অথচ ওর সংগ্রামের গল্পটাও ছাপা হতে পারত

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মালবাহী ট্রাকের ধাক্কায় নিহত মাহমুদ হাবিব হিমেলকে নিয়ে লিখেছেন তাঁর বন্ধু—মৃৎশিল্প ও ভাস্কর্য বিভাগের শিক্ষার্থী এস এম ওয়ালিউর রাফি
নিজের করা কাঠের কারুকাজের সঙ্গে মাহমুদ হাবিব
ছবি: সংগৃহীত

ঘটনাটা অন্য রকমও হতে পারত। হয়তো সকালবেলা আমরা ছুটে যেতাম শহীদ শামসুজ্জোহা হলে। হিমেলকে বলতাম, ‘দ্যাখ দ্যাখ, পত্রিকায় তোর নাম ছাপা হয়েছে! তোর ছবি ছাপা হয়েছে!’ তেমনটা হয়নি। আমার বন্ধু মাহমুদ হাবিব, অর্থাৎ হিমেলের নাম ও ছবি দেশের সব কটি পত্রিকায় ছাপা হয়েছে ঠিকই। সব কটি নিউজ চ্যানেলেও ঘুরেফিরে এসেছে, কিন্তু তার মেধা, সৃজনশীলতা, কিংবা পরিশ্রমের জন্য নয়।

হিমেলের এই অলংকরণ করেছেন তাঁর সহপাঠী শাহরিয়ার কনক
ছবি: সংগৃহীত

মালবাহী ট্রাকের ধাক্কায় হিমেল মারা গেছে আমাদের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে, আমাদেরই ক্যাম্পাসে! যে ক্যাম্পাসকে আমরা আমাদের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা মনে করি। দিন নেই, রাত নেই, দল বেঁধে ঘুরে বেড়াই, আড্ডা দিই। ক্যাম্পাস তো আমাদের ঘরের মতোই। সেই ঘরেই কিনা এমন দুর্ঘটনার শিকার হতে হলো হিমেলকে।

চারুকলা অনুষদের গ্রাফিক ডিজাইন কারুশিল্প ও শিল্পকলার ইতিহাস বিভাগের ছাত্র ছিল সে। দুদিন আগেও যাঁর সঙ্গে ওঠাবসা করেছি, আজ তাঁকে নিয়েই স্মৃতিচারণা করছি। এখন বিশ্বাস হচ্ছে না, হিমেল আর কখনো আমাদের মাঝে আসবে না।

হিমেলের সহপাঠী আল মুহতামিমের আঁকা ছবি
ছবি: সংগৃহীত

ওর বাবা আর দাদিও সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন। ২০১৯ সালে হিমেলের দাদি আমেনা বেওয়া বাসচাপায় মারা যান। এর আগে ২০১৫ সালে হিমেলের বাবা আহসান হাবীব ও মা মুনিরা আক্তার দুর্ঘটনার শিকার হন। পরে ২০১৬ সালে দুর্ঘটনা–পরবর্তী জটিলতায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান হিমেলের বাবা। বাবার মৃত্যুর পর তিনবেলা কীভাবে দুমুঠো ভাত জুটবে, কীভাবে চলবে লেখাপড়ার খরচ, এসবও ভাবতে হয়েছে আমার বন্ধুটিকে। অসুস্থ মায়ের দায়িত্বও ছিল তাঁর কাঁধে।

এতসব প্রতিকূলতায় ওকে কখনো হাল ছেড়ে দিতে দেখিনি। আমরা যারা কাছের বন্ধু ছিলাম, আমাদের কখনো বুঝতে দেয়নি ওর কষ্ট। ও মিশুক ছিল, সদালাপী ছিল। সব সময় মুখে হাসি লেগে থাকত। লেখাপড়ার পাশাপাশি নাট্যচর্চা, সংগীতচর্চা, রাজনীতি—সবকিছুতেই আমরা ওকে পেয়েছি। অসম্ভব সুন্দর ছিল ওর গানের গলা। চারুকলার বিভিন্ন কাজের মধ্যে ট্যাপেস্টি বোনা, উডকোলাজ, ওয়াল পেইন্টিং, পোর্ট্রেট, ওয়াটার কালার ইত্যাদিতে ছিল তার দারুণ দক্ষতা।

সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিবাদে এই ছবি এঁকেছেন রাবির শিক্ষার্থী প্রশান্ত মন্ডল
ছবি: সংগৃহীত

মাঝেমধ্যে ছোট ছোট কবিতাও লিখত। সব সময় কোনো না কোনো কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখত। কখনো টিউশনি, কখনো চাকরি, ব্যবসা। যখন যেটা পারত, সেটা করেই নিজের খরচের পাশাপাশি সংসার চালাত। অসুস্থ মায়ের চিকিৎসা কীভাবে হবে, ভেবে ওর কপালে চিন্তার ভাঁজ দেখেছি কখনো কখনো। তাই কিন্ডারগার্টেন স্কুলের চাকরি থেকে শুরু করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বিপণনের কাজ, নানা কিছু সে করেছে। এত ব্যস্ততার মধ্যেও আমাদের আড্ডায় আমরা সব সময় উচ্ছল–প্রাণবন্ত হিমেলকেই পেয়েছি। ক্যাম্পাসের সাংস্কৃতিক সংগঠনে ওর সম্পৃক্ততা ছিল। রাজশাহী ইউনিভার্সিটি ড্রামা অ্যাসোসিয়েশনে সে ছিল দপ্তর সম্পাদক। মঞ্চ নাটকও করেছে।

যে স্বপ্ন নিয়ে ও ক্যাম্পাসে এসেছিল, সব বাক্সবন্দী হয়ে ফিরে গেছে। গাঢ় রঙের পাঞ্জাবি আর সাদা শাল ছিল ওর প্রিয় পোশাক। প্রিয় পোশাকে প্রিয় বন্ধুর হাসিমুখটা আমাদের মনে থাকবে আজীবন।