সিমপ্যাথি বা সহমর্মিতা

ওপরের শিরোনাম ‘সিমপ্যাথি’ দেখে হয়তো অনেকে ভ্রু কুঁচকাতে পারেন। আমরা অনেক সময় অনেক বিদেশি শব্দকে মুখরোচক করে নিই। কেউ ব্যথা বা দুঃখ কিংবা মারা গেছেন তখন তাকে বা মৃতের আত্মীয়কে সহমর্মিতা বলা ‘সমবেদনা’ জানাতে গিয়ে কথায় কথায় বলে ফেলেন ‘সিমপ্যাথি’ জানিয়েছি। ‘সিমপ্যাথি’ শব্দটি ইংরেজি ভাষায় হলেও শব্দটি বাঙালিদের মুখে প্রায়ই শোনা যায়। শিক্ষিত-অশিক্ষিত প্রায় সবাই সমবেদনা শব্দ ব্যবহার না করে সিমপ্যাথি শব্দ ব্যবহার করে। তবে লেখার ক্ষেত্রে সহমর্মিতা বা সমবেদনা শব্দটি ব্যবহার করা হয়। এ ক্ষেত্রে দ্বিরুক্তি শোনা যায় না, এটি সর্বজনগ্রাহ্য হয়ে গেছে।

গত সোমবার সন্ধ্যায় গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে স্যাঁতসেঁতে রাস্তায় প্রয়োজনীয় কাজে যাওয়ার সময় পথে সামনের অন্য গাড়ির লাইট আমার মোটরসাইকেলের গ্লাসে (বাতাস হতে রক্ষার জন্য সামনে গ্লাস সংযোজন) লেগে বৃষ্টির পানির সঙ্গে প্রতিফলন হচ্ছে। বিধায় সামনে চলতে অসুবিধা হয়, চোখেও প্রতিবিম্ব দেখায় এবং রাস্তাও পিচ্ছিল হওয়ায় মোটরসাইকেল ধীরগতিতে চালালেও চাকা পিছলে রাস্তার আইল্যান্ডে ধাক্কা লেগে পড়ে যাই এবং সম্ভবত একটু জোরে শব্দ হয়। আমি কিন্তু রাস্তায় হাত লাগিয়ে দাঁড়িয়ে যাই। সন্ধ্যা সোয়া সাতটার ঘটনা। এরই মধ্যে এক তরুণী সড়ক অতিক্রম করে এসে আমার হাত ধরে বলেন, ‘আপনি ঠিক আছেন? কোনো সাহায্য প্রয়োজন?হাসপাতালে নিতে হবে?’ উপর্যুপরি বেশ কয়েকটি প্রশ্ন। এর ফাঁকে মোটরসাইকেল কাত হয়ে পড়া থেকে দাঁড় করালাম। অন্য তরুণী ফুটপাত থেকে বলে ওঠেন, এখানে বা রাস্তা থেকে ফুটপাতে আসা মোটরসাইকেল নিয়ে দোকানের বারান্দায় বসেন কিছুক্ষণ। আমি বললাম, আমি ঠিক আছি, মোটরসাইকেলও ঠিক আছে, অসুবিধা হয়নি, অনেক ধন্যবাদ তোমাদের।

