ইতিউতি তাকানো উৎসুক চোখগুলোতে রোমাঞ্চ ঝিকমিক করছে। অভিভাবকেরা কেউ বারবার ঘড়ি দেখছেন, কেউবা দেরি হয়ে গেল ভেবে ছুটতে ছুটতে আসছেন। কোনো মা হয়তো ভাবছেন, ‘এই যা! প্রথম দিনই টিফিন বক্সটা নিতে ভুলে গেল!’ আর ভুলে যাওয়া ছেলেটা ভাবছে, ‘পাগল নাকি! প্রথম দিনই কলেজে টিফিন বক্স নিয়ে হাসির পাত্র হব!’ কলেজগেটের প্রহরীরা নির্বিকার মুখে ভিড় সামলাচ্ছেন আর দশটা দিনের মতোই। আর ভেতরে চলছে কচিকাঁচাদের বরণ করে নেওয়ার তোড়জোড়। হ্যাঁ, কচিকাঁচাই তো ওরা। সদ্য গোঁফ উঠেছে কি ওঠেনি। স্কুলের গণ্ডি পেরোনো কুচোগুলোর বড় হওয়ার কী আপ্রাণ চেষ্টা!
প্রতিবছর উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে কলেজে ভর্তির সময় এ রকম দৃশ্যের অবতারণা হলেও এবার সবকিছু অন্য রকম।
নাই–বা হলো নতুন ইউনিফর্ম পরে প্রথম দিনের রোমাঞ্চ নিয়ে ক্লাস শুরু।
নাই–বা হলো নবীনবরণ।
নাই–বা হলো টিফিন-ছুটি।
নাই–বা হলো ক্লাস ফাঁকি কিংবা জমিয়ে আড্ডা।
আমরা যখন বছরের মাঝামাঝি সময়ে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করলাম, প্রথমে দুই পক্ষেরই একটু অসুবিধা হচ্ছিল, যা কাটিয়ে উঠতে বেশি সময় লাগেনি। তারপর থেকে পুরোনো ