সিডনির মাতৃভাষা সৌধ নিয়ে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য

সিডনিতে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক ভাষাশহীদ স্তম্ভ
ছবি: সংগৃহীত

অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে নবনির্মিত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা সৌধ নিয়ে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য চলছে দেশটিতে বসবাসরত বাংলাদেশিদের মধ্যে। নতুন সৌধটির নকশা অমর একুশের গুরুত্ব প্রতিফলন করে কি না, এমন মতভেদের ভিত্তিতে সিডনির স্থানীয় বাংলাদেশিদের মধ্যে বিভাজন ছড়িয়ে পড়েছে। এ নিয়ে গতকাল শনিবার একদিকে সৌধ প্রাঙ্গণে চা-চক্রের আয়োজন করে সৌধটির নির্মাণে বাংলাদেশি কমিউনিটির উদ্যোক্তা পক্ষ। অন্যদিকে সিডনির ল্যাকেম্বার রেলওয়ে প্যারাডে মানববন্ধন করে সৌধটির নকশা নিয়ে ক্ষুব্ধপক্ষ।

যদিও ক্ষুব্ধপক্ষটি মানববন্ধনের আহ্বান জানিয়ে হঠাৎ গত শুক্রবার বাতিলের ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু নতুন শহীদ মিনারের দাবি জানিয়ে মানববন্ধন কর্মসূচি অব্যাহত রাখেন ল্যাকেম্বা এলাকায় বসবাসরত তরুণ বাংলাদেশিরা। মানববন্ধন কর্মসূচি কেন করলেন, এ প্রশ্নের জবাবে কর্মসূচি অব্যাহত রাখা তরুণদের একজন ফখরুল আলম রিয়া বলেন, ‘আমাদের ল্যাকেম্বার তরুণ  সমাজের একটাই দাবি, আমরা শহীদ মিনার চাই। এই স্মৃতিস্তম্ভ চাই না। কারণ, এই স্তম্ভ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসকে বহন  করে না।’

অন্যদিকে সৌধ প্রাঙ্গণে চা-চক্রের আয়োজন করেন সৌধটির নির্মাণ প্রকল্পের কমিউনিটি উদ্যোক্তারা। এ আয়োজনে নতুন সৌধটি নিয়ে সৃষ্ট বিতর্কের নানা প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হয়। সৌধটির নকশা প্রসঙ্গে বলা হয়, প্রাথমিক নকশা প্রস্তাব করার সময়ই নকশাটির সম্ভাব্য পরিবর্তনের কথা ছিল। পরবর্তী সময়ে নকশা পরিবর্তন করা হলে করোনাভাইরাসের কারণে লকডাউন, চলমান স্বাস্থ্যবিধি এবং ২১ ফেব্রুয়ারি উদ্বোধনের তাগদায় সবাইকে বিষয়টি অবহিত করা সম্ভব হয়নি বলে জানান উদ্যোক্তারা। এ ছাড়া সৌধটি নির্মাণের ব্যয় নিয়ে বলে হয়, পুরো নির্মাণ প্রকল্পে ৪৫ হাজার অস্ট্রেলীয় ডলার ব্যয় হয়েছে, যার ৩৬ হাজার ডলার এসেছে বাংলাদেশিদের দেওয়া তহবিল থেকে এবং বাকি ৯ হাজার ডলার ক্যান্টারবারি-ব্যাংকসটাউন সিটি কাউন্সিল থেকে। নির্মাণ প্রকল্পটি কাউন্সিলের সার্বিক তত্ত্বাবধানে করা হয়েছে বলেও নিশ্চিত করা হয়। বর্তমানে সৌধটি কাউন্সিলের সম্পত্তি বলেও উল্লেখ করা হয় অনুষ্ঠানে।

