একজন বাবা।

সমস্যা হলো, জিমাল আবার সেই প্রেম পুনরুদ্ধার করতে চায়, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক চায়। পিনার রাজি হয় না। কিছুতেই না।

অবশেষে, জিমাল হার মানে। শুধু শেষবারের মতন পিনারের সঙ্গে সে একবার দেখা করতে চায়। একবার, শুধু একটিবার।

চুকে বুকে যাওয়া সম্পর্কগুলো না অনেকটা নষ্ট হয়ে যাওয়া এন্টিক শো পিসের মতন, কোনো কাজে লাগে না, কোনো সৌন্দর্য থাকে না, কিন্তু মাথা থেকে ফেলে দিতে মায়া হয়।

পিনার, জিমালের অনুরোধ ফেলে দিতে পারেনি, একটা শপিং সেন্টারে সে দেখা করতে রাজি হয়। শেষ দেখা।

সেই শেষ দেখায় জিমাল ওকে বলে, ‘পিনার, তোমার মনে আছে? একবার ন্যাশনাল পার্কের ভেতর তুমি আমি অনেক দূর হেঁটে পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম? হিল জুতা পরে তুমি আর কিছুতেই গাড়ি পর্যন্ত হেঁটে ফেরত আসতে চাচ্ছিলে না, তখন আমি তোমাকে কোলে করে পুরোটা পথ হেঁটে গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছেছিলাম? আর পুরো সময় তোমাকে হিল পরার জন্য বকছিলাম।’

একটু থেমে জিমাল আবার বলে, ‘আমাদের দুজনের এত এত স্মৃতি আছে, তবু জানো এই স্মৃতিটা আমার খুব প্রিয়! তুমি কি শেষবারের মতো আমার সঙ্গে সেই পার্কে যাবে? এবারও যদি ফেরার পথে তোমার পা ব্যথা হয়, আর আমাকে যদি আবার তোমাকে কোলে করে গাড়ি পর্যন্ত নিয়ে যেতে হয়, কথা দিচ্ছি, তোমাকে আমি একটুও বকব না।’

সাবেকের কাছ থেকে এমন নাটকীয় অনুরোধ ফেলে দেওয়া যায় না। পিনারও ফেলে দিতে পারেনি। সে রাজি হয়ে যায়।

কী অদ্ভুত! এবারও জিমাল পিনারকে কোলে করে পার্ক থেকে গাড়ি পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিল। তবে পার্থক্যটা হলো, এবার তার কোলে ছিল পিনারের নিথর দেহ।

ন্যাশনাল পার্কের অনেক ভেতরে, গহিন জঙ্গলের মাঝে জিমাল আধা ঘণ্টা ধরে পিনারকে এলোপাতাড়ি ভাবে মারে। যত জিদ, হতাশা সব মিটিয়ে সে পিনারকে পেটায়। হাত দিয়ে পেটায়, গাছের ডাল দিয়ে পেটায়।

পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে পিনারেই একমাত্র পড়াশোনায় এগিয়ে ছিল। ওর ইচ্ছা ছিল গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেই সে মেয়রের অফিসে কাজ নেবে। ওর স্বপ্ন ছিল সে তার শহরের মেয়র হবে। এত বড় স্বপ্ন যার আছে, তার খুব সাহসী হওয়ার কথা। তাকে এত সহজেই বোধ হয় মেরে ফেলা যাচ্ছিল না। আধা ঘণ্টা ধরে, পেটানোর পরও যখন পিনার মরেনি, তখন পিনারের গলার স্কার্ফ দিয়েই পিনারকে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করে জিমাল।

তারপর জঙ্গলের বাইরে এক ডাস্টবিনে পিনারের লাশকে সে পুরোপুরি আগুনে পুড়িয়ে বাসায় ফিরে যায়।

লেখক।
লেখক।

২.
নাদিয়া ঘুম থেকে উঠেই কফির মগ আর পত্রিকা নিয়ে বারান্দায় বসে। পত্রিকার প্রথম পাতায় পিনারের সাদা–কালো ছবি। পিনারের লাশ পাওয়া গেছে এবং খুনি জিমাল তার পূর্ণ জবানবন্দি দিয়েছে।

নাদিয়া একজন অ্যাকটিভিস্ট, নারী স্বাধীনতা নিয়ে সোশ্যাল এবং স্ট্রিম মিডিয়ায় নানা কাজ করে। তার খুব কাছের বন্ধু সিবেলের বড় বোন ছিল পিনার।

কদিন ধরেই সিবেলের সঙ্গে নাদিয়া পিনারকে খুঁজছিল। সোশ্যাল মিডিয়ায় মিসিং পারসন পোস্টসহ, পুলিশের কাছে যাওয়া, রিপোর্ট লেখানো ইত্যাদি বিষয়ে সে তার বন্ধু সিবেলের পাশে ছিল।

আর আজ সকালের পত্রিকায় পিনারের সাদা–কালো ছবি...

নাদিয়ার খুব রাগ হয়, ভীষণ রাগ হয়। কেন মেয়েদের এভাবে মরে যেতে হবে পুরুষের জেদের কাছে? কেন ধুম করে একটি মেয়ের রঙিন ছবি, পত্রিকার সাদা–কালো ছবি হয়ে যেতে হবে?

নাদিয়া সোশ্যাল মিডিয়ায় এই ঘটনার প্রতীকী প্রতিবাদ শুরু করে এবং দুই সপ্তাহের মাঝেই প্রায় ৭ মিলিয়ন মেয়ে তাদের সাদা–কালো ছবি পোস্ট করে হ্যাশট্যাগ করে # চ্যালেঞ্জ_একসেপ্টেড।

শুরু হয় চ্যালেঞ্জ একসেপ্টেড ট্রেন্ড!

পত্রিকায় সাদা–কালো হয়ে যাওয়া ছবির মেয়েগুলোর সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশে, আমরা যারা বেঁচে আছি, তাদের একটা ছবি সাদা–কালো করে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিবাদ করার ট্রেন্ড!

ছবি সাদা–কালো হওয়ার জন্য মরে যেতে হবে কেন? আমরা যারা এই সমাজে প্রতিদিন একবার করে মরি, তাদের ছবিও সবার সামনে সাদা–কালো করে তুলে ধরার ট্রেন্ড!

আমরা নারীরা সবাই হয়তো আলাদা, কিন্তু আমাদের ‘সাদা–কালো’ ব্যথার জায়গাগুলো প্রায় একই রকম!

পুনশ্চ: নাদিয়া নামটি কাল্পনিক! এত পপুলারিটির জন্য হোক কিংবা পুরুষশাসিত সমাজে এত বড় একটা মুভমেন্ট করার জন্যই হোক, এই মেয়েটির নাম মিডিয়া থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে!

*লেখক: সাইকোলজিক্যাল ইনজুরি ম্যানেজমেন্ট কাউন্সেলর, অস্ট্রেলিয়ান ফেডারেল কোর্ট, ক্যানবেরা।