স্মরণের ‘পপি’ এবং সময়ের কবিতা

যুদ্ধ যেমন ধ্বংসের খেলায় মেতে ওঠে, রক্তাক্ত করে সবুজ প্রান্তর, শূন্য করে জনমানবের হৃদয়জমিন, তেমনি যুদ্ধের স্মৃতিচারণা, যুদ্ধ পরিস্থিতিতে লেখা হয় অনেক ডায়েরি, স্মৃতিকথা, কাব্যগাথা, যা একসময় ইতিহাসের অংশ হয়ে ওঠে নির্বিবাদে। পৃথিবীর অনেক দেশের ইতিহাস ঘাঁটলে এমন অসংখ্য প্রমাণ মিলবে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও রয়েছে এমন বেদনাবিধুর অনেক স্মৃতি! যুদ্ধক্ষেত্রে বন্ধু-স্বজনকে হারিয়ে যে বেদনার বিষবৃক্ষ বাসা বেঁধেছিল, তা-ই একসময় গানে, কবিতায়, গল্পে বাস্তব রূপ নিয়ে সমৃদ্ধ করেছে আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য আর সংস্কৃতিকে। আমাদের বীরত্বগাথা জেনেছে বিশ্ব, ছড়িয়ে পড়েছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে, যার অনেক কিছুই হয়তো যুদ্ধক্ষেত্রেই রচিত হয়েছিল সেনাদের হাতে। তেমনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসেও এমন অসংখ্য করুণ গাথা রচিত হয়েছে যুদ্ধরত সৈনিকদের হাত ধরে। কানাডার সংস্কৃতিও সমৃদ্ধ হয়েছে এমন এক মহান ব্যক্তিত্বের হাত ধরে, যাঁর নাম উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গেই একটি ফুল, একটি কবিতা, একটি ইতিহাস এবং স্মরণের এক বিশাল বেদনাবিধুর ক্ষণ স্মৃতিপটে ভাস্বর হয়ে ওঠে।
 
তিনি একজন লেফটেন্যান্ট কর্নেল জন ম্যাক্রে। কানাডার এক ছোট্ট শহর গুয়েলফে জন্ম নেওয়া এই ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তা  ছিলেন একাধারে একজন চিকিৎসক, সম্মুখযোদ্ধা, কবি, লেখক এবং চিত্রশিল্পী। ১৯১৫ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোল ছড়িয়ে পড়লে তিনি ক্যানাডিয়ান একপেডিশনারি ফোর্সে মেডিকেল কোরে যোগ দেন এবং স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে একই সঙ্গে ফাইটিং ইউনিটে গানার ও মেডিকেল অফিসারের দায়িত্ব কাঁধে নেন। কানাডা সেনাবাহিনীর ফিল্ড আর্টিলারিতে ১৮৯৯ থেকে ১৯০২ সাল পর্যন্ত অফিসার হিসেবে যোগ দিয়ে মেজর পদে উন্নীত হয়ে পদত্যাগ করার অভিজ্ঞতা আর আজীবন সৈনিক পিতার আদর্শই তাঁকে দেশমাতৃকার পক্ষে দাঁড়াতে প্রাণিত করেছিল। যিনি কমনওয়েলথভুক্ত দেশ তথা উত্তর আমেরিকায় তাঁর ‘ইন ফ্লান্ডারস ফিল্ড’ নামের বিখ্যাত সমর কবিতার জন্য সমধিক পরিচিত। তিনি মাত্র ৪৫ বছর বয়সে ১৯১৮ সালের জানুয়ারিতে মৃত্যুবরণ করেন।

জন ম্যাক্রে তাঁর কবিতায় পপি ফুলের কথা উল্লেখ করেছেন। শুধু সাধারণ চোখেই তিনি পপিকে অমরত্ব দেননি, বরং ফ্ল্যান্ডারস ফিল্ডের ‘পপি’ হয়ে উঠেছিল যুদ্ধক্ষেত্রে জীবনাবসানের মূর্ত প্রতীক! রক্তলাল পপির বুকে গোলাকার কালো যে ক্ষত; সে তো যুদ্ধরত সৈনিকেরই বুক! বুলেটের আঘাতে যখন ক্ষতবিক্ষত হয়ে মাটির বুকে ঢলে পড়েছিলেন লাখো সেনা, তখন চারদিকে পপির ছড়িয়ে যাওয়া পাপড়ির মতোই রক্তের সমুদ্র বয়ে গিয়েছিল! যার বুকে বিষাদের কালো ছায়া গাঢ় থেকে গাঢ় অন্ধকার নামিয়ে এনেছিল অপরাপর সৈনিকদের মধ্যে। কবিতার ছত্রে ছত্রে পপিও তাই দল মেলে নিমেষেই হয়ে ওঠে স্মরণের ইতিহাস! এক অনন্য সমর কথন!

Remembrance Day—স্মরণের দিন! বিশ্বযুদ্ধে প্রাণ হারানো সেই শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদনে প্রতিবছর নভেম্বরের ১১ তারিখে কানাডায় উদযাপিত হয় এই দিবস। সে উপলক্ষে অন্যান্য কার্যক্রমের মধ্যে কাপড়ের তৈরি ‘পপি’ আকৃতির কোটপিন পরার রীতি চালু রয়েছে সব সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। একটি জংলি ফুল পপি যে কিনা ফ্লান্ডারের মাঠজুড়ে অতি অনাদরেই একরের পর একর জায়গায় জন্ম নিয়েছিল প্রকৃতির খেয়ালেই। প্রকৃতি নিজেই কি জানত সেই পপিই এক সৈনিক কবির চোখে হয়ে উঠবে এমন বিশেষ ঐশ্বর্যের অধিকারী, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম বুকের গভীরে ধারণ করবে ভালোবাসায়, নতজানু হবে শ্রদ্ধায় আর লালন করবে চেতনায়।

উল্লেখ্য, বেলজিয়ামের দক্ষিণাংশ এবং ফ্রান্সের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল যা ফ্লান্ডারের মাঠ নামেই অভিহিত ছিল ১৯১৫ সালের ২২ এপ্রিল বিশ্বযুদ্ধের সময়। সেদিনের সেই যুদ্ধে অসংখ্য কানাডিয়ান সেনার সঙ্গে জন ম্যাক্রে তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সহযোদ্ধা আলেক্স হেমলারকে হারান, যাঁকে তিনি নিজ হাতেই সমাহিত করেছিলেন ফ্লান্ডারের মাঠে। বন্ধুর মৃত্যুতে শোকাহত কবি মের ৩ তারিখেই তাঁর বিখ্যাত কবিতাটি রচনা করেন, যা আজও বহুল পঠিত, জনপ্রিয় এবং সাড়াজাগানো এক সমর কবিতা হিসেবে সর্বাধিক খ্যাত। জন ম্যাক্রের ‘ইন ফ্লান্ডারস ফিল্ড’ কবিতার অনুবাদটি পাঠকের দরবারে উপস্থাপন করা হলো গভীর শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায়।

ফ্লান্ডারের মাঠে

ফ্লান্ডারের মাঠজুড়ে পপি ফুটেছে
সারে সারে থরে থরে,
দুলছে ক্রসের ফাঁকে ফাঁকে
যা আমাদের ঠিকানা চিহ্নিত করেছে
আকাশ এবং মাটির মাঝে।
লার্কের দল এখনো গাইছে গান,
উড়ছে ডানা মেলে অকুতোভয়ে
ভয় কাঁপানিয়া দিনে-রাতে;
জীবন যখন রাইফেলের ট্রিগারের নিচে!
এখন আমরা অন্তহীন শয়নে,
কিছুদিন আগেও জীবন ছিল।
ভোরের স্নিগ্ধতা অনুভব করেছিলাম,
দেখেছিলাম সূর্যাস্তের উদ্ভাস।
ভালোও বেসেছিলাম, ভালোবাসাও বেসেছিল ভালো,
এখন ঘুমিয়ে আছি ফ্লান্ডারের এই মাঠে ।
শত্রুর সাথে আমাদের অমীমাংসিত বিবাদ
তোমাদের কাঁধে তুলে নিও।
আমাদের ব্যর্থ হাতের মশাল
দিয়ে গেলাম তোমাদের হাতে, তাকে জ্বালিয়ে রেখো।
আমরা যারা চলে গেছি মরণের ওপারে,
বিশ্বাস যদি ভাঙো আমাদের সাথে
জেগে রবো ঘুমহীন—অনন্তে;
জেনে রেখো, তখনো ফুটবে পপিরা নীরবে,
ফ্লান্ডারের এই মাঠে।

অনুবাদ ও কলমে: সঙ্গীতা ইয়াসমিন টরন্টো, কানাডা।
তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া, বায়োগ্রাফি অব জন ম্যাক্রে