সড়ক পথে ফিলাডেলফিয়া থেকে আলাবামা

হোয়াইট হাউস প্রিমাইসেসের সামনে বন্ধুদের সঙ্গে লেখকছবি: সংগৃহীত

আমেরিকায় আসার আগে অনেক কিছুই ভেবেছিলাম। তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে বিশেষ প্রত্যাশা না করার অঙ্গীকার ছিল মনে মনে। অথচ এ দেশে আসার পর কেমন করে যেন পেয়ে গেলাম এমন কিছু মানুষ, যাদের ওপর কখনো আশা করতে হয়নি। এই তো সেদিন আমিনুল আর শাহরিয়ারকে বললাম, করোনার কারণে পরিবার নিয়ে ফ্লাইটে ফিরতে ভয় পাচ্ছি। তাতেই তারা একটা সেভেন সিটার নিয়ে আসতে পারবে কি না। ওরা রাজি হয়ে যায়।

গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি মাথায় করে ফিলাডেলফিয়ার পটস টাউনে ছোট বোনের বাসা থেকে যখন বের হই, তখন মধ্যরাত। ড্রাইভিং সিটে শাহরিার; তার পাশে আমিনুল। পেছনে আমার পাশে সবুজ। একেবারে পেছনে সানামের সঙ্গে আমাদের ছোট্ট দুই ছেলে—আয়ান আর আরিয়ান।

রাতের অন্ধকার কেটে চলেছি পাহাড়ের কোল ঘেঁষে আঁকাবাঁকা পথ ধরে। বাঁ পাশটা ঝোপালো পাহাড় বেয়ে উঠে গেছে আকাশের গায়ে। ডান পাশটা ঢাল বেয়ে নিচে নেমে মিলিয়ে গেছে অজানা কোনো এক নদীর বুকে। যেন কুলকুল শব্দ ভেসে আসছে রাতের হিমেল হাওয়ায় ভর করে।

তখনো চলছিলাম ছোট ছোট শহরের ওপর দিয়ে। ল্যাম্পপোস্টের আলো আর বিন্দু বিন্দু বৃষ্টিজলে মিলেমিশে একাকার। চারপাশে একটু একটু পাতলা আলো-আঁধারি। সেই তাতেও ঠিক বুঝতে পারি এক অদ্ভুত সৌন্দর্য ছুটে চলেছে আমাদের পথটা ধরেই।

ওয়াশিংটন ডিসি মনুমেন্ট প্রাঙ্গণে সপরিবারে লেখক
ছবি: সংগৃহীত

ইলশেগুঁড়ি মেখে চলতে চলতে যখন মেরিল্যান্ডের কলেজ পার্কে বন্ধুর বাসায় ঢুকি, তখন ঘড়ির কাঁটায় রাত তিনটা। বন্ধু সজীব ও সোমা ভাবি আমাদের পথ চেয়ে কতটা অপেক্ষা করছিলেন সেই সন্ধ্যা রাত থেকে, তা আন্দাজ করতে সমস্যা হয় না। ভেবেছিলাম, বন্ধুর বাসায় উঠেই ঘুমের রাজ্যে শরীরটা এলিয়ে দেব; কিন্তু কেমন করে যেন আড্ডা জমে ওঠে। একটা সময় যখন দুচোখজুড়ে রাজ্যের ঘুম, তখন বন্ধু ও বন্ধুপত্নীর কাণ্ড দেখে খানিকটা অবাক না হয়ে পারিনি। কারও কাছ থেকে এতটুকু গুরুত্ব পাওয়ার মতো কিছুই আমার নেই। তবু যখন কারও কাছ থেকে এতখানি গুরুত্ব পাই, তখন এক অদ্ভুত আনন্দে মনটা বেশ ভরে ওঠে।

ঘুম থেকে খুব সকালে ওঠার কথা থাকলেও উঠতে উঠতে প্রায় দুপুর। খুব তড়িঘড়ি করছিলাম বের হব; কিন্তু সেদিকে যেন বন্ধুর কোনো বিকার নেই। খুব জোর দিয়ে বললাম, দোস্ত, আমাদের আরও ১২ ঘণ্টার জার্নি বাকি। তার ওপর যাওয়ার পথে ট্রাম্প সাহেবের সাদা বাড়িতে ঢুঁ মেরে না গেলে তিনিও যে বড্ড মন খারাপ করবেন!

