জীবনচলার পথে একজন মানুষের সান্নিধ্য পেয়ে আমি হয়েছি সৌভাগ্যবান, ধন্য ও গর্বিত। তিনি ছিলেন ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের বাটলার (মেস ওয়েটারদের তত্ত্বাবধায়ক) আমাদের প্রিয়, শ্রদ্ধেয় আবুল কাশেম ভূঁইয়া। আমাদের ভূঁইয়া ভাই। যিনি নিজে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার তেমন সুযোগ না পেলেও সাত সন্তানকে উচ্চশিক্ষিত করে তুলেছেন।
কে এবং কেমন ছিলেন ভূঁইয়া ভাই নামের এই আলোকিত মানুষ? ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলার সায়েদপুরে এক দরিদ্র পরিবারে ১৯৩৯ সালের ১ জুলাই তাঁর জন্ম। বাবা ছিলেন ক্ষুদ্র জমির মালিক। যাতে চাষাবাস করে, না টেকার সংসার কোনোভাবে টিকিয়ে রাখতে হতো। দাদা দুদু মিয়া গ্রামবাসীর সালিসকারী হিসেবে যৎসামান্য উপার্জন করে জীবন অতিবাহিত করেছেন। তিন ভাইবোনের একমাত্র ভাই ছিলেন আবুল কাশেম ভূঁইয়া। মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই মাকে হারিয়ে মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত হন।
প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর বাবা আবুল খায়ের ভূঁইয়া বিয়ে করেন। সেখানে যোগ হয় আরও সাত ভাইবোন। বিশাল ও বিস্তৃত পরিবারের টানাপোড়নের সংসারে যেখানে দুবেলা ভাত জোটানো এক দুঃসাধ্য কাজ, সেখানে স্কুল–কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে ভালো চাকরি খোঁজা আবুল কাশেম ভূঁইয়ার জন্য শুধু স্বপ্নই থেকে যায়। তাই বড় বোন আয়েশা খাতুন তাঁর বিয়ের পর তাঁকে সঙ্গে করে নিয়ে যান কুমিল্লা জেলার বুড়িচং উপজেলায় নিজের শ্বশুরবাড়িতে। বড় বোনের স্নেহে বেড়ে উঠলেও পর্যাপ্ত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি।
১৯৬২ সালে ২৩ বছর বয়সে আবুল কাশেম ভূঁইয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়ার খুরশিদা আখতারকে বিয়ে করেন। ১৯৬৪ সালে তিনি ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজে বাটলার হিসেবে যোগ দেন। চাকরির শেষ তিন–চার বছর ছাড়া কর্মজীবনের প্রায় সবটুকু সময়ই তিনি তাঁর প্রিয় এই ক্যাডেট কলেজে কাটিয়েছেন। ২০২০ সালের ২৮ ডিসেম্বর করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান।
ক্যাডেট কলেজে পড়ার সময় ভূঁইয়া ভাইয়ের অবিশ্বাস্য গুণাবলির সব হৃদয়ঙ্গম করতে না পেরে নিজেকে আজ অপরাধীই মনে হয়। তিনি চলে যাওয়ার পর তাঁর জীবনের কিছু খণ্ডচিত্র তুলে ধরার সুযোগ পেয়ে আজ আমি গর্বিত এবং কিছুটা হলেও তৃপ্ত।
দারিদ্র্য, অবহেলা এবং কুসংস্কারের জাতাকলে পিষ্ট হয়েও ভূঁইয়া ভাই জীবনসায়াহ্নে পৌঁছে পরিপূর্ণতা আর তৃপ্তির হাসি হেসে গেছেন। এটা বড় একটা বিষয়। স্কুল–কলেজের আঙিনায় প্রবেশধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে নিজের সন্তানদের সর্বোচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে তিনি হয়ে ওঠেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তাই কঠোর পরিশ্রম করে, নিজের সব সুখ, আরাম, আয়েশ বিসর্জন দিয়ে সাত সন্তানের প্রত্যেককেই করে তোলেন উচ্চশিক্ষিত। ভূঁইয়া ভাইয়ের ছেলেমেয়েদের পরিচয় একটু দেখে নেওয়া যাক।
