স্বপ্নের চেয়েও সুন্দর পিটার্সবার্গ!

রাশিয়ায় পড়াশোনা করছি দুই বছরের ওপরে হলো। রাশিয়া আসার পরেই প্ল্যান ছিল লাস্ট ইয়ারের ফাইনালের আগে সেন্ট পিটার্সবার্গ ঘুরতে যাব। যে ভাবনা সেই কাজ। পৃথিবীর অতি সুন্দর ৫০টি শহরের একটি সেন্ট পিটার্সবার্গ। এবার রোজার ঈদের চার দিনের মাথায় আমি, লিমন, জান্নাত আর প্রবাল—চার বন্ধু টিকিট কাটলাম ৪০০ বছরের এ পুরোনো ঐতিহাসিক শহর ঘুরতে যাওয়ার।

ট্রেনের টিকিট ছিল ওয়ান টু ট্রিপের দ্বিতীয় শ্রেণির বগির। ট্রেনে ওঠার আগের রাত থেকেই আমাদের মনে কী যে আনন্দ, তা লিখে প্রকাশ করার বাইরে। ২০ এপ্রিল দুপুরে আমাদের যাত্রা শুরু হয় ভরনেজ বাকজাল (বাকজাল মানে স্টেশন, রাশিয়ান ভাষায়) থেকে। ট্রেনও সেই একের! প্লেনের মতো প্রথম ক্লাস সার্ভিস, ট্রেনযাত্রায় আমাদের কাটল গান, গল্প আর হইচই করে। চলতি পথে বন্ধুত্ব হলো নতুন কিছু রাশিয়ানের সঙ্গে, যারা কিনা এখন আমাদের ইনস্টাগ্রামের বন্ধু। তাদের সঙ্গে এখন আমরা শেয়ার করছি আমাদের রোমাঞ্চকর মুহূর্তগুলো।

২১ এপ্রিল সকাল সাড়ে আটটায় আমরা পৌঁছালাম কাঙ্ক্ষিত স্বপ্ননগরী সেন্ট পিটার্সবার্গ। নেমেই ট্যাক্সি করে গুগল ম্যাপে দেখে একটা কেএফসিতে বসে চলল পেটপূজা। তারপর তাগড়া হয়ে আভিটো অ্যাপে বের করে নিলাম কোথায় থাকব, সেই আবাস। পিটার্সবার্গের সেন্টার এরিয়াতেই আমরা হোটেল বুক দিলাম, চেকইন টাইম দিল বেলা তিনটা। এরই মধ্য তো ফেসবুকে চলছিল যাত্রাপথ থেকেই চেকইন, তিনটা বাজতে তখনো দুই ঘণ্টা বাকি, ইতিমধ্যে বাংলাদেশ থেকে পুরোনো বন্ধু রায়হান ভাইয়ের কল পাই, মৌ কবে গেলি পিটার্সবার্গ? উত্তরে বলি, আজকে সকালে। রায়হান ভাই তার আরেক রাশিয়ান বন্ধু ভেরোনিকার নম্বর দেয়। আমিও কল দিই ভেরোনিকাকে। ভেরোনিকারও ফ্রি টাইম ছিল। আমরা হোটেলে চেকইন দিয়ে, তাজিকি প্লেটার খেয়ে বেরিয়ে পড়ি হেঁটে পিটার্সবার্গ ভ্রমণে। ওমা! বড় বড় দালান! একেকটি দালান ২০০ থেকে ৩০০ বছরের পুরোনো, আর কী সুন্দর! ভেরোনিকাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াই সেভিওর অন দ্য স্পিল্ড ব্লাড, কাজান ক্যাথেড্রাল, কিনিগা দম, উইন্টার প্যালেসে, যেটা কিনা সারা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ মিউজিয়াম।