খেয়াল করলাম দোকানের মালপত্র গোছানোর সময় কিংবা দোকান বন্ধ করতে দরজা টানতে বাইরে এলে মোটরসাইকেল পড়ার শব্দ পেয়ে ওরা উদ্ধার করতে আসে বা সিমপ্যাথি বা সমবেদনা জানাতে। আমি গন্তব্যে যাওয়ার সময় হাতে চাপ দিয়ে স্টার্ট নিতে গেলে স্টার্ট হচ্ছে না দেখলাম। পরে প্যাডেলে পা দিয়ে চাপ দিতে গেলে দেখি প্যাডেল যেন আটকে আছে। প্যাডেলকে হাতে জোরে টেনে ঠিকমতো করে পায়ে চাপ দিলেও স্টার্ট হয় না দেখে হাতে স্টার্টের সুইচ টিপে এবং পায়ে প্যাডেলে চাপ দিলে মোটরসাইকেল স্টার্ট নেয়। স্টার্ট নিয়ে দুই থেকে তিন মিনিট রেখে দিলাম। এদিকে মেয়ে দুটো বলল, স্টার্টে রেখে দিয়ে দেখো স্টার্ট থাকে কি না। ওদের বললাম, ঠিক আছে, আবারও ধন্যবাদ জানালাম ওদের এবং গন্তব্যে চলে এলাম। ঘণ্টা দুয়েক পর প্রয়োজনীয় কাজ সেরে আসার সময় দেখি স্টার্ট হয় না। প্যাডেলের সঙ্গে ইঞ্জিন যেন ভেতরে আটকে আছে। আমি মোটরসাইকেল টেনে বাসায় আসতে চাইলে আফ্রিকার বন্ধু শোয়াইব সিমপ্যাথি বা দরদ জানিয়ে বলেন, এ বৃষ্টিতে বাসায় না গিয়ে তার বাসায় খালি বিছানা আছে, ওখানে রাত যাপন করে সকালে বাসায় আসতে। আমি বাসায় চলে যাব, হেঁটে হলেও জেনে সে তার বাইসাইকেল নিয়ে বাসায় আসতে বলে।

মোটরসাইকেল পাশের বিল্ডিংয়ের (মসজিদসংলগ্ন) পার্কিংয়ে রেখে রাত নয়টার পর আফ্রিকান (বেনিন) বন্ধু শোয়াইব তাঁর দেওয়া বাইসাইকেলে প্রায় সাত কিলোমিটার দূরে বাসায় আসি। পরদিন প্রতিবেশী মরক্কোর বংশোদ্ভূত প্রবাসী বন্ধু ফুয়াদ কেসাসীর ট্যাক্সির পেছনে সাইকেল ঢুকিয়ে আমি সামনের সিটে বসে মোটরসাইকেলের হেনস্তা করার জন্য যাই। বন্ধু ফুয়াদ হাতে টেনে দৌড়ে এসে চেষ্টা করলেও স্টার্ট হয় না। তাঁর সিমপ্যাথি দেখে আমি অবাক। আশপাশে কোনো মেকানিকও নেই। আবার বিকেলে আমার জব। অগত্যা মোটরসাইকেল পূর্বের পার্কিংয়ে রেখে চলে আসি। আজ শুক্রবার পৌনে ১২টায় ট্রেনে মোটরসাইকেলের একটি বিহিত করার জন্য যাই। মোটরসাইকেল নিয়ে টেনে টেনে তিন কিলোমিটার দূরে আসার সময় পথে বেশ কয়েকজন প্রবাসী গাড়ি থেকে হর্ন দিয়ে সিমপ্যাথি জানায়। প্রবাসীরা প্রবাসীদের দুঃখ বোঝে। কারণ ওই দুঃখে ওরাও ভুক্তভোগী।

প্রায় ঘণ্টাখানেক অপেক্ষার পর মেকানিক তিনটার দিকে অফিসিনায় বা গ্যারেজে (গাড়ির কারখানাকে অফিসিনা বলা হয়) আসেন। বলেন ইঞ্জিন খুলে দেখতে হবে কী হয়েছে, সময় প্রয়োজন। গ্যারেজের (মোটরসাইকেলের শোরুম) মালিক আমার ফোন নিয়ে বলেন, কী করতে হবে সোমবারের পর জানাবেন। আমিও ওর ফোন নম্বর নিয়ে হেঁটে বাসার দিকে রওনা হলাম। পথে পরিচিত কয়েকজন আবারও গাড়ির ভেতর থেকে সিমপ্যাথি জানিয়ে হর্ন বাজিয়ে চলে যায়। একটি পেট্রল স্টেশনের সামনে দিয়ে আসার সময় মাস্ক পরা একজন সালাম দেন। সালামের জবাব দিতে গিয়ে দেখি উনি আমার কাছে আসছেন এবং জানতে চাইছেন মসজিদে জুমার জামাত হচ্ছে কি না।