হোয়াইট হাউস প্রিমাইসেসের সামনে বন্ধুদের সঙ্গে লেখক ও লেখকের ছেলে
ছবি: সংগৃহীত

বন্ধুর বাসা থেকে যখন বের হই, ঘড়ির কাঁটায় তখন দুইটা। শাহরিয়ার আর আমিনুল হোয়াইট হাউসের নেভিগেশন দিচ্ছে। ভাতঘুমের জোরেই কিনা ঝিমুনি আসছিল খুব। পেছনের সিটে শরীর এলিয়ে দিতেই যেন ভাসতে থাকে বন্ধুর বাসায় ছেড়ে আসা সেই ঝুল বারান্দা। ঝিমুনি ভেঙে আড়ামোড়া দিতেই আমপাতার মতো বেশ লম্বা একটা সৌধের গা থেকে সাদা দ্যুতি চোখে এসে পড়ে। খানিকটা অবাক হয়ে চোখ দুটো কচলাতে কচলাতে জিজ্ঞেস করি, এটাকে যেন কী বলে? সামনে থেকে আমিনুল জানা, ‘ভাই, ওয়াশিংটন মনুমেন্ট।’ আরও একটু এগোতেই ট্রাম্প সাহেবের সাদা বাড়ি হাত নেড়ে যেন কাছে টানতে থাকে। এর মধ্যে আমিনুল আর শাহরিয়ারও খুঁজতে খুঁজতে একটা ফ্রি পার্কিং পেয়ে যায়। ভেবেছিলাম, কোনোমতে দু-চারখানা ছবি তুলে পালাব। কিন্তু না, শেষরক্ষা হলো না। হোয়াই হাউসের ফার্স্ট লেডির চোখ এড়াতে পারলাম না। আমাদের দেখেই সবিনয় অনুরোধে থাকতে বলেন।বলি, ‘ইওর এক্সেলেন্সি, উই কুড নট অ্যাকসেপ্ট ইওর করডিয়াল ইনভিটেশন ডিউ টু পেনডেমিক।’

সাদা বাড়ি থেকে ফেরার সময় ছোট্ট আয়ান কিছুটা ক্লান্ত হয়ে পড়ে; যার রেশ গিয়ে পড়ে খানিকটা আমার কাঁধে। আমিনুল জানায়, ‘ভাই, আমরা গাড়ির ভেতর থেকে লিংকন মিউজিয়ামের পাশ দিয়ে যেতে যেতে দেখব।’ ততক্ষণে শাহরিয়ার ভার্জিনিয়ার রিচমন্ড স্ট্রিটের নেভিগেশনটা ফিক্স করে নিয়েছে। ওয়াশিংটন ডিসি থেকে বের হতে হতে বারবারই চোখ জোড়া যেন স্থির হয়ে যায় আকর্ষণীয় কারুকার্যখচিত একেকটা ভবনের ওপর।

ওয়াশিংটন ডিসি মিউজিয়াম প্রিমাইসেস লেকে পাখির অভয়ারণ্য দৃশ্যে মুগ্ধ দর্শনার্থী
ছবি: লেখক