ঘুরছিলাম আর ছবি তুলছিলাম। মনে হচ্ছিল আমার স্বপ্নরাজ্যের আমিই রানি। ভেরোনিকা আমাদের বলল, এখন পিটার্সবার্গে রাত হয় না। কী অদ্ভুত শুনতে, না! মজার আরও একটি বিষয় হলো ভেরোনিকা দারুণ বাংলা বলতে পারে। সে দুই বছর বাংলাদেশে ছিল—বাংলাদেশ ও রাশিয়ার চুক্তিতে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের যে কাজ চলছে, সে কাজে। এ জন্য সে খুব ভালোভাবেই বাংলা রপ্ত করেছে। আমিও ওর বাংলা শুনে হতবাক হয়ে যাই। তার বাংলায় কথা বলা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দিই, যা এখন ভাইরালের পর্যায়ে। ভেরোনিকা আমাদের খালি মুখে ছাড়েনি। আমাদের রাশিয়ান স্যুপ, ওয়াফেল আর মোকা কফি ট্রিট দিয়ে হোটেল পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। রাতে ক্লান্ত হয়ে হোটেলে এসে দেখি, লিমনের আরও একজন বন্ধু—রকি ভাই—আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। তার অপেক্ষার কারণ এখানকার বিখ্যাত মুভিং ব্রিজ দেখানোর জন্য। রকি ভাইয়ের সঙ্গেই আমরা শীতের কাপড় জড়িয়ে বেরিয়ে পড়ি আলেক্সান্ডার নাভিস্কি ব্রিজ দেখতে। এটাও আমরা রাতে দেখি। রাতের পিটার্সবার্গ আরও বেশি অপরূপ! নাতিশীতোষ্ণ আর আলোকসজ্জায় আলোড়িত পিটার্সবার্গ! চোখটা বন্ধ করলে এখন মনে হয়, আমি ওখানেই আছি।

পরদিন আমরা রওনা হই পিটার্সবার্গের আরেকটি বিশেষ আকর্ষণ পিটারগফ প্যালেস দেখতে। সেন্টার থেকে এক ঘণ্টার যাত্রা পিটারগফ। মেট্রোরেল আর মাইক্রোবাসের যাত্রায় পোঁছাই পিটারগফ। পিটারগফ প্যালেসকে বর্ণনা করতে আমার মনে হচ্ছে শব্দ কম পড়বে, এত সুন্দর! সবুজ খোলা মাঠ, টিউলিপ আর ড্যাফোডিলের বাতাসের দোল খেলানি, পাখির কলতান, মেঘমুক্ত আকাশ, আর পিটারগফের নানা আদলের ঝরনা। প্যালেসটি পুরোনো ৩০০ বছরের, সঙ্গে চার্চটিও। সেদিন আরও ছিল পিটারগফে উৎসব। পিটারগফ এলাকার বিশেষ লোকজন এসেছিল সেই উৎসব দেখাতে। আমাদের অভ্যর্থনা দেওয়া হলো আকাশে বাজি ফুটিয়ে সেই উৎসবকে কেন্দ্র করে। প্যালেসের সামনেই নদী আর নদীর পারে মিষ্টি হাওয়া। ওখান থেকে আমার একটুও ফিরতে মন চাইছিল না। তবু! আর কী করা! বিকেলবেলা স্টারবাক্সে কফি পান করে মন চাঙা করে পরদিনের পরিকল্পনা!

পরদিন আমরা বেরোলাম রিভারক্রুসে, চার বন্ধু আর রকি ভাই, পাঁচজন ক্রুসে ঘুরে বেড়ালাম। গোটা পিটার্সবার্গ শহর দেখলাম। ক্রুস থেকে নেমে আমরা গেলাম সেন্টারের সবচেয়ে বড় মসজিদ দেখতে। সেখানে ঈদে একসঙ্গে এক লাখ মুসল্লির নামাজ হয়। তারপর গেলাম পিটার অ্যান্ড পল ফরটেস। রাতের খাবার সারলাম, তখনই লিমন আর প্রবালদা বলল, আমরা আরও এক দিন থাকব এখানে। কারণ জানতে চাইলাম। এ আবহাওয়া ছেড়ে ফিরতে ইচ্ছে করছিল না, আসলে আমাদের কারই ফিরে যেতে মন চাইছিল না।

পরদিন আমরা কোথাও ঘুরতে গেলাম না। পুরোটা দিন হোটেলে আরাম–আয়েশ করে গল্প আর গানে কাটিয়ে দিলাম। পরের সকালটা ছিল পিটার্সবার্গকে বিদায়ের বেলা। রেলস্টেশন যাওয়ার পর থেকেই আমার চোখ গড়িয়ে পড়ছিল পানি! কী কারণে, আমি তা বলতে পারছিলাম না, আসলেই না।

এখন এ ডরমিটরিতে থিসিসের কাজের ফাঁকে যখনই জানালার দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করি, কানে বাজে পাখির কিচিরমিচির, স্বপ্নের চেয়ে সুন্দর পিটার্সবার্গের সেই টিউলিপবাগানে আমি! আসলেই পিটার্সবার্গ স্বপ্নের চেয়েও সুন্দর।

*লেখক: নাফিজা মৌ, ভরনেজ, রাশিয়া।