সেরাদের হারিয়ে স্বপ্নজয়ী গীতা-ববিতারাই সেরা

১.
বিট দ্য বেস্ট—সেরাদের হারাও। সেরাদের হারানোয় কী যে মজা, কী যে আনন্দ! জীবনকে আনন্দময় করতে স্বপ্ন দেখা, বাধাকে শক্ত হাতে মোকাবিলা করে লক্ষ্য ঠিক রাখা। লক্ষ্যে স্থির থেকে আত্মবিশ্বাসে ভর করে মেধা আর কঠোর পরিশ্রম দিয়ে স্বপ্নকে জয় করা। প্রতিযোগিতায় সেরাদের হারিয়ে স্বপ্নকে জয় করে আত্মবিশ্বাসী গীতা-ববিতারাই হয় সেরা। মেয়েসন্তান গীতা ও ববিতারা সব সমাজে নারী কুলের জয়গানের প্রতীক। শিক্ষায়, গবেষণায়, চিকিৎসায়, খেলাধুলায়, কর্মজীবনে, রাজনীতিতে—সবখানে আছে নারীরা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নারীরা অনেক বেশি এগিয়ে, অনেকে সেরাদেরও সেরা।
 
২.
গীতা ও ববিতা কুস্তিগির বাবা মহাবীর সিংয়ের দুই মেয়ে। কুস্তিতে (রেসলিং) জাতীয় চ্যাম্পিয়ন শক্তিবান পুরুষ এই মহাবীর। তাঁর সুঠাম দেহের শক্তি, সাহস আর কৌশল দিয়ে দেশব্যাপী প্রতিযোগীদের হারিয়ে নিজ জীবনে পেয়েছেন সম্মান। অর্থবিত্তের মালিক হতে পারেননি যদিও। অবশ্য বেশি দুঃখ নেই তাতে। অর্থাভাব আর বাবার কটাক্ষতে মহাবীর রেসলিং ছেড়ে সামান্য বেতনের চাকরি নেন। জাতীয় পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েও তিনি রেসলিং ছেড়ে দিলেন। কিন্তু তাঁর রক্তে মিশে থাকা রেসলিংয়ের স্বপ্ন তাঁকে ছাড়েনি। আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় সোনা জিতে নিজ দেশের পতাকা ওড়ানোর বড় স্বপ্ন সেটা। দেশের জন্য বড় সম্মান অর্জনের সে স্বপ্ন। মনের মধ্যে লালিত এ স্বপ্নকে জয় করতে তাঁর বিবাহিত গরিবি সংসারজীবনে তিনি ছেলের বাবা হতে চেয়েছেন। ছেলে পূরণ করবে সে স্বপ্ন।
কিন্তু ভাগ্যের লিখন, প্রথম সন্তান ছেলে হয়নি। তখন মেয়ে গীতার জন্ম হয়। মহাবীর অখুশি হননি এতে। তবে মনের অপূর্ণতাটা রয়ে গেল। ছেলেসন্তান লাভের উপায় বাতলে দিতে গ্রাম্য পরিবেশে প্রতিবেশী লোকজন অনেকেই বিশেষজ্ঞের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে তাঁর সংসারে বিভিন্ন পরামর্শ দিতে থাকলেন। শিক্ষাজীবনে বিভিন্ন পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের দিনে চিন্তিত ছাত্রদের মতো মহাবীরও আশায় থাকতেন পরের সন্তান ছেলে হবে। গ্রামে কথিত সেই বিশেষজ্ঞদের কোনো পরামর্শই কাজে আসেনি, ছেলেসন্তান হয়নি। দ্বিতীয় সন্তানও মেয়ে, নাম ববিতা। পরের দুজন সন্তানও হয় মেয়ে। ছেলেসন্তান না হওয়ায় দেশের জন্য সোনা জয়ের স্বপ্নটা কি তবে শেষ? নিরাশায় সোনা জয়ের লালিত স্বপ্নকে মহাবীর বাক্সবন্দী করলেন। রেসলিং গেম থেকে নিজেকে আগেই সরিয়েছেন, চার মেয়েসন্তানের বাবা হয়ে নিরাশায় আজ রেসলিং জগৎটাকেই ভুলে যেতে চান।