তাঁকে ইতালিয়ান ভাষায় বললাম, পাঁচ ওয়াক্তের নামাজের জামাত হয় কিন্তু জুমার জামাত করোনা প্রাদুর্ভাবের অসুবিধায় আয়োজন করা যাচ্ছে না। কিন্তু মসজিদে জুমার জামাতের বদলে জোহরের নামাজের জামাত হয়। উল্লেখ্য, মসজিদের সঙ্গে সম্পৃক্ত আছি জেনে অনেকে দেখা হলেই নামাজের জামাতের সময়সূচি জানতে চান। এখানে (Giussano,, Italy বা আশপাশের এলাকায়) অনেক আরবিভাষী যেমন মরক্কো, মিসর, সিরিয়া, লিবিয়া, জর্ডান, তিউনিসিয়া, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ভারত, শ্রীলঙ্কা, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ ব্রাজিল বা দক্ষিণ আমেরিকার অনেক প্রবাসী আছেন। যাঁরা নিজস্ব ধর্ম ও সংস্কৃতির চর্চা ও লালন–পালন করে থাকেন। সে হিসেবে প্রবাসীদের সঙ্গে প্রবাসীদের একটি আত্মিক সম্পর্ক সব সময় লক্ষ করা যায়। বিভিন্ন দেশের প্রবাসী বিভিন্ন জাতিতে হলেও ধর্মীয়ভাবে সবাই একই কেন্দ্রে মিলিত হয়, যেমন মসজিদ। ফলে বিদেশি প্রবাসীদের পরস্পর সম্পর্ক লক্ষ করার মতো। আগেই বলেছি স্থানীয় মসজিদের সঙ্গে সম্পর্ক আছে বিধায় অনেকের পরিচিত হয়। কিন্তু করোনাকালে মুখে মাস্ক থাকায় পথিমধ্যে কেউ কাউকে ভালোমতো চেনা হয় না। পেট্রলপাম্পের পাশের লোকটা মাস্ক পরিহিত হলেও ভাষার ব্যবহারে অ্যারাবিয়ান মনে হলো। তিনি সিমপ্যাথি জানিয়ে জবাবে বলেন, এখানে পেট্রলপাম্প স্টেশনে কাজ করেন। বললেন তিনি জোসসনো মসজিদে নামাজের জামাত আদায় করেন, যা বলছিলাম সিমপ্যাথি বা সমবেদনা মানুষের মনুষ্যত্বের লক্ষ্মণ। অনুভব করা যায় কাজের মধ্যে। কয়েক বছর আগে এক নারীর গাড়ির ধাক্কায় আমার বাইসাইকেল থেকে পড়ে যাই। সাইকেলের কয়েকটি স্পোক বা কাটা ভেঙে যায়। নারী গাড়ি থেকে নেমে সামনে এসে আমাকে বলেন, সে রোমানিয়ান প্রবাসী, তুমিও প্রবাসী ওর ভুল হয়ে গেছে। তিনি বলেন, তাঁর শিশু এখন গাড়িতে কান্না করছে, ফলে সে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত, বিধায় আমার সাইকেলকে খেয়াল করেনি, তার অমন নরম বক্তব্যে বললাম, যাও, তুমি চলে যাও, এদিকে তার শিশুর কান্না গাড়ির ভেতর থেকে ভেসে আসছে। নারীকে আমিও সিমপ্যাথি জানিয়ে বিদায় দিলাম। পরিস্থিতির আলোকে অনেক সময় অনেকভাবে সিমপ্যাথি বা সহমর্মিতা জানাতে হয়। যেখানে জাত, ধর্ম, দেশ বাধা মানে না, মনুষ্যত্ব জেগে ওঠে সর্বাগ্রে। মানুষ মানুষের জন্য। সহমর্মিতা বা সিমপ্যাথি হোক সবার পাথেয়

—এখানেই কল্যাণ। সবার শুভকামনা। অভিমত দীর্ঘায়িত হওয়ায় দুঃখিত।