সি চিনের নেতৃত্ব দারিদ্র্য বিমোচনে আদর্শ

চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং।
ফাইল ছবি।

বিশ্বের সব দেশ বিশেষ করে স্বল্পোন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশ দারিদ্র্য নিয়ে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। দারিদ্র্য দূরীকরণ দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ব সম্প্রদায়ের জন্য একটি স্থায়ী চ্যালেঞ্জ। চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাসকারী লোকেরা খাদ্য, নিরাপদ পানীয় জল, স্যানিটেশন, স্বাস্থ্য, আশ্রয়, শিক্ষাসহ মৌলিক মানবিক চাহিদা থেকে মারাত্মক বঞ্চনার শিকার হয়।

জাতিসংঘের সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য (এমডিজি) এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) উভয়ই তাদের শীর্ষস্থানীয় অগ্রাধিকার হিসেবে দারিদ্র্য ও ক্ষুধাকে শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। নিজস্ব আধুনিকায়নের প্রয়াসেই হোক বা জাতিসংঘের এমডিজি এবং এসডিজি বাস্তবায়নে চীন সরকার সর্বদা দারিদ্র্য সমস্যাগুলোতে উচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছে এবং দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য সক্রিয়ভাবে কাজ করেছে।

চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং এই বছর ২২ ফেব্রুয়ারি বেইজিংয়ে একটি অনুষ্ঠানে চীনে গ্রামীণ দারিদ্র্য দূরীকরণের অভিযানে ‘সম্পূর্ণ বিজয়’ ঘোষণা করেন। মোট ৮৩২টি কাউন্টি, ১ লাখ ২৮ হাজার গ্রাম এবং প্রায় ১০০ মিলিয়ন মানুষ দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করছিল। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে তিনি বলেছিলেন, তাঁর নেতৃত্ব প্রায় ১০০ মিলিয়ন মানুষের দৈনিক আয় ২.২০ মার্কিন ডলারে উন্নীত করেছেন। ২০১৩ সালে প্রেসিডেন্ট সি দারিদ্র্য নির্মূলের প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পর ২০২০ সালের মধ্যে চরম পল্লি দারিদ্র্য নির্মূল করার মাধ্যমে এই অর্জনটি এসেছে। তবে, সরকারিভাবে দারিদ্র্য থেকে দূরে সরে যাওয়ার ঘোষণা করার পরও কেউ কেউ গ্রামাঞ্চলে পিছিয়ে রয়েছেন, যার সংখ্যা খুবই সামান্য।

চীনের জন্য দারিদ্র্য বিমোচন একটি রাজনৈতিক আবশ্যকীয় কর্মসূচি ছিল। ৭০ বছরের বেশি সময় ধরে চীন দারিদ্র্য হ্রাসের পথে অবিচ্ছিন্নভাবে এগিয়ে চলেছে। চীনের দারিদ্র্য বিমোচনের প্রচেষ্টা চীনের মহান নেতা তং শিয়াওপিং যুগের পর থেকে সরকারের সর্বোচ্চ স্তরের রাজনৈতিক সমর্থন পেয়েছে। ১৯৭৮ সালে সংস্কার ও ওপেন আপ শুরু হওয়ার চার দশক ধরে চীন ৮৫০ মিলিয়ন মানুষকে দারিদ্র্য থেকে দূরে নিয়েছে। বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়া (বিএফএ) কর্তৃক ১৫ ডিসেম্বর প্রকাশিত এশিয়া দারিদ্র্য হ্রাস প্রতিবেদন ২০২০ অনুসারে, বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্য নিরসনে এশিয়া অঞ্চল একটি বিশেষ অবদান রাখছে। বিশেষত পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো ১৯৯০ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্য হ্রাসের জন্য নেতৃত্ব দিচ্ছে, যেখানে চীন দারিদ্র্য নিরসনের জন্য একটি বড় অবদানকারী দেশ।

২০১২ সালের নভেম্বরে সি চিন পিং চীনের শীর্ষ নেতা নির্বাচিত হন। চীন প্রজন্ম ধরে নতুন প্রজন্মের জন্য নিরঙ্কুশ দারিদ্র্য দূরীকরণ অর্জন করার জন্য যে চেষ্টা করে আসছিল, চিন পিং ক্ষমতা গ্রহণের পর দারিদ্র্য বিমোচনকে শীর্ষ নীতি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেন। ২০১৩ সালের নভেম্বর মাসে সি চিন পিং মধ্য চীনের হুনান প্রদেশ শিয়াংশি এলাকা পরিদর্শনের জন্য গিয়েছিলেন। পরিদর্শনের সময় চীনা প্রেসিডেন্ট প্রথম ‘লক্ষ্যযুক্ত দারিদ্র্য বিমোচন’-এর ধারণাটি উত্থাপন করেছিলেন। সির নেতৃত্বে চীনা সরকারের অন্যতম কেন্দ্রীয় লক্ষ্য ছিল দারিদ্র্য বিমোচন। প্রেসিডেন্ট সি দারিদ্র্য হ্রাসের জন্য যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল তার প্রভাব প্রতিটি পরিবার ও ব্যক্তিদের ওপর পড়ছে কি না, তা যাচাই করতে স্থানীয় সরকারকে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলেছিলেন।
২০১৫ সালের শেষ দিকে চীন সরকার ২০২১ সালে সিপিসি প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ উদযাপনের আগে অর্থাৎ ২০২০ সালের মধ্যে দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল। প্রেসিডেন্ট সির প্রশাসনের অধীনে ১৩তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার কর্মসূচির লক্ষ্য সফলভাবে অর্জিত হয়েছে। দারিদ্র্য বিমোচন স্থানান্তর প্রকল্পের লক্ষ্য হলো দরিদ্র লোকদের আশ্রয়যোগ্য অঞ্চলে স্থানান্তর করা। চীন ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রায় ১ কোটি দরিদ্র মানুষকে আশ্রয়যোগ্য অঞ্চলে সরিয়ে নিয়েছে, যা বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্য হ্রাস চেষ্টার একটি অন্যতম উদাহরণ।

চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং।
এএফপি ফাইল ছবি।

চীন সরকার ২০১৬ সালে ৭ লাখ ৭৫ হাজার কর্মকর্তাকে এক থেকে তিন বছরের জন্য গ্রামাঞ্চলগুলোতে প্রেরণ করেছে। সেখানে তারা দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য কাজ করেছেন। ১৩তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সময়কালে (২০১৬-২০২০) চীন দরিদ্র মানুষের পুনর্বাসনের জন্য আবাসন নির্মাণে প্রায় ৬০০ বিলিয়ন চাইনিজ মুদ্রা (ইউয়ান) বিনিয়োগ করেছে। প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ২০২০ সালের এপ্রিলে চীনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের শানশি প্রদেশের আনখাং এলাকা পরিদর্শনে সময় বলেছিলেন, ‘আমি এই বছর দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্য অর্জনে আত্মবিশ্বাসী।’

প্রেসিডেন্ট সি জোর দিয়ে বলেছেন, লক্ষ্যযুক্ত দারিদ্র্য বিমোচনের কৌশলটি পাঁচটি ব্যাচের নীতি অনুসরণ করা উচিত (শিল্প বিকাশ, স্থানান্তর, ইকো-কম্পেনসেশন, শিক্ষা এবং সামাজিক সুরক্ষা) এবং সাতটি প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতি স্থাপন করা (নিবন্ধীকরণ, নীতি, বিনিয়োগ, সহায়তা, সামাজিক সংহতি, বহু চ্যানেল, সামগ্রিক তদারকি এবং পদ্ধতির মূল্যায়ন)।

চীন বিশ্বের অন্য দেশগুলোকেও অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং দারিদ্র্য হ্রাসে সহায়তা করে যাচ্ছে। বিগত বছরগুলোতে চীন ১৭০ টির বেশি দেশকে ৫৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি আর্থিক সহায়তা দিয়েছে। ২০১৫ সালে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং চীন-আফ্রিকা সহযোগিতা বিষয়ক জোহানেসবার্গ সম্মেলনে অংশ নেওয়ার সময় ঘোষণা করেন, চীন আফ্রিকার দারিদ্র্য নিরসন পরিকল্পনাসহ দশটি বড় সহযোগিতা পরিকল্পনা গ্রহণ করবে। চীন আফ্রিকায় ২০০ ‘হ্যাপি লাইফ’ প্রকল্প এবং দারিদ্র্য নিরসনের মূল কর্মসূচি গ্রহণ করবে যেখানে মূল সুবিধাভোগী হিসেবে মহিলা ও শিশুরা থাকবে। ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ওয়ার্ল্ড হেলথ অ্যাসেম্বলির (ডাব্লিউএইচএ) ৭৩তম অধিবেশন উদ্বোধনের সময় প্রেসিডেন্ট সি ঘোষণা দেন, চীন কোভিড-১৯ এর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোতে বিশেষত উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে সহায়তা করতে দুই বছরের মধ্যে দুই বিলিয়ন মার্কিন ডলার সরবরাহ করবে।

গত বছরের গোড়ার দিকে মহামারি করোনভাইরাসের কারণে চীনের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, কিন্তু এরপরও যোগ্য নেতৃত্বের কারণে চীনের অর্থনীতি পুনরুদ্ধার স্থির হয়েছে। সম্পূর্ণভাবে দারিদ্র্য দূরীকরণ চীনের এক ঐতিহাসিক সাফল্য অর্জন করেছে। ১৪০ কোটি জনসংখ্যার দেশে দারিদ্র্য দূরীকরণকে খুব উচ্চাভিলাষী মনে হতে পারে বা পশ্চিমা সমালোচকদের পক্ষে এটি অসম্ভব মিশন হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। তবে এটি একটি মিশন যা অবশ্যই চীনকে অর্জন করতে হতো, কারণ পারস্পরিক সমৃদ্ধি অর্জনই চীনের সমাজতন্ত্রের লক্ষ্য। দারিদ্র্য দূরীকরণে জনগণকে প্রথমে রাখার দর্শন নিয়ে চায়না কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিসি) সদস্যরা এবং সব স্তরের সরকারি কর্মকর্তারা সমাজের দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য একাত্মক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।

তবে সব শেষ এ কথা বলতে চাই, চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের নেতৃত্বে দারিদ্র্য বিমোচনে লাখো দরিদ্র মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর পাশাপাশি অনুপ্রেরণা জাগিয়ে তোলার জন্য চীন সত্যই চ্যাম্পিয়ন। বিশ্ব নেতারা যদি পৃথিবী থেকে লাখো মানুষকে চূড়ান্তভাবে দারিদ্র্য থেকে উন্নত জীবনযাপনের জন্য উদ্যোগী হন, তাঁরা চীনের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারেন। দারিদ্র্য বিমোচনে চীনের মডেল ভাগ করে নেওয়ার পাশাপাশি নতুন আকাঙ্ক্ষা এবং নতুন ধারণার মাধ্যমে এটিকে আরও উন্নত করতে পারেন।

*লেখক: মোহাম্মদ ছাইয়েদুল ইসলাম, চীনের চিয়াংশি ইউনিভার্সিটি অব ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইকোনমিকস বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড অ্যান্ড ইকোনমিকসের একজন ডক্টরাল ফেলো