ঈদের দিন সেমাই–পায়েসের পাশাপাশি মাংসের নানা পদ রান্না হয়। আর এদের মধ্যে গরু, খাসি, মহিষসহ বিভিন্ন ধরনের লাল মাংসের পদ বেশি প্রাধান্য পায়। রেড মিট (লাল মাংস) পছন্দ করেন না, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। এই লাল মাংস অতিভোজনে শরীরে নানা রোগ বাসা বাঁধতে পারে। তাই মাংস খাওয়ার আগে বুঝে খান।

প্রতিদিন একজন সুস্থ ব্যক্তি কতটুকু প্রোটিন খাবেন, সেটা নির্ভর করে ওই ব্যক্তির আদর্শ ওজনের ওপরে। একজন ব্যক্তির আদর্শ ওজন যদি ৬০ কেজি হয়, তাহলে তিনি প্রতিদিন ৬০ গ্রামের মতো প্রোটিন গ্রহণ করতে পারবেন। কিডনি রোগসহ বিশেষ কিছু রোগ থাকলে পরিমাণ আক্ষরিকভাবে কমতে থাকবে। আবার মেয়েদের মাসিক চলার সময় ও গর্ভাবস্থায় এই প্রোটিনের চাহিদা প্রায় দ্বিগুণ হারে বৃদ্ধি পায়।

লাল মাংস খেতে হবে পরিমিত
ছবি: প্রথম আলো

তবে কারোরই দিনে ৭০ গ্রামের বেশি মাংস খাওয়া উচিত না। গরুর মাংস খাওয়ার নিরাপদ মাত্রা হলো সপ্তাহে দুই দিন বা সপ্তাহে মোট তিন থেকে পাঁচ বেলা। প্রতি বেলায় ঘরে রান্না করা মাংস ১৫ গ্রাম-২৫ গ্রাম বা ২–৩ টুকরার বেশি খাবেন না।

মনে রাখবেন, প্রতি ১০০ গ্রাম লাল মাংসে প্রায় ২৩ গ্রামের মতো প্রোটিন ও ২.৫ গ্রামের মতো ফ্যাট থাকে। কিন্তু কেউ যদি হিসাব মেলাতে প্রতিদিন প্রোটিনের অন্য সব উৎস বাদ দিয়ে ৬০ গ্রামের মতো শুধু লাল মাংস গ্রহণ করেন (৬০ গ্রাম প্রোটিনের চাহিদা পূরণ করতে), এটি তার জন্য মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করবে।

প্রতিদিন একটানা ১০০ গ্রামের বেশি লাল মাংস খেলে হৃদ্‌রোগে মৃত্যুর আশঙ্কা ১৫ শতাংশ, স্ট্রোকের ঝুঁকি ১১ শতাংশ, বৃহদন্ত্র ও প্রোস্টেট ক্যানসারের ঝুঁকি ১৭ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। এ ছাড়া অতিরিক্ত লাল মাংস গ্রহণে কোষ্ঠকাঠিন্য ও গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা হয়। লাল মাংসে থাকা বিশেষ ইনফ্লামেটরি যৌগ পাকস্থলী, ক্ষুদ্রান্ত্র ও বৃহদন্ত্র ক্যানসারের জন্যও দায়ী। এ ছাড়া ফুসফুসের নানা রোগে আক্রান্ত হওয়া, কোলন ও স্তন ক্যানসারে ভূমিকা রাখে লাল মাংস। এমনকি অতিরিক্ত লাল মাংস আর্থ্রাইটিস, গাউট, পেপটিক আলসার, পিত্তথলিতে পাথর, প্যানক্রিয়াস প্রদাহ, কিডনি রোগসহ বিভিন্ন জটিলতা তৈরি করে।