ডিসি ছেড়ে যখন ভার্জিনিয়ার পথে, তখন বেলাটা পশ্চিমে নুয়ে পড়েছে। আকাশের বুকে ছোট ছোট সাদা মেঘের দল ঘুরে বেড়াচ্ছে। সূর্য কখনো এক-আধটু উঁকিঝুঁকি দিয়ে আবার আড়ালে চলে যাচ্ছে। পড়ন্ত বিকেলে আলো–ছায়ার লুকোচুরি দেখতে দেখতে কেমন করে যেন ঘণ্টা তিনেকের ড্রাইভ শেষ হয় পলাশ ভাইয়ের বাগানবাড়ির কোল ঘেঁষে। আমিনুল আগেই ভাইকে জানিয়ে রেখেছিলেন যে আমরা মিনিট দশেকের বেশি দেরি করব না। কিন্তু ফারজানা আপুর আয়োজন উপেক্ষা করে সাধ্য কার! মনে হচ্ছিল বহুদিন পর দেশের মাটিতে কোনো এক স্বজনের বাসায় চা-আড্ডায় নিজেকে হারিয়ে ফেলেছি। দীর্ঘ পথের টানে একটা সময় অনেকটা অনিচ্ছায় যেন উঠতে হলো।

পলাশ ভাইয়ের বাসা থেকে যখন বের হই, তখনো ৯ ঘণ্টার পথ পড়ে আছে। বেলাটা তখনো ঝুলে ছিল সবুজ বৃক্ষের মাথার ওপর। দেখতে দেখতে একটা সময় দিনের আলো মিইয়ে আসে। ব্যস্ত সড়কের বুকে ছুটে চলা গাড়ির ব্যাকলাইটগুলো জ্বলে উঠতে থাকে হুতুম প্যাঁচার চোখের মতো।

দীর্ঘ পথ। ব্যস্ত সড়ক। কখনো পাঁচ, কখনো তিন লেনের সড়ক ধরে ছুটে চলছে কত দুরন্ত জীবন। এমন ছুটে চলা দেখতে দেখতে চোখ জোড়া বড় ক্লান্ত হয়ে আসে। চলার মাঝে ছেড়ে আসি কত স্টেট, শহর, ভুট্টাখেত আর ঘন সবুজ বন। ফিলাডেলফিয়া ছেড়ে মেরিল্যান্ড, সেখান থেকে ভার্জিনিয়া, ভার্জিনিয়া হয়ে নর্থ ক্যারোলাইনা।

ওয়াশিংটন ডিসি মিউজিয়াম প্রিমাইসেস লেকে পাখির অভয়ারণ্যে লেখকের পুত্র আয়ান
ছবি: লেখক

সাউথ ক্যারোলাইনায় এসে একটা গ্যাসস্টেশনে বিরতি নিই। সবাই ফ্রেশ হলে সঙ্গে আনা খাবার পেটে দ্রুত চালান করে আবার পথে নামি। শাহরিয়ার ঝিম ধরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ড্রাইভ করে চলেছে শত শত মাইল। এক অদ্ভুত এনার্জির মানুষ সে। দীর্ঘ সময় পর পেটে দানাপানি পড়ায় সবাই একটু ফুরফুরে হয়ে ওঠে। এর মধ্যে আমিনুল বলে, ‘কী গান শোনা যায়?’ সানাম বলে, ‘ভাইয়া, অর্থহীনের এপিটাফ।’ ব্যাকবক্সে মৃদু শব্দে সুর ওঠে ‘বৃষ্টি নেমেছে আজ আকাশ ভেঙে...।’ শুনতে শুনতে কখন যে রাতের ওই দূর আকাশের গায়ে ভেসে চলা কালো মেঘের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলাম টের পাইনি। খানিক পরে সবুজ প্লে করে জন ডেনভারের কান্ট্রি রোড: ‘টেক মি হোম টু দ্য প্লেস আই বিলং...।’

দীর্ঘ পথ। ব্যস্ত সড়ক। কখনো পাঁচ, কখনো তিন লেনের সড়ক ধরে ছুটে চলছে কত দুরন্ত জীবন। এমন ছুটে চলা দেখতে দেখতে চোখ জোড়া বড় ক্লান্ত হয়ে আসে। চলার মাঝে ছেড়ে আসি কত স্টেট, শহর, ভুট্টাখেত আর ঘন সবুজ বন। ফিলাডেলফিয়া ছেড়ে মেরিল্যান্ড, সেখান থেকে ভার্জিনিয়া, ভার্জিনিয়া হয়ে নর্থ ক্যারোলাইনা।