দেলোয়ারা বেগম, স্নাতকোত্তর, জ্যৈষ্ঠ শিক্ষক, আজিমপুর গার্লস স্কুল, ঢাকা।
কর্নেল ডা. আঞ্জুমান আরা, আর্মি মেডিকেল কোর, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এমদাদ উল্লাহ ভূঁইয়া, ডেপুটি কমান্ড্যান্ট, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টার, চট্টগ্রাম।
মোহাম্মদ ওবায়দুল্লাহ ভূঁইয়া, স্নাতক। সৌদি আরবের একটি বেসরকারি কোম্পানিতে কর্মরত।
আসমা সুলতানা, স্নাতকোত্তর। শিক্ষক, সৈয়দপুর স্কুল, নীলফামারী।
নাজমুন্নাহার, স্নাতকোত্তর। প্রভাষক, ক্যান্ট. পাবলিক গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ঢাকা সেনানিবাস।
ডা. ফাউজিয়া জাহান, বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ, উত্তরা, ঢাকা।
মানুষের জন্য মানুষ, এই দীক্ষায় গড়ে উঠেছেন এই সাত ভাইবোন। তাঁদের সফলতার মূল উৎসে নিহিত তাঁদের প্রত্যয়। ভূঁইয়া ভাইয়ের সাত সন্তানের দুজন পড়েছেন ক্যাডেট কলেজে। আঞ্জুমান আরাকে ময়মনসিংহ গার্লস ক্যাডেট কলেজ এবং এমদাদ উল্লাহ ভূঁইয়াকে পড়িয়েছিলেন ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজে।
আমরা যারা ক্যাডেট কলেজে পড়েছি, তারা সবাই সেখানে নিজের মা–বাবা, অভিভাবক, নিজের বাড়ি ছেড়ে থাকতাম। অভিভাবকের স্নেহ পুষিয়ে দিতেন আবুল কাশেম ভূঁইয়া। পাঁচ বেলার খাবারের মান যাতে ভালো থাকে, সে ব্যাপারে ছিল তাঁর তীক্ষ্ণ নজর। ঝড়, বৃষ্টি, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া—যা–ই হোক যথাসময়ে ক্যাডেটদের খাবার পরিবেশনে যাতে কোনো সমস্যা না হয়, তা দেখতেন তিনি। সে কারণেই আমার অগ্রজ ও অনুজ সবার কাছেই ভূঁইয়া ভাইয়ের জনপ্রিয়তা ভিন্নমাত্রার।
সহকর্মী ও ক্যাডেটদের যেভাবে ভালোবাসতেন সময় দিতেন, তেমনি আবুল কাশেম ভূঁইয়া পরিবারকেও সময় দিতেন। কাজের সময়ের বাইরে বাসাতেই কাটাতেন। ছেলেমেয়েদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি পারিবারিক শিক্ষা দিয়েছেন সব সময়। তাঁর আয় ছিল সীমিত। তাই সন্তানদের বলতেন ভাইবোনেরা যেন পরস্পরকে প্রতিষ্ঠিত হতে সহায়তা করেন। বাবার আদর্শে সন্তানেরাও তাই করে গেছেন।
যেভাবে নিজ সন্তানদের মানুষের মতো মানুষ করেছেন আবুল কাশেম ভূঁইয়া সেই পথপরিক্রমায় সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিলেন তাঁর স্ত্রী খুরশিদা আখতার। স্বামীর মৃত্যুর মাত্র ৬৯ দিনের মাথায় ৬ মার্চ মারা যান খুরশিদা আখতার। এই দম্পতি এমন এক পরিবারের উদাহরণ আমাদের সামনে রেখে গেলেন, যেখানে শিক্ষা, আদর্শ, সহমর্মিতায় গড়ে উঠেছেন সব সন্তান। নিজে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়েও ভূঁইয়া ভাই সফল হয়েছেন সন্তানদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করতে। তাঁর প্রতি জানাই শ্রদ্ধা।
লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল