স্টেম সেল বোনম্যারো দান

লেখক স্টেম সেল ডোনেট করেছেন
ছবি: সংগৃহীত

এক বিকেলে হঠাৎই কল এল নিউইয়র্ক থেকে যে আমি নাকি একজন ব্লাড ক্যানসার রোগীর ম্যাচ হয়েছি। তাঁর প্রাণ বাঁচাতে আমি কি বোনম্যারো দিতে রাজি আছি কি না।
বেশ কয়েক বছর আগে এক ছয় মাস বয়সী শিশুর প্রাণ রক্ষার জন্য ডিএনএ স্যাম্পল দিয়েছিলাম। জুমাবারে মসজিদে খুতবায় দাঁড়িয়ে ইমাম সাহেব ঘোষণা দিয়েছিলেন। আমার চোখে তখন শিশুটি ও তাঁর মা–বাবার চেহারা ভাসছে। আমার সামান্য অনুদানে যদি তাঁদের পৃথিবী বেঁচে যায়, সুযোগটা আমি কেন নেব না?

আল্লাহ সেদিন শিশুটির প্রাণ রক্ষা করেছিলেন অন্য আরেক ডোনারের মাধ্যমে। ভাগ্যগুণে ম্যাচ পাওয়া গিয়েছিল এবং আমার জন্য সুযোগ এনে দিলেন এত বছর পর।

রাজি হয়ে গেলাম। ফোনেই পদ্ধতি জেনে গেলাম। আমার ধারণা ছিল অস্ত্রোপচার টেবিলে শুতে হবে। আমাকে অজ্ঞান করবে। হাড্ডি না ভাঙলেও মোটা কোনো সিরিঞ্জের মাধ্যমে বোনম্যারো সংগ্রহ করা হবে। অনেক ঝামেলার বিষয়। তারপরও রাজি। একজনের প্রাণের তুলনায় এসব তো কিছুই নয়।

পরে শুনি আরও অনেক সহজ পদ্ধতি আছে। সেটা হচ্ছে আমাকে ইনজেকশন দিয়ে কিছু ওষুধ দেওয়া হবে। ব্লাড স্টেম সেল বৃদ্ধি করবে। তারপর রক্তদানের মতো রক্ত নিতে থাকবে। সেখান থেকেই স্টেম সেল সরিয়ে আবার আমার রক্ত আমাকে ফেরত দিয়ে দেবে। কয়েক ঘণ্টাব্যাপী চলবে এই কার্যক্রম। আমার ‘কষ্ট’ বলতে ইনজেকশনের খোঁচা (তা–ও সুই সরু ছিল বলে টেরই পাইনি), রক্ত নেওয়ার সময় মোটা সুইয়ের খোঁচা, আইভির খোঁচা। আর দীর্ঘক্ষণ একটি বিছানায় শুয়ে থাকা যন্ত্রণার। নড়াচড়া করব, হাঁটাহাঁটি করব, সে উপায় নেই। বয়স্ক নার্স সর্বক্ষণের সঙ্গী। সুন্দরী কিছু নার্স থাকেন না, যাঁদের দেখলেই পুরুষ মানুষ বলেন, ‘খুশি হয়ে দুইটা ইনজেকশন বেশি দিতে পারেন, কোনো অসুবিধা নাই।’ এমন নার্সও নেই। সব নার্সই মায়ের বয়সী। তাঁদের দেখলেই ব্যাকগ্রাউন্ডে গান ভেসে ওঠে, ‘তুঝে সাব হ্যায় পাতা মেরি মা।’

ও আচ্ছা, ওই যে প্রথম চার দিন ইনজেকশন দেবে, বাড়তি স্টেম সেল তৈরি হবে, শরীরে সেটা অনুভূত হবে। এই ব্যথা বা অস্বস্তি অনেকটা এমন যেন বহুদিন পর ব্যায়াম করলে হাত–পায়ের মাসল ব্যথা করে, ঠিক তেমন। ডোনেশন শেষে রিকভারির অনুভূতিও অনেকটা তা–ই। আপনি ভারী কিছু তুলতে পারবেন না। প্রচুর পানি খেতে হবে। অল্প পরিশ্রম করবেন প্রথম কয়েক দিন।

