হংকংয়ে আসলে কী হচ্ছে

ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো আজকাল হংকংয়ের ব্যাপারে ব্যাপকভাবে সরব। ‘হংকংয়ের মৃত্যু ঘটেছে’ এ–সংক্রান্ত শিরোনাম আজকাল প্রায়ই দেখা যায়। একসময়ের জমজমাট ব্রিটিশ কলোনি, প্রাচ্যের লন্ডনখ্যাত হংকং আস্তে আস্তে এখন নিতান্তই আরেকটি চীনা শহরে পরিণত হচ্ছে। কেন্দ্রীয় সরকার স্বায়ত্তশাসিত হংকংয়ের চিত্র পরিবর্তন করে তাদের একচ্ছত্র প্রভাব বিস্তার করছে। শহরের গণতন্ত্রকামীদের টুঁটি চেপে ধরা হয়েছে, ভিন্নমতাবলম্বীদের কণ্ঠরোধ করা হয়েছে এবং বিদ্রোহী পত্রিকাগুলোর ওপর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে বা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। হংকংবাসী এই শহরের কোনো ভবিষ্যৎ দেখতে না পেয়ে দলে বলে অভিবাসনের দিকে ঝুঁকছে। এতক্ষণ যা বললাম, তা সবই হলো পশ্চিমা গণমাধ্যমের চিন্তাধারা। কিন্তু পুরো ব্যাপারটা কি এতই সহজ? একজন বিদেশি হিসেবে, হংকংয়ে প্রায় এক যুগ বাস করে আমার একটি স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ মতামত তৈরি হয়েছে, এখানে আমি সেই বিষয়েই আলোচনা করতে চাই।

হংকংয়ের বিষয়ে চীন কেন এত স্পর্শকাতর, তা বুঝতে হলে একটু অতীতে ফিরে যেতে হবে। ব্রিটিশরা কীভাবে হংকংয়ের শাসনভার নিয়েছিল, সেটাও বুঝতে হবে।

ঐতিহাসিক এবং জাতিগতভাবে, হংকং বরাবরই চীনের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। ১৮৪১ সালে প্রথম আফিম যুদ্ধে ব্রিটিশরা চীনাদের পরাজিত করে এবং ফল হিসেবে হংকং ভূখণ্ডের একাংশ (যা হংকং আইল্যান্ড নামে পরিচিত) চুক্তির মাধ্যমে নিয়ে নেয়। এই যুদ্ধের মূল কারণ ছিল ব্রিটিশদের অবাধ আফিমের ব্যবসা এবং এর ফলে সমাজে বেড়ে যাওয়া আসক্তি ও বিশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে তৎকালীন চীনা সরকারের অবস্থান গ্রহণ। পরে ১৮৪২ থেকে ১৮৯৮ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে ব্রিটিশরা বিভিন্ন যুদ্ধ এবং নানা কৌশলে পর্যায়ক্রমে সম্পূর্ণ হংকংয়ের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। সর্বশেষ পিকিং চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ১৮৯৮ সালের ১ জুলাই। এর মাধ্যমে ব্রিটিশরা চীনাদের কাছ থেকে ‘নিউ টেরিটোরিজ’ ৯৯ বছরের জন্য লিজ নেয়। উল্লেখ্য, হংকংয়ের বাকি দুটো অংশ (হংকং আইল্যান্ড এবং কাউলুন পেনিনসুলা) তারা আজীবন শাসন করার অধিকার পেয়েছিল। চীন তখনো আজকের পরাশক্তি হয়ে ওঠেনি। দারিদ্র্য এবং অশিক্ষায় তারা তখনো জর্জরিত। তবে চীনারা কখনো কিছু ভোলে না। এই ৯৯ বছরের চুক্তিটিই পরে হংকংয়ে ব্রিটিশদের দেড় শ বছরের শাসনে দাঁড়ি টানে।

ছবি: সংগৃহীত

দখলের পর থেকেই ব্রিটিশরা হংকংকে একটি বাণিজ্যিক এবং অর্থনৈতিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে থাকে। হংকং কোনো দিন চীনাদের ফিরিয়ে দিতে হবে, এই চিন্তা সম্ভবত কখনোই তাদের মাথায় আসেনি। অন্য সব উপনিবেশের মতোই এখানেও তারা নিজেদের সর্বশ্রেষ্ঠ মনে করত। হংকংয়ের অনেক অভিজাত এলাকায় তখন স্থানীয়েরা প্রবেশ করতে পারত না, ১৯৬৭ সালে ঘটে যাওয়া উপনিবেশবিরোধী দাঙ্গা তারা কঠোরভাবে দমন করেছিল। মোট কথা, বর্তমান প্রেক্ষাপটে ব্রিটিশ রাজনীতিবিদেরা হংকংবাসীদের অধিকার গেল গেল বলে রব তুললেও, সেই সময় তারা কিন্তু ছিল শুধুই শাসক।

