ইউরোপের কথা শুনলে আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষের মাথায় প্যারিস, লন্ডন, বার্লিন, ভিয়েনা, জুরিখ, আমস্টারডাম, মাদ্রিদ, কোপেনহেগেন এ নামগুলো বারবার ঘুরপাক খাবে। এত সব বড় শহরের ভিড়ে ছোট এক শহর পেচের নাম সব সময় অগোচরে থেকে যাবে। কিন্তু আপনি কী জানেন, ২০১০ সালে তুরস্কের ইস্তাম্বুল এবং জার্মানির অ্যাসেনের পাশাপাশি ইউনেসকো–ঘোষিত ইউরোপের কালচারাল ক্যাপিটালের একটি ছিল এ পেচ!
ছোট এ শহরটির অবস্থান পূর্ব ইউরোপের দেশ হাঙ্গেরিতে। বর্তমানে পেচ হাঙ্গেরির পঞ্চম বৃহত্তম শহর এবং হাঙ্গেরির অন্যতম বিভাগ বারানিয়ার প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক কেন্দ্রবিন্দু। হাঙ্গেরিয়ান ভাষায় Pécs লেখা হলেও এর উচ্চারণ করা হয় পেচ। হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্ট থেকে প্রায় ২১০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থান ছোট শহরটির। ম্যাচেক পর্বতের ঢাল ঘেঁষে গোড়াপত্তন হওয়া পেচ শহরটির অবস্থান তাই অনেকটা ক্রোয়েশিয়ার সীমানার কাছাকাছি।
ধারণা করা হয়, দ্বিতীয় শতাব্দীর কোনো একসময় রোমানদের হাতে এ শহরটির গোড়াপত্তন হয়েছিল। তবে রোমানদের আগমনের অনেক আগেই এ জনপদে সেল্টিক ও প্যানোনিয়ান গোষ্ঠীর মানুষদের বসবাস ছিল বলে জানা যায়। চতুর্থ শতাব্দীতে এ শহর ক্যাথলিক খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী মানুষদের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। বিখ্যাত হাঙ্গেরিয়ান কবি ও খ্রিষ্টান ধর্মযাজক ইয়ানুস প্যানোনিয়ুস আধুনিক পেচ শহরের গোড়াপত্তন করেন এবং তিনি এ শহরকে ধর্মচর্চার পাশাপাশি হাঙ্গেরির একটি প্রধান সংস্কৃতি ও শিল্পচর্চার পীঠস্থান হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেন।
আনুমানিক ১৫৪৩ সালের দিকে বিখ্যাত অটোমান সেনাপতি কাশিম পাশা পেচ দখল করেন এবং সেখানে ওসমানী খেলাফতের শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। প্রায় দেড় শ বছর পেচ শহরটির শাসনভার ওসমানী সুলতানদের দ্বারা পরিচালিত হয়েছে। এ সময় পেচকে ওসমানী খিলাফতের স্থাপত্যকলার অনুকরণে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। শহরটির বিভিন্ন স্থানে আজও তার নিদর্শন খুঁজে পাওয়া যায়। ১৬৮৬ সালের দিকে পেচ শহরটি অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ফ্রান্সের ভার্সাই শহরে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্য ভেঙে দেওয়া হয়। পেচকে এ সময় হাঙ্গেরির সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯১৮ সালের অক্টোবর মাসে হাঙ্গেরি একটি গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেলেও এক বছর যেতে না যেতেই প্রতিবিপ্লবের কারণে গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের পথে হাঙ্গেরির এ অগ্রযাত্রা থেমে যায়। সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যস্থতায় হাঙ্গেরিতে ১৯১৯ সালে কমিউনিস্ট শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হাঙ্গেরি জার্মানির পক্ষে অবস্থান নেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানরা পরাজিত হলে হাঙ্গেরি পরিপূর্ণভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের স্যাটেলাইট রাষ্ট্রে পরিণত হয়। গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত হাঙ্গেরিসহ গোটা পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কমিউনিস্ট শাসনের প্রচলন ছিল। সোভিয়েত যুগে এক ভিন্ন পেচের দেখা পায় পৃথিবীর মানুষ।
সে সময় পেচকে সাজানো হয় কমিউনিস্ট ভাবাদর্শে গড়ে ওঠা এক শহর হিসেবে। আজকের দিনেও পেচের বেশির ভাগ স্থাপত্য সে সাক্ষ্য বহন করে চলছে, যদিও কিছুটা পরিবর্তন আনার চেষ্টা করা হচ্ছে সোভিয়েত আমলে নির্মিত এ সব দালানকোঠার নকশায়। তবে সোভিয়েত যুগে পেচ অর্থনৈতিকভাবে পূর্ব ইউরোপে একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। পেচের কাচ ও সিরামিক শিল্পের অন্য রকম কদর ছিল পুরো কমিউনিস্ট ব্লকের দেশগুলোর কাছে। এ ছাড়া ইউরেনিয়ামের খনি আবিষ্কৃত হওয়ায় সে সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের চোখের মণি হয়ে উঠেছিল ছোট এ শহর।