এখন আমাকে বলেন, একজন ক্যানসার রোগীর যন্ত্রণার তুলনায় এটি এমন কিছু কি? অবশ্যই নয়। আমার এই সামান্য ত্যাগের বিনিময়ে যদি কারোর প্রাণ রক্ষা হয়, তবে আমি কেন এগিয়ে আসব না? কালকে যদি আমার প্রয়োজন হয় কিংবা আল্লাহ মাফ করুক, যদি আমার মা–বাবা, স্ত্রী–সন্তান, ভাই–বোন, আত্মীয়, বন্ধুবান্ধবের কারোর বোনম্যারোর প্রয়োজন হয়, আমি স্বার্থপরের মতো বসে থাকব? কোটি কোটি টাকা প্রয়োজন হয় চিকিৎসায়, কোটি কোটি টাকা ডোনেশন তোলা হয়, তারপরও মানুষ বাঁচে না। অথচ এই সামান্য কষ্টের বিনিময়ে অনেক বড় সুযোগ থাকে কারোর প্রাণ রক্ষার। আমার এক পয়সাও খরচ হচ্ছে না, আমার শারীরিক ক্ষতিও হচ্ছে না, তারপরও কিছু না করে বসে থাকাটা কি বিবেকের কাছেই অপরাধ নয়?

আমার ফুফাতো ভাইয়ের বউ ১০ বছর আগে রেজিস্ট্রি করে রেখেছে একই প্রতিষ্ঠানে। এখন পর্যন্ত ডাক আসেনি। আমার সঙ্গেই আমার ভাই রেজিস্ট্রি করেছিল, ডাক আসেনি। কেবল আমাকে দেখেই আমার বউ রেজিস্ট্রি করে ফেলল। এই আশায়, একদিন সে–ও কল পাবে। হয়তো এ জীবনে তারা কেউই ডাক পাবে না। কিন্তু তারা তাদের ভাগের দায়িত্ব সেরে রেখেছে। বাকিটা আল্লাহর ইচ্ছা।

তাই এই সৌভাগ্যকে আমি লটারি জেতার সঙ্গে তুলনা করি। প্রথম দিন যখন ‘ভেইন’ টেস্ট করতে যাই, তারা ভেবে বসে আমি রক্তদান করতে গিয়েছি। আমিও যেহেতু নিয়ম জানি না, তাই কিছু বলতে পারিনি। তারা রক্ত নিয়ে ধন্যবাদ বলে আমাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিল।

ডিকেএমএসের লোক ঘটনা শুনে হতভম্ব। কারণ, একবার রক্ত দিয়ে দিলে দু–তিন মাস আগে রক্ত দেওয়ার নিয়ম নেই। এদিকে ক্যানসার এতটা সময় একজন রোগীকে না–ও দিতে পারে। আমি ছাড়া আর কোনো ম্যাচ পাওয়া যায়নি। রোগীর জীবন সংকটে ফেলে দিয়েছে একটি প্রতিষ্ঠানের গাফিলতি বা ভদ্র ভাষায় ভুল–বোঝাবুঝি।
আমি বললাম, ‘যত দ্রুত সম্ভব রক্ত নেওয়ার ব্যবস্থা করো। রোগীর প্রাণ আগে।’
আমার টেনশন, এই সুযোগ নষ্ট হলে আমি আর দ্বিতীয়বার না–ও পেতে পারি। তাই কিছুতেই হাতছাড়া করতে রাজি হলাম না।

তা ছাড়া কল্পনা করুন, দেশের সম্পূর্ণ উল্টো প্রান্তে এক রোগীকে তাঁর চিকিৎসকেরা সুখবর দিয়েছিলেন যে ম্যাচ পাওয়া গেছে। এখন তাঁরা কী বলবেন? ‘ম্যাচ পাওয়া গিয়েছিল, কিন্তু একটা টেকনিক্যাল সমস্যার কারণে আমরা ওকে নিতে পারছি না।’ সেই রোগী ও তাঁর পরিবারের লোকজনের মানসিক অবস্থার তখন কী হবে?
তারা হিমোগ্লোবিন টেস্ট করল। আমার রেজাল্ট ভালো ছিল। তাই তারা কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই আরেকটা নতুন তারিখ দিয়ে বলল, ‘লেটস গেট ইট ডান!’
বাড়িতে এসে একজন নার্স প্রতিদিন দুটি করে ইনজেকশন পুশ করে যান। এভাবে টানা চার দিন চলার পরে পঞ্চম দিন সকালবেলা হাজির হলাম ডোনেশন সেন্টারে। তারা প্রস্তুত ছিল। আগেরবারের ভুল–বোঝাবুঝির জন্য ক্ষমা চাইল। ডোনেশন দিচ্ছি বলে অনেক প্রশংসা করল। ধন্যবাদ দিল।

জানিয়ে রাখি, আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের লোকজন খুব বেশি রক্তদান বা স্টেম সেল বা বোনম্যারো দান ইত্যাদি কর্মকাণ্ডে অংশ নেন না। এর প্রধান কারণ হয়তো জ্ঞানের অভাব। তাঁরা জানেনই না এ রকম কত প্রতিষ্ঠান এখানে আছে। অথবা আমাদের কালচারেই নেই এই ব্যাপারটা যে অপরিচিত কারোর জীবন রক্ষার জন্য নিজে কোনো শারীরিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যাব। তাই আমাদের এগিয়ে আসতে দেখলে তাঁরা বিপুল উৎসাহ দেন। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনকে উৎসাহ দিতে উৎসাহী করেন।
দীর্ঘ বিরক্তিকর সময় যেন খানিকটা আনন্দে কাটে, সে জন্য বিনোদন হিসেবে ছিল ডিভিডির ব্যবস্থা। ৬০০ সিনেমার তালিকা দিয়ে বলল, কোনটা দেখতে চাই। ক্রিস্টোফার নোলানের ‘ইন্টারস্টেলার’ দেখলাম। সিনেমা শেষ হতে হতে আমার কাজও শেষ।

ডোনেটের পর একটি গেঞ্জি আর একটি সার্টিফিকেট পেয়েছেন লেখক
ছবি: সংগৃহীত

এরই ফাঁকে জানতে চাইলাম কীভাবে কী করা হবে। নার্স বললেন, ‘তোমার স্টেম সেল আজকেই প্লেনে করে রোগীর কাছে পাঠানো হবে। তারপর কেমোথেরাপি দিয়ে ওর বোনম্যারোর সব স্টেম সেল সরিয়ে ফেলা হবে। তারপর তোমার সেলগুলো ওরটাতে ফিট করা হবে এবং সবাই আশা করবে, এগুলো ক্যানসার সেলকে মারতে সক্ষম হবে।’
এরপর সে আরও কিছু সম্ভাব্য কমপ্লিকেশন এবং তার সমাধানের ব্যাপারে তাঁদের প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা করলেন। চিকিৎসকেরা ভালো জানেন। ওই সব টেকনিক্যাল বিষয় আমার–আপনার না জানলেও চলবে। তবে আমি এসব শুনতে শুনতে অবাক হয়ে ভাবছিলাম, মেডিকেল সায়েন্স কোথায় পৌঁছে গেছে!

‘আর যদি আমার স্টেম সেল ওর রোগ সারাতে সক্ষম না হয়?’
নার্স তখন বললেন, ‘ওই রোগীকে প্রাণে বাঁচানোর সম্ভাবনা এমনিতেও ছিল শূন্য। তোমার ডোনেশনের ফলে কিছুটা হলেও আশার সঞ্চার হয়েছে। এখন পুরোটাই ওপরওয়ালার হাতে। আশা করি, সে সুস্থ হয়ে উঠবে।’

মহিলার কাছ থেকেই জানলাম, এক বাচ্চা যার বাবা আফগানি এবং মা ভারতীয়, এমন মিশ্র বর্ণের হওয়ায় ম্যাচ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। বর্তমান পৃথিবী অনেক বেশি মিশ্র হয়ে গেছে। বাঙালিরা নিয়মিত ভিন্ন জাতির মানুষকে বিয়ে করে সন্তান জন্ম দিচ্ছে, ভিন্ন জাতির লোকজনও তা–ই করছে। এই বিপুল মিশ্র জাতির জন্য প্রচুর মিশ্র জাতির স্যাম্পল প্রয়োজন। এর একটাই উপায়, বেশি বেশি করে মানুষের রেজিস্ট্রেশন।
একটি ব্যাপার কয়েকবার বলেছি, আবারও বলি, যাতে আমাদের সবার বুঝতে সুবিধা হয়। আমরা বাংলাদেশিরা এমনিতেই এ দেশে মাইনোরিটি। কিন্তু এই ‘মাইনোরিটির’ মধ্যেও আমাদের সংখ্যা লাখ লাখ। ডালাস শহরের আশপাশেই হয়তো প্রায় এক লাখ বাঙালির বাস। খোঁজ নিলেই সঠিক সংখ্যা বেরিয়ে আসবে। নিউইয়র্কে আধা মিলিয়ন হওয়াই উচিত। মিশিগান, ক্যালিফোর্নিয়া, ফ্লোরিডা ইত্যাদি অঞ্চলেও প্রচুর বাঙালি বাস করেন। ইংল্যান্ডে আধা মিলিয়ন কেবল সিলেটির বাস। বাঙালির হিসাব আলাদা। তারপরও আমাদের কারোর এই রোগ হলে ম্যাচ পাওয়া খুব কঠিন হয়ে পড়ে। কিন্তু যদি এই লাখ লাখ বাঙালি নিজেদের ডিএনএ স্যাম্পল দিয়ে রাখেন, তাহলে আমি নিশ্চিত, ঠিক মতো সার্চ দিলে অতি সহজেই প্রচুর ম্যাচ খুঁজে পাওয়া সম্ভব। সামান্য কষ্টের বিনিময়ে কারোর মা–বাবা, কারোর সন্তানকে আমরা বাঁচার সুযোগ করে দিতে পারি।
কেউ কেউ ফতোয়া দেবেন, ‘ডান হাত দান করলে বাঁ হাত যেন টের না পায়। এসব চুপচাপ বা নীরবে বা গোপনে করতে হয়।’