অবশেষে এল ১৯৮৪ সাল। তৎকালীন চীন সরকার ব্রিটিশ সরকারকে মনে করিয়ে দিল যে ৯৯ বছরের চুক্তি শেষ হতে আর মাত্র অল্প কিছু বছর বাকি। থ্যাচারের ব্রিটেন তখন অর্থনীতির নিম্নগামিতা আর ফকল্যান্ড যুদ্ধের ভারে পর্যুদস্ত। অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাদের ‘সিনো ব্রিটিশ জয়েন্ট ডিক্লেয়ারেশন’ স্বাক্ষর করতে হলো। যেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সূর্য কখনো অস্ত যেত না, তাদেরই চীনের কাছে মাথা নত করতে হলো। ব্রিটিশরা চাইলেও হংকং রাখতে পারত না, কারণ ‘নিউ টেরিটোরিজ’ (যা কিনা হংকংয়ের ভূখণ্ডের সিংহভাগ) ছাড়া হংকংয়ের অস্তিত্ব বজায় রাখা কার্যত অসম্ভব ছিল। তা ছাড়া চীনও তখন সেই ঊনবিংশ শতাব্দীর চীন ছিল না, কমিউনিস্ট পার্টির শাসনে তখন তাদের উত্তরোত্তর উন্নতি ঘটছে। ব্রিটিশরা না চাইলেও, চীনা সৈন্যরা জোর করে সম্পূর্ণ হংকংয়ের দখল নিতে তখন সক্ষম। ফলে আর কোনো উপায় না পেয়ে, ব্রিটিশ সরকার হংকংকে চীনের কাছে পরিপূর্ণভাবে ফিরিয়ে দিতে রাজি হলো। বলা বাহুল্য, তখন কিন্তু কেউ হংকংবাসীর মতামত জানতে চায়নি।

১ জুলাই ১৯৯৭ সালে চুক্তি অনুযায়ী ব্রিটিশরা কিছু শর্ত সাপেক্ষে হংকংকে হস্তান্তর করল। দুই পক্ষের আলোচনা এবং দর–কষাকষির ফলে লেখা হলো ‘বেসিক ল’ যা অনেকটাই হংকংয়ের সংবিধানের কাজ করে। এই সংবিধান অনুযায়ী, আগামী ৫০ বছর হংকং ‘এক দেশ দুই নীতিতে’ চলবে এবং অন্তত ২০৪৭ সাল পর্যন্ত হংকংয়ের স্বায়ত্তশাসন বজায় থাকবে। এখানে দুটি ব্যাপার উল্লেখ্য, এই ‘বেসিক ল’–এর চূড়ান্ত ব্যাখ্যার অধিকার দেওয়া হলো কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে এবং ৫০ বছর শেষে হংকংয়ের কী হবে, সে বিষয়েও স্পষ্ট কিছু উল্লেখ ছিল না। যাওয়ার সময়, ব্রিটিশরা হংকংয়ের বাসিন্দাদের সরাসরি ব্রিটিশ নাগরিকত্ব নয়, বরং ‘ব্রিটিশ ন্যাশনাল ওভারসিজ’ নামে একটি ‘ট্রাভেল ডকুমেন্ট’ দিয়ে যায়, যা কোনোভাবেই নাগরিকত্বের সমান নয়। অর্থাৎ, মুখে মুখে হংকংবাসীর প্রতি তাদের ভালোবাসার কোনো কমতি না থাকলেও হস্তান্তরের পুরো প্রক্রিয়ায় তারা এই শহরের বাসিন্দাদের প্রতি দায়িত্বশীলতার তেমন কোনো নজির রেখে যায়নি। বরং আইনগত অনেক ফাঁকফোকর তারা রেখে গেছে, যা আজ পর্যন্ত বিভেদ এবং দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে চলেছে। এ পুরো প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত এবং অবহেলিত ছিল হংকংবাসী, যারা দীর্ঘদিনের ব্রিটিশ শাসনে অভ্যস্ত ছিল, কিন্তু একটি স্বাক্ষরিত চুক্তি তাদের পরিচয় রাতারাতিভাবে বদলে দিল। এই যে একটি আত্মপরিচয়ের সংকট, তা আজও হংকংবাসীর জন্য একটি বড় অস্বস্তির বিষয়। ১৯৮৪ থেকে ১৯৯৭ পর্যন্ত বহু লোক হংকং ছেড়ে বিভিন্ন পশ্চিমা দেশের উদ্দেশে পাড়ি জমায়—ব্রিটেন, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য। চারদিকে সেই একই হই হই রব ওঠে যে হংকংয়ের মৃত্যু ঘটেছে। কেন্দ্রীয় চীন সরকারের অধীনে শহরের অর্থনৈতিক কাঠামো ধসে পড়বে, সবার সমস্ত অধিকার তিরোহিত হবে। তখন চীন মাত্র পশ্চিমা দেশগুলোকে টেক্কা দিতে শুরু করেছে, কাজেই হংকংকে ‘মৃত’ দেখিয়ে মূলত চীনকে হেয় করাই তখন পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোর উদ্দেশ্য ছিল, এ যেন অনেকটা ‘ঝি–কে মেরে বউকে শেখানো’।