টাটকা লাল মাংসের চেয়ে প্রক্রিয়াজাতকৃত লাল মাংস আরও বেশি ক্ষতিকারক। দৈনিক ৫০ গ্রামের বেশি প্রক্রিয়াজাতকৃত মাংস গ্রহণে হৃদ্‌রোগের ঝুঁকি ৪২ শতাংশ ও ক্যানসারের ঝুঁকি ৬৩ শতাংশ বেড়ে যায়।

শরীরকে সুস্থ–সবল রাখার অন্যতম শর্ত হচ্ছে প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে সুষম খাবার গ্রহণ করা। প্রতিমুহূর্তে শরীরের যেসব কোষ ক্ষয় হচ্ছে, তা পুনর্গঠনের জন্য প্রয়োজন যথাযথ পুষ্টি। সে জন্য পুষ্টির সব উপাদান থেকে সঠিক পরিমাণে খাবার গ্রহণ করতে হবে।

গরুর মাংসের এই ক্ষতিকর দিকগুলোর কথা জেনে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। গরুর মাংসে আছে প্রোটিন, ভিটামিন (বি১, বি৩, বি৬ ও বি১২), জিংক, সেলেনিয়াম, ফসফরাস ও আয়রন। এই পুষ্টি উপাদানগুলোর স্বাস্থ্যগত উপকারিতাও অনেক। সাধারণত কোনো সুস্থ ব্যক্তি সপ্তাহে দুই দিন লাল মাংস গ্রহণ করলে তা তেমন কোনো জটিলতা তৈরি করে না। তবে ডায়াবেটিস, হৃদ্‌রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি জটিলতাসহ অন্য রোগ থাকলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে মাংস গ্রহণ করতে হবে।

নিয়ম মেনে মাংস গ্রহণ ও সঠিক উপায়ে রান্না করলে জটিলতামুক্ত থাকা যায়।

—মাংস রান্নায় দৃশ্যমান জমানো চর্বি বাদ দিয়ে রান্না করতে হবে। কম তেলে রান্না করতে হবে।

—মাংস রান্নার আগে ৫-১০ মিনিট সেদ্ধ করে পানি ঝরিয়ে নিলে চর্বির অংশ অনেকটা কমে যায়। মাংস রান্না করুন উচ্চ তাপে।

—মাংস রান্নার সময় ভিনেগার, টক দই, পেঁপেবাটা ও লেবুর রস ইত্যাদি ব্যবহার করতে পারেন। এতে চর্বির ক্ষতিকর প্রভাব কিছুটা হলেও কমানো সম্ভব।

—যাদের উচ্চরক্তচাপজনিত সমস্যা আছে বা কোমরবিডিটি আছে, তারা একেবারেই না এড়াতে পারলে, বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে এক–দুই টুকরো খেতে পারেন। সে ক্ষেত্রে মাংস রান্নায় সবজি ব্যবহার করতে হবে, যেমন কাঁচা পেঁপে, লাউ, চালকুমড়া, টমেটো কিংবা মাশরুম। মাংসের সঙ্গে সবজি মিশিয়ে কাটলেট বা চপ করেও খেতে পারেন।

—প্রতিবেলায় খাবারের সঙ্গে এক কাপ পরিমাণ শসা, লেবু, টমেটো ইত্যাদির সালাদ রাখতে হবে।

—খাওয়ার কিছু সময় পর লেবুপানি বা টক দই খেলে হজমপ্রক্রিয়া বৃদ্ধিতে সাহায্য করবে।

—মাংস খাওয়ার সময় ঝোল বাদে খাওয়া ভালো। আবার ভুনা মাংসের পরিবর্তে কম তেলে গ্রিল, বারবিকিউ করে বা কাবাব বানিয়েও মাংস খেতে পারেন।

—তিন বেলা মাংসের তৈরি ভারী খাবার না খেয়ে, যেকোনো এক বেলা একেবারেই হালকা খাবার যেমন সবজির স্যুপ, সবজি ও ফলের নানা আইটেম রাখতে পারেন।