নব্বই পরবর্তী সময়ে হাঙ্গেরি গণতন্ত্র ও মুক্তবাজার অর্থনীতির পথে পা বাড়ালে পেচ তার জৌলুশ হারাতে থাকে। শহরটির অর্থনীতি একেবারে দৈন্যদশায় পতিত হয় এবং শহরটিতে বাস করা অনেক নাগরিক সে সময় বেকার হয়ে যান। অনেকে পেচ ছেড়ে চলে যান রাজধানী বুদাপেস্টসহ আশপাশের বিভিন্ন দেশের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতে। ২০০৮ সালে সৃষ্ট বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা যেন সবকিছুতে ‘মরার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দাঁড়ায়। ২০১০ সালে হাঙ্গেরির সরকার যদিও শহরটিকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করে, তবে সেসব উদ্যোগ আলোর মুখ দেখেনি।
২০১০ সালে ইউনেসকোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের তালিকায় স্থান পাওয়া এ শহরের স্থানীয় মানুষের জীবনযাত্রা, সংস্কৃতি এমনকি বিভিন্ন শিল্পকর্ম ও স্থাপত্যশৈলীতে প্যাগান থেকে শুরু করে রোমান, তুরস্কের ওসমানী খেলাফত, অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্য, কমিউনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়ন সবকিছুর ছোঁয়া লক্ষণীয়। এ জন্য ইউরোপের অন্যতম সাংস্কৃতিক রাজধানীর তালিকায় শহরটি স্থান পেয়েছে।
হাঙ্গেরির রাজা প্রথম লুইস, যিনি একই সঙ্গে ক্রোয়েশিয়ার রাজা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন, তিনি ১৩৬৭ সালের দিকে পেচে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। হাঙ্গেরির ইতিহাসে এটি প্রথম কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এবং একই সঙ্গে রেনেসাঁ পরবর্তী ইউরোপের অন্যতম প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে এটি ‘ইউনিভার্সিটি অব পেচ’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। প্রায় ৬৫০ বছরের বেশি বয়সী এ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবছর বর্তমানে হাঙ্গেরি ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করতে আসেন। তাই হাঙ্গেরির বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ওরবান ভিক্টর পেচকে ‘স্টুডেন্ট সিটি’ হিসেবে সাজানোর ঘোষণা দিয়েছেন। বাংলাদেশ থেকেও বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী বর্তমানে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন।
পর্যটকদের জন্য পেচের প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে পেচ ক্যাথেড্রাল, টিভি টাওয়ার, সোলনাই কালচারাল কোয়ার্টার, সেচেনি স্কয়ার, পাশা কাশিম মসজিদ এবং ম্যাচেক পর্বতমালা। টিভি টাওয়ারটি কমিউনিস্ট যুগে হাঙ্গেরির একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্প্রচারকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল, বর্তমানে সে অর্থে আর এ টিভি টাওয়ারটির কার্যকারিতা নেই। তবে পেচ ক্যাথেড্রালটি মনোরম স্থাপত্যশৈলীর এক অসাধারণ নিদর্শন, বিশেষ করে এর অন্দরসজ্জা সত্যি চোখধাঁধানো কারুকার্যে শোভিত। পেচ শহরে অটোমান শাসনামলে নির্মিত দুটি মসজিদ রয়েছে। এদের মধ্যে পাশা কাশিম মসজিদটিকে বর্তমানে ক্যাথলিক চার্চে পরিণত করা হয়েছে এবং অন্য মসজিদটি, অর্থাৎ ইয়াকোভালি হাসান মসজিদটি কেবল জুমার নামাজ ও দুই ঈদের নামাজের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।
বর্তমানে হাঙ্গেরি যেহেতু ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্য এবং একই সঙ্গে সেনজেন তালিকার অন্তর্ভুক্ত, তাই সেনজেনভুক্ত যেকোনো দেশের ভিসা কিংবা টেম্পোরারি রেসিডেন্ট থাকলে আপনি হাঙ্গেরিতে ভ্রমণ করতে পারবেন। রাজধানী বুদাপেস্টের কেলেতি পালইয়ুদভার কিংবা কেলেনফোল্ড থেকে ইন্টারসিটি ট্রেনে পেচে যাওয়া যায়। খরচ পড়ে সাড়ে চার হাজার হাঙ্গেরিয়ান ফরেন্ট, অর্থাৎ প্রায় ১৭০০ বাংলাদেশি টাকা এবং বুদাপেস্ট থেকে ট্রেনে পেচ পৌঁছাতে সময় লাগে তিন থেকে চার ঘণ্টা। যদি কেউ হাঙ্গেরি ভ্রমণের পরিকল্পনা করেন, তাহলে বুদাপেস্ট ও থার্মাল লেক বালাটনের পাশাপাশি পেচও একবার ঘুরে আসতে পারেন।
লেখক: শিক্ষার্থী, ব্যাচেলর অব সায়েন্স ইন ফিজিকস অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিকস, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়া