নাহ্‌, স্বপ্ন হারিয়ে যায়নি। ছেলেদের হারিয়ে মেয়েরাও জিততে পারে। স্কুলবয়সী গীতা ও ববিতা তাদের চলার পথে কোনো এক দিন প্রতিবেশী দুজন সমবয়সী ছেলের উত্ত্যক্ত বাক্যের বিনিময়ে তাদের প্রচণ্ড মার দিয়ে কাবু করেছিল। গীতা ও ববিতার শরীরে সাহসী কুস্তিগির বাবার রক্ত। সাহস দিয়ে সেদিন উত্ত্যক্তকারীদের পরাজিত করে নিজেদের বাঁচাতে পারলেও, পরক্ষণেই মা–বাবার কাছে পরাজিতদের নালিশ আসে। বিচারের মুখোমুখি হতে হয়। সব বিষয় জানতে পেরে বাবা মহাবীর মার খাওয়া ছেলেদের সেই পরিবারের কাছে অনুতপ্তের ভান করলেও তাঁর চোখে আসলে আনন্দের ঝিলিক বয়ে যায়। গীতা ও ববিতার প্রচণ্ড সাহসিকতায় বাবার চোখে এ আনন্দের ঝিলিক। ছেলেসন্তানের অভাবে রেসলিংয়ে দেশের জন্য সোনা জয়ের যে লালিত স্বপ্নকে তিনি ইতিপূর্বে বাক্সবন্দী করেছিলেন, গীতা ও ববিতার সাহস আজ তাঁকে সেই স্বপ্নপূরণের আশা আবার জাগিয়ে দিল। মেয়েরাই পারবে, দেশের জন্য বড় স্বপ্নকে জয় করতে।  

৩.
লালিত স্বপ্নকে বাস্তবতায় রূপ দিতে স্বপ্নবাজ বাবা তাঁর মেয়েদের সেভাবে তৈরির জন্য মনস্থির করলেন। কঠিন এ সিদ্ধান্ত—কঠোর হাতে দৃঢ়তার সঙ্গে এগোতে হবে। সব প্রতিযোগিতায় টিকে থেকে জয়কে ছিনিয়ে আনতে গীতা ও ববিতাকে রেসলার বানাবেন। কিন্তু এ সমাজে মেয়েরা রেসলিং খেলে না। তাই কঠিন এ পথ পাড়ি দিতে অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। নরম মনের মানুষ গীতা ও ববিতার মা নিজেও চান না তাঁর মেয়েরা সমাজের সচরাচর রীতিকে ডিঙাতে কঠিন এ পথে পা বাড়াক। গ্রাম্য সমাজে মানুষের চোখে শারীরিক ব্যায়াম, খেলাধুলা বিষয়গুলো যেন শুধু ছেলেদের জন্য। মেয়েরা এতে খুব বেমানান। মেয়েরা বড় হয়ে বউ হবে, সংসারে রান্নাবান্না আর ঘর গোছানোর কাজ করবে। জীবনসঙ্গী পেতে ছেলেরা দেখেবুঝে মেয়েদেরকে পছন্দ করে, মেয়েরা হয় বউ। স্বপ্নচারী বাবা মহাবীর চান, মেয়েদেরকে তিনি এমনভাবে তৈরি করবেন, যাতে তাঁর মেয়েরা দেখেবুঝে নিজেদের জন্য উপযুক্ত স্বামী খুঁজবে, ছেলেরা হবে স্বামী।
জীবনযুদ্ধে সংগ্রাম করে বীরের মতো টিকে থাকতে মেয়েদের উপযুক্ত করে তৈরি করতে হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজের শুরু। নিয়মমাফিক খুব সকালে ঘুম থেকে ওঠা, দৌড়ানো, ব্যায়াম, ইত্যাদি চলে। স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর ঝালযুক্ত, তৈলাক্ত, মিষ্টিকর খাবার শেষবারের মতো খাওয়ানো হয়েছে পরিকল্পনার প্রথম দিনে। লেখাপড়ার পাশাপাশি প্রাত্যহিক কঠোর নিয়মে স্বাস্থ্যসচেতনতা মেনে চলা। এলাকায় মেয়েদের রেসলিং প্রচলন না থাকায়, ছেলেদের রেসলিং মাঠেই গীতা ও ববিতাকে অনুশীলন করাতে বাবা সাহায্য চেয়ে ব্যর্থ হলেন। তাই নিজের ফসলি জমিতেই তৈরি হলো মেয়েদের রেসলিং অনুশীলনের জন্য ব্যবস্থা। সমাজের প্রচলিত রীতিনীতিকে টপকিয়ে, কুসংস্কার, প্রচণ্ড বাধা, অসহযোগিতাকে উপেক্ষা করে লক্ষ্যের পথে এগিয়ে যাওয়া।

৪.