তবে সত্যি কথা হলো, হংকং তখনো কিন্তু ধ্বংস হয়ে যায়নি। কোনো মার্কিন বা ব্রিটিশ ব্যবসাও হংকং ছেড়ে যায়নি। মূল চীনা বাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে হংকংয়ের ব্যাংকিং এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থার যে বিকল্প নেই, সেটা যেকোনো ব্যবসায়ীই বুঝবে। হংকংয়ের মৃত্যু তো দূরের কথা, বরং ১৯৯৭ থেকে এই শহরের উত্তরোত্তর বৃদ্ধি ঘটেছে, যা অনেকটাই চীনের প্রবৃদ্ধি এবং অন্তর্জাতিকীকরণের সঙ্গে সম্পর্কিত।

এ মুহূর্তে পশ্চিমা বিশ্বের সবচেয়ে বড় অভিযোগ হলো ২০২০ সালের ১ জুলাই কার্যকর হওয়া ‘ন্যাশনাল সিকিউরিটি ল’ বা জাতীয় নিরাপত্তা আইন। মূলত ২০১৯ সালে সরকারবিরোধী বিক্ষোভের প্রতিক্রিয়ায় আইনটি প্রণীত হয়েছে। বিক্ষোভকারীদের অনেক দাবির প্রতিই আমি সহানুভূতিশীল ছিলাম, তবে আন্দোলনের সময় অনেকেই তখন নির্বিচার শহরজুড়ে অগ্নিসংযোগ ও তাণ্ডবলীলা চালিয়েছে, হংকংয়ের সংসদ ভবনে হামলা চালিয়েছে এবং চীনের জাতীয় পতাকা পুড়িয়েছে। যে ‘অ্যাপল ডেইলি’ বন্ধ হয়ে যাওয়া নিয়ে এত হই চই, তার কর্ণধার জিমি লাই তখন দিনের পর দিন মার্কিন এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পার্লামেন্টে চীন এবং হংকংয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রচার চালিয়েছেন। এ মুহূর্তে যারা এই আইনের আওতায় বিচারাধীন, তাদের অনেকেই ২০১৯ সালে প্রকাশ্যে চীনা পতাকা পুড়িয়েছেন এবং যুক্তরাজ্যের পতাকা উড়িয়ে হংকংকে চীন থেকে বিচ্ছিন্ন করার স্লোগান দিয়েছেন।

ছবি: সংগৃহীত

প্রসঙ্গত, বলে রাখি, এ আইনে যে অপরাধগুলোর কথা সুস্পষ্টভাবে বলা আছে, সেগুলো হলো—বিচ্ছিন্নতাবাদ বা হংকংয়ের স্বাধীনতার ডাক দেওয়া, চীনের কেন্দ্রীয় বা হংকং সরকারকে উৎখাতের ষড়যন্ত্র করা, চীন ও হংকংয়ের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক প্রচার চালানো বা বিদেশি শক্তির সঙ্গে যোগসাজশ করে চীন বা হংকংয়ের নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলা।

সত্যি কথা বলতে গেলে, এ ধরনের আইন পৃথিবীর বহু দেশেই ভালো আছে। যে যুক্তরাষ্ট্র এ আইনের নজির টেনে হংকংয়ের সরকারকে ‘শাস্তি’ দিতে চায়, সেই দেশেই এর চেয়ে অনেক কঠোর নিরাপত্তা আইন খুঁজে পাওয়া যাবে। এমনকি যে সিঙ্গাপুরকে হংকংয়ের বিকল্প হিসেবে ধরা হয়, সেখানকার ‘সিকিউরিটি আইন’ (১৯৬০ সালে প্রণীত, ১৯৮৫ সালে হালনাগাদকৃত) হংকংয়ের এই আইনটির তুলনায় অনেক বেশি কঠোর।
এ আইনটির খুঁটিনাটি এবং প্রয়োগ নিয়ে বিতর্ক থাকতেই পারে এবং হংকং একটি মুক্ত সমাজ বলেই এখানে সেই বিতর্কের অবকাশ রয়েছে। কিন্তু বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিচারের আওতায় আনা বা দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে পদক্ষেপ নেওয়াকে যদি কেউ হংকংকে মৃত্যু বলে আখ্যায়িত করে, তবে সেটি অতিরঞ্জন ছাড়া কিছুই নয়। জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষা যেকোনো দেশেরই মৌলিক অধিকার এবং চীনও তার ব্যতিক্রম নয়। এই বাস্তবতাকে আন্তর্জাতিক মহলকে যেমন বুঝতে হবে, হংকংবাসীর যে অংশটি আবেগতাড়িত হয়ে চীনের অন্ধবিরোধিতা করে, তাদেরও মনে রাখতে হবে।

*লেখক: মুনিরা রহমান, হংকং