তখন গভীর রাত। আকাশের গায়ে কখনো কালো কখনো বা হালকা সাদা মেঘের ছোটাছুটি। রাতের শেষ বলেই গাড়ির সংখ্যাটাও অনেক কমে এসেছে। সড়কের ওপর সোডিয়ামের মিটিমিটি আলো। এক অদ্ভুত সৌন্দর্য। লেন ধরে ছুটে চলা দূরের গাড়িগুলো পেছন থেকে দেখতে ঠিক যেন একেকটা উড়ন্ত জোনাকি।

এক-দুই ঘণ্টা পরপরই এবড়োখেবড়ো টপোগ্রাফি। সে জন্যই হয়তো খানিক পরপর ঢেউ খেলানো পথ ধরে ছুটে চলা। সামনে থাকা গাড়িগুলো একটু পরপর মই বেয়ে যেন ওঠে যায় আকাশের গায়ে। আবার পর মুহূর্তেই ধপ করে যেন হারিয়ে যায় কোনো এক অতল দেশে। সেই অতল দেশ থেকে আবার খানিক পরেই ভেসে ওঠে দূরন্ত হয়ে। সে এক অদ্ভুত অনুভূতি!

সাউথ ক্যারোলাইনা ছেড়ে তখন জর্জিয়ার ওপর দিয়ে ছুটে চলেছি; শাহরিয়ারকে বললাম, আমরা কি আটলান্টার ওপর দিয়ে যাব? ও বলল, জ্বি ভাই, তখন থেকেই চোখধাঁধানো আলো দেখার অপেক্ষায় মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে।

চলতে চলতে একটা সময় ক্লান্ত দেহে ঝিমুনি ভর করে। বুজে আসে চোখের পাতা। হঠাৎ চোখ একটুখানি খুলতেই ধাঁধা লেগে গেল। ঠিক তখন মেগাসিটি আটলান্টার বুকের ওপর দিয়ে ছুটে চলেছি। আলোয় ঝলমল করছে। উল্কার মতো জ্বলে আছে একেকটা আকাশছোঁয়া অট্টালিকা। দৃষ্টির সীমানার পুরোটা জুড়েই যেন এক আলোর স্বর্গরাজ্য। দেখতে দেখতে মনে হলো অর্ধেক নগরী তুমি বাকিটা কল্পনা।

চলতে চলতে রাতটা প্রায় শেষ হয়ে এল। কিছুক্ষণের ঘুম শেষে জেগে উঠে দেখি, নিজের সেই ছোট্ট শহরে ঢুকে পড়েছি। শাহরিয়ারকে বললাম, আহ্ তার মানে অবশেষে ফিরে আসা হলো।

কোনোমতে বাক্স প্যাটরা, বউ–বাচ্চা নিয়ে ঘুরে ঢুকি। আমিনুল, সবুজ আর শাহরিয়ারও হাত লাগায়। গাড়ির তলাটা একটু পরিষ্কার করতে গেলে শাহরিয়ার আর আমিনুল বলে, আপনি ঘুমান। আমরা দুপুরের মধ্যে গাড়ি পরিষ্কার করে জমা দিয়ে আসব।’ অজান্তেই মনটা এই ছোট ভাই দুটির জন্য আর্দ্র হয়ে ওঠে। অনেক ভালোবাসায় ওরা এতটা পথ আগলে নিয়ে এসেছে! ভাবি, ওরাই তো আমার আপনজন, আমার স্বজন।

দীর্ঘদিনের জমে থাকা ঝুলটুল কোনোমতে ঝেড়ে বিছানায় শরীর রাখতেই তলিয়ে যাই ঘুমের অতলে।

লেখক: পিএইচডি গবেষক, অবার্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও সহকারী অধ্যাপক, শাবিপ্রবি, আলাবামা, যুক্তরাষ্ট্র