স্কুলবয়সী কচি মেয়ে গীতা ও ববিতা। এ বয়সে টিভি দেখা, খেলাধুলা, ছোটাছুটি এসবই বেশি পছন্দ। ধরাবাঁধা নিয়মে জীবনকে বেঁধে ফেলার বয়স এটা নয়। বাবা মহাবীরের ইচ্ছায় শক্ত নিয়মকানুনের মধ্যে বেড়ে ওঠা এখন তাদের বেশ কষ্টকরই মনে হচ্ছে। এসব তাদের অপছন্দ। প্রতিবেশী দুজন ছেলেকে সেদিন উত্তম-মাধ্যম দেওয়াটাই যেন বড় ভুল ছিল, নইলে বাবা এত কঠোর নিয়ম জারি করতেন না। প্রতিনিয়ত বিভিন্ন কৌশলে ধরাবাঁধা এ কঠোর নিয়ম থেকে মুক্তির উপায় খুঁজে এ মেয়েরা।
মুক্তির উপায় পেতে মেয়েরা বলে, সালোয়ার-কামিজ পরে দৌড়ানো কঠিন। কিন্তু স্বপ্নের পথে এদেরকে ধরে রাখতে বাবা সহজ উপায় বের করেন। সালোয়ার-কামিজের পরিবর্তে আসে টিশার্ট-হাফ প্যান্ট। মাথায় লম্বা চুলের বাহানায় চুল ছেঁটে ছোট করে দেওয়া হয়। খুব সকালে ঘুম না ভাঙাতে ঘড়ির অ্যালার্ম বন্ধ করা, অনুশীলনের জায়গায় ইলেকট্রিক বাতি নষ্ট করে দেওয়া, রেসলিং অনুশীলনে নিজেদেরকে দুর্বল দেখানো, ক্লান্তিতে স্কুলের পড়ায় ক্ষতির কারণ দেখানো ইত্যাদি কোনো ছুতাই বাবার দৃঢ়তাকে দমানো যায়নি। বাবার এ কঠোরতায় মেয়েরা অতিষ্ঠ, বেশ অসন্তোষ্ট, অনেক বড় মনোঃকষ্ট। তবে নিজেদের এ বড় ভুল ভেঙে যায় একসময়। সমবয়সী বান্ধবীর অপ্রাপ্ত বয়সেই বিয়েতে বাধ্য হওয়া তাদের চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে, গীতা ও ববিতার বাবা অন্য বাবাদের চেয়ে শ্রেয়, অনেক বেশি সচেতন। এই বাবা তাঁর মেয়েদের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য ভাবেন! বাবার প্রতি শ্রদ্ধা বাড়ল, নিজেদের ভুল ভেঙে মেয়েরা এবার সংগ্রামী পথকে মনে স্থান দিয়ে কঠোর পরিশ্রমকেই আলিঙ্গন করার পণ করল। এগিয়ে যেতে এটাই হলো মোটিভেশন।
এই মেয়েদের জীবন পথে আর থামতে হয়নি। পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এগিয়ে যাওয়ার পালা। বিট দ্য বেস্ট। সেরাদের হারানোর জন্য তারা নিজেদের তৈরি করে। রেসলিংয়ে প্রথম প্রতিযোগিতায় সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলে প্রতিযোগীদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিযোগীকে বেছে নিয়ে গীতা তাকেই পরাজিত করতে চেয়েছে। ভয়কে জয় করা। খুব ভালো খেলেও এই শক্তিশালী প্রতিযোগীর কাছে সে হেরে যায়। বিজয়ী ছেলে পায় নির্ধারিত পুরস্কারের টাকা, কিন্তু গীতা হেরে গেলেও তার ভালো খেলায় মুগ্ধ হয়ে অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি তাকে দেন বেশি মূল্যের টাকা। শক্তিশালী সেরাকে হারিয়ে পুরস্কার অর্জনের ক্ষুধাটা মেটানো হলো না যদিও। জিদ চেপে যায় গীতার, চলে আরও বেশি বেশি অনুশীলন। পরেরবার এল সেরা হওয়ার অর্জন। বিজয় এল একের পর আরেক, অনেক। গীতা হলো জাতীয় চ্যাম্পিয়ন!