মানববন্ধনের একাংশ
ছবি: সংগৃহীত

নতুন শহীদ মিনার নির্মাণ প্রসঙ্গে বলা হয়, সৌধটি নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেওয়ার পর কাউন্সিলের কাছে আবেদন করা হলে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করার অনুমতি দেওয়া হয়। একই প্রক্রিয়ায় শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য কাউন্সিল বরাবর আবেদন করার পরামর্শ দিয়েছেন ক্যান্টারবারি-ব্যাংকসটাউন সিটি কাউন্সিলের বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বর্তমান কাউন্সিলর নাজমুল হুদা। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা কোনো ভুল করেনি। কাউন্সিল কর্তৃপক্ষের ডিজাইন কমিটি এবং বাংলাদেশের সিডনি কনস্যুলেট জেনারেল অফিসের প্রতিনিধিদের অনুমোদিত ডিজাইনে এখানকার বহুজাতিক সমাজের জন্য এই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা সৌধটি নির্মাণ হয়েছে। তবে তরুণেরা যাঁরা ল্যাকেম্বায় মানববন্ধন করেছেন, তাঁদের সঙ্গে আমরাও চাই ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের আদলে একটি শহীদ মিনার হোক সিডনিতে।’

সৌধ প্রাঙ্গণে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন উদ্যোক্তারা
ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশি কমিউনিটির পক্ষ থেকে যে কয়েকজন এই উদ্যোগে সম্পৃক্ত ছিলেন তাঁদের একজন মুনির বিশ্বাস। তিনি বলেন, যেহেতু ক্যান্টারবারি-ব্যাংকসটাউন সিটি কাউন্সিলের তত্ত্বাবধানে সৌধটি নির্মাণ হয়েছে, সেহেতু যে কয়েকজন সৌধটি নির্মাণের প্রস্তাব, কমিউনিটি থেকে তহবিল সংগ্রহ এবং লিয়াজোঁ করেছিলাম, তাঁরা কেউ-ই আর কাউন্সিলের ভেতরের কাজে যুক্ত থাকার সুযোগ ছিল না। অন্যদিকে প্রাথমিক নকশা প্রস্তাব করার সময়ই নকশাটির সম্ভাব্য পরিবর্তনের কথা আলোচনা হয়েছিল। পরে কাউন্সিল তাদের গাইডলাইন অনুসারে এই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা সৌধ নির্মাণ করেছে, যেখানে বাংলাদেশের অনেক কিছুই প্রাধান্য পেয়েছে। কাউন্সিল কিন্তু শহীদ মিনার করেনি এবং করার কথাও ছিল না। তারা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা সৌধ করতে চেয়েছে এবং তা–ই করেছে। আমরা যদি শহীদ মিনার করতে চাই, তাহলে নতুন করে উদ্যোগ নিতে পারি।’

তবে সৌধ নিয়ে বাংলাদেশিদের মধ্যে এই বিভাজনকে ‘নিজের গায়ে কাদা ছোড়া’ বলে মনে করছেন অনেকে। সিডনিপ্রবাসী মুক্তিযোদ্ধা ও চলচ্চিত্র নির্মাতা গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘অমর একুশের প্রতীক আমাদের আবেগ-অনুভূতির অংশ হলেও, এ বিষয় নিয়ে নিজেদের মধ্যে এমন প্রকাশ্যে কাদা–ছোড়াছুড়ি করা উচিত নয়। কেননা, এতে ভবিষ্যতে আমরা স্থানীয় কাউন্সিলের কাছে বিভক্ত জাতি হিসেবে পরিচিত হব। আমাদের ন্যায্য দাবিগুলোও তখন মূলহীন হবে এবং মূলধারার নেতৃস্থানীয় পর্যায়ে বিষয়টি নিয়ে একটি বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে।’

গত ২১ ফেব্রুয়ারি ক্যান্টারবারি-ব্যাংকসটাউন সিটি কাউন্সিলের তত্ত্বাবধানে সিডনির বাঙালিপাড়াখ্যাত ল্যাকেম্বার নিকটবর্তী বেলমোরের পিল পার্কে উদ্বোধন করা হয় এই নতুন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা সৌধটি। এর আগে ২০০৬ সালে সিডনির অ্যাশফিল্ড পার্কে বাংলাদেশিদের উদ্যোগে দেশটিতে প্রথম আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস সৌধ নির্মিত হয়। পিল পার্কের নতুন এ মাতৃভাষা সৌধের নকশায় একজন মা ও ডানে-বাঁয়ে তাঁর দুই সন্তানকে আগলে রেখেছেন এবং ওপরে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকাসদৃশ প্রতীক রয়েছে। পেছনে রয়েছে বাংলাসহ অন্য কিছু ভাষার কথা।