কথা হচ্ছে, আমি যদি চুপচাপ দান করে চলে আসতাম, তাহলে কতজন জানতেন এই প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে? কতজন গুগলে সার্চ দিয়ে বের করেন ‘স্টেম সেল বা বোনম্যারো ডোনেশন সেন্টার’? আমাদের প্রচুর ডোনার দরকার এবং এসব কাজ গোপনে করলে ডোনার পাওয়া যাবে না। এক ভাই আমাকে মন্তব্য করলেন, ‘আমি ভেবেছিলাম হাড্ডি ভেঙে বোনম্যারো নিয়ে রোগীকে দেবে। এখন দেখছি, অতি সহজ পদ্ধতি। আমি অবশ্যই দেব।’ গোপনে দান করলে এই ভাইয়ের এই ভুল ভাঙত?

পুরো অভিজ্ঞতা বিস্তারিত এই কারণেই লিখলাম, যাতে কোনো রকমের দ্বিধা, সংশয়বোধ ইত্যাদি আপনার মনে কাজ না করে। যদি আমি পারি, আপনি অবশ্যই পারবেন। আপনি অতি মহৎ একটি কাজের অংশ হবেন নিশ্চিত। সবাই সব সময় এই সুযোগ পায় না। যদি সুযোগ থাকে, অবশ্যই সেই সুযোগ হাতে নেওয়া উচিত। দুই দিন পরে যখন মরে যাবেন, তখন অন্তত মৃত্যুকালে নিজেকে নিয়ে গর্বিত হতে পারবেন।
আর দেশে যাঁরা সত্যিকারের কিছু করতে চান, তাঁরা ভেবে দেখতে পারেন এমন কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যায় কি না। কয়েকজন এক্সপার্ট চিকিৎসক এবং কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার প্রয়োজন শুধু। আর দরকার প্রচুর ভলান্টিয়ার। সরকারকে যদি বোঝাতে পারেন, তাহলে সরকারও এগিয়ে এল। এমন একটি প্রতিষ্ঠানের বড্ড প্রয়োজন আমাদের দেশে। সরকারি সাহায্য ছাড়া সম্ভব হবে না। কারণ, প্রচুর টাকার প্রয়োজন। সন্ধানী যেমন রক্ত ও চক্ষু নিয়ে এগিয়ে আসে, এটি সেভাবে বোনম্যারো বা স্টেম সেল নিয়ে এগিয়ে আসবে।

আমেরিকান বাংলাদেশি জনগণ, রেজিস্টার করুন। হোয়াট’স ইউর এক্সকিউজ?
ছবিতে নিজের ডোনেট করা স্টেম সেল হাতে আমি। নার্স বললেন, ‘চ্যাম্পিয়নের মতো পোজ দাও! তুমি কি জানো যে তুমি একজন চ্যাম্পিয়ন?’ তারপরও চ্যাম্পিয়নের মতো পোজ দেওয়া হলো না। চার ঘণ্টা পর পেছনের ওই চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়েই ছবি তুললাম। এরপর নিজেই তিরিশ মাইল ড্রাইভ করে বাড়ি ফিরলাম। নিজেই বোঝেন তাহলে কেমন ‘কষ্ট’ হয়।

ডোনেশন করে পেলাম একটি গেঞ্জি, একটি সার্টিফিকেট আর সংশ্লিষ্ট নার্স, ডিকেএমএস কর্মচারী, সেই রোগী ও তাঁর আত্মীয়দের দোয়া। এসবের মূল্য টাকা দিয়ে হয় না।