৫.
বাবা মহাবীরও যুবক বয়সে রেসলিংয়ে জাতীয় চ্যাম্পিয়ন। মেয়ে গীতা দেশজয়ী হয়ে থেমে যাওয়াটা স্বপ্নের শেষ নয়। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সেরাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় দেশের জন্য সোনা জয় করতে হবে। বাবার শেখানো গণ্ডি পেরিয়ে রেসলিংয়ে আরও কলাকৌশল রপ্ত করতে গীতাকে ন্যাশনাল একাডেমিতে যেতে হলো। জীবনের পথ চলতে সামান্য অসচেতনতা, অবহেলা, অমনোযোগিতা ইত্যাদি বড় স্বপ্নজয়ের লক্ষ্যকে বাধাগ্রস্ত করে। এসবের মুখোমুখি হয়ে গীতাও লক্ষ্যচ্যুত হয়। আর এর পরিণামে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একের পর এক প্রতিযোগিতায় হার মানতে হলো। ন্যাশনাল একাডেমিতে অনুশীলনের শিক্ষা কৌশলের চেয়ে প্রকৃতিগতভাবে বাবার কাছে পাওয়া কলাকৌশলই প্রতিযোগীদের হারানোর অস্ত্র হতে পারে। হতাশাকে ঝেড়ে ফেলে আবার কাজে লাগা। কঠোর অনুশীলন করে আবার হৃদম ফিরে পাওয়া। কমনওয়েলথ গেমসে তিনটা প্রতিযোগিতায় নিজের সেরাটা দিয়ে শক্তিশালী প্রতিপক্ষকে বিভিন্ন কৌশলে হারিয়ে গীতাই হয়েছে রেসলিংয়ে সেরা। দেশের পতাকা উড়িয়ে সোনা জয়। বাবার স্বপ্নজয়। একইভাবে ছোট বোন ববিতাও এগিয়েছে স্বপ্নজয়ের পথে। সেরাদের হারিয়ে স্বপ্নকে জয় করে গীতা-ববিতারাই সেরা।

৬.
লেখায় গল্পটি বাস্তবতার আলোকে নির্মিত একটি সিনেমা থেকে পাওয়া। নাম ‘দঙ্গল’। হরিয়ানার অনুন্নত এলাকায় বড় হওয়া মেয়ে গীতা ও ববিতা। জীবনের পথে চাওয়ার লক্ষ্যে স্থির থেকে আত্মবিশ্বাসে ভর করে জাতীয় পর্যায়ে রেসলিং চ্যাম্পিয়ন হয় তারা। আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায়ও শক্তিশালী প্রতিপক্ষকে হারিয়ে নিজেদের দেশের জন্য বিরাট সাফল্য আর সম্মান নিয়ে এসেছে। মেয়েসন্তান গীতা ও ববিতারা সব সমাজে নারীকুলের জয়গানের প্রতীক। নারীরা মায়ের জাতি। বিশ্বময় নারীরা নিজেদের সংসার সামলিয়ে সমাজ-সংসারের বাধাবিপত্তিকে ডিঙিয়ে পুরুষদের পাশাপাশি তারাও সমাজ ও দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। শিক্ষায়, গবেষণায়, চিকিৎসায়, খেলাধুলায়, কর্মজীবনে, রাজনীতিতে—সবখানে আছে নারীরা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নারীরা অনেক বেশি এগিয়ে, অনেকে সেরাদেরও সেরা। বর্তমান দুনিয়ায় দেশ-বিদেশে নারীদের জয়গানে অগ্রপথিকেরা যেন আলোর মশাল। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে অদম্য শ্রেষ্ঠত্বের উদাহরণ হয়ে আলোর মশাল হাতে আছেন অনেক নারী—নোবেল জয়ী, চ্যান্সেলর, প্রধানমন্ত্রী, ভাইস প্রেসিডেন্ট, স্পিকার, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী।
লেখক: পিএইচডি, রিসার্চ সায়েন্টিস্ট (জৈব রসায়ন), টরন্টো, কানাডা