হেমন্ত জন্মশতবর্ষে পাঠশালার অন্তর্জাল আসর

টুকটাক গানের পাশাপাশি প্রথম জীবনে সাহিত্যে মজে ছিলেন এক তরুণ। গল্প লিখতেন। সমসাময়িক কবি–সাহিত্যিক বন্ধুদের নিয়ে রীতিমতো সাহিত্যসভা করতেন নিয়মিত।

তাঁর লেখা ‘একটি ঘটনা’ নামে একটি গল্প ‘দেশ’ পত্রিকায় পর্যন্ত ছাপা হয়েছিল। কিন্তু সাহিত্যিক না হয়ে, হয়ে উঠলেন তিনি সংগীতের মানুষ। শুধু তা–ই না, হয়ে উঠলেন মধ্যবিত্ত বাঙালির সাংগীতিক আইকন। মধ্যবিত্ত বাঙালির সাংগীতিক অন্তরটি তাঁর মতো এত পরিষ্কারভাবে খুব কম সুরকার ও গায়কই অনুভব করতে পেরেছেন।

যথাযথ উচ্চারণ ও স্বরপ্রক্ষেপণ এবং সুরের পরিমিতি প্রয়োগ করে, গায়নরীতির সাবেকিয়ানা থেকে মুক্ত করে তিনি বাংলা গানকে উত্তীর্ণ করেছেন আরেক পর্যায়ে, করে তুলেছেন সমসাময়িক এবং পৌঁছে দিয়েছেন শতকোটি বাঙালির অন্তরে। এই শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।

‘আনন্দধারা’ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের নিজ হাতে লেখা আত্মকথন। সাহিত্যের সঙ্গে একসময় নিবিড় যোগ থাকায় বইটিতে তিনি প্রাঞ্জল গদ্য উপহার দিয়েছেন। এই বইটি ঘিরেই ছিল পাঠশালার আয়োজন। ‘আনন্দধারা’ ১৯৭৫ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় কলকাতার ‘নিউ বেঙ্গল প্রেস’ থেকে। ১৯৮৮ সালে পঞ্চম ও শেষ সংস্করণ বের হওয়ার পর দীর্ঘদিন এটি বাজারে ছিল না। পরে সপ্তর্ষি প্রকাশন থেকে, অভীক চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনায়, নব কলেবরে বের হয় ২০১৩ সালে। হেমন্ত বলছেন, এটা আমার আত্মচরিত নয়। আত্মপ্রচারের জন্যও কলম ধরিনি। তবে এককালে লেখার অভ্যাস ছিল, তাই আমার শিল্পজীবনের নানা অভিজ্ঞতার কথা লিপিবদ্ধ করার চেষ্টা করেছি।

তাও– করতে হয়েছে অনেকের অনুরোধে। আমার এ লেখার উদ্দেশ্য সম্বন্ধে যদি কেউ জিজ্ঞাসা করেন, তো বলব, শিল্পের পথ কণ্টকাকীর্ণ, কুসুমাস্তীর্ণ নয়। সেই হিসেবে ভবিষ্যতের শিল্পীদের কাছে আমার অভিজ্ঞতার মূল্য হয়তো কিছুটা আছে। আসলেই তাই। বইটিতে হেমন্ত তাঁর নিজের অর্জনকে সেভাবে তুলেই ধরেননি বরং অর্জনের পথ যে কতটা কণ্টকাকীর্ণ হয়, তারই গল্প বইটিজুড়ে। একজন শিল্পীর জীবন কতটা ভঙ্গুর, কতটা ঝুঁকির, তা বোঝা যায় বইটি পড়লে। আজ যেই শিল্পীর গান হিট, এর জন্য সবাই ধন্যি ধন্যি করে, কালই একটা ফ্লপের জন্য তাকে ছুড়ে ফেলে দিতে শ্রোতৃকুল বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না। অনেক ভালো কাজ করেও, হিট না হলে, সেসব মূল্যহীন। আবার একবার লাইমলাইটে এসে গেলে, তখন মানহীন সংগীতেরও স্তাবকের অভাব হয় না।

হেমন্ত এক জায়গায় লিখছেন, ‘পরপর ছবি হিট হলে খাতির দেখে কে! কিন্তু একটা ফ্লপ হলেই শিল্পীর দফা শেষ। আমরা নামেই শিল্পী। আসলে আসন দেহপসারিণীদের এক ইঞ্চি উপরেও না। ওদের তবু যত দিন দেহ, তত দিন বাজার। আর শিল্পীদের অনেকের গলা থাকতে থাকতেও গলাধাক্কা খেতে হয় সময়বিশেষে।’ হেমন্ত এই বিষয়গুলোর ব্যাপারে সচেতন ছিলেন বলেই হিন্দি ‘নাগিন’ কিংবা বাংলা ‘শাপমোচন’ চলচ্চিত্রের তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তাতেও বিভ্রান্ত হননি, নিজেকে কেউকেটা ভাবেননি এবং এতেই হয়তো অতটা দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়া সম্ভব হয়েছে তাঁর পক্ষে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের দুটি সত্তা—গায়ক হেমন্ত ও সুরকার হেমন্ত। দুটি সত্তাই সমভাবে প্রবল। দীর্ঘ পাঁচ দশকের বেশি সময়জুড়ে (বাংলা ও হিন্দি) অজস্র গানে কণ্ঠ, অজস্র গানে সুর, অসংখ্য আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি, সেসবের নানা অভিজ্ঞতা আর গল্প মিলে, বহুমাত্রিক সংগীত ব্যক্তিত্ব হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সাংগীতিক জীবনের যে বিশাল ব্যাপ্তি, তা লিপিবদ্ধ করতে গেলে হাজার পাতাতেও কুলাত না। কিন্তু হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গায়ন যেমন পরিমিত-মেদহীন, তেমনি লেখাও। বিস্তীর্ণ সংগীতজীবনের কেবল চুম্বক অংশগুলোই একদম নির্মোহভাবে এবং অকপটে তুলে ধরেছেন তিনি তাঁর আত্মজীবনী ‘আনন্দধারায়’। ‘আনন্দধারা’ মোট ৩১৩ পৃষ্ঠার। এর মধ্যে শ খানেক পৃষ্ঠাজুড়ে আত্মজীবনী। আর বাকি ২১৩ পৃষ্ঠাজুড়ে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গানের তালিকা।

তালিকাটি তৈরি করেছেন জয়দীপ চক্রবর্তী। এই তালিকা নিয়ে রীতিমতো গবেষণা করার সুযোগ আছে। একজন শিল্পীর গড়ে ওঠা, গড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তখনকার সমাজের শিল্পের সামগ্রিক চালচিত্র ও বহু অজানা তথ্য মিলিয়ে একটি প্রয়োজনীয় ও একই সঙ্গে রসসিক্ত গ্রন্থ হলো এই ‘আনন্দধারা’। এই আসরের আলোচক ছিলেন আইএফআইসি ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক খসরু চৌধুরী। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জন্মশতবর্ষে নিবেদিত পাঠশালার আসরে ‘আনন্দধারা’ বইটি নিয়ে আলোচক খসরু চৌধুরীর আলোচনায় উঠে আসে বাংলা, হিন্দি দুই গানেরই গায়ক হেমন্ত, সুরকার হেমন্ত, প্রযোজক হেমন্ত, পরিচালক হেমন্তের নিজ জীবনের গল্পসহ আধুনিক বাংলা গানের স্বর্ণযুগের অনেক জানা-অজানা অধ্যায়। এ আসরের সঞ্চালনায় ছিলেন ফারহানা আজিম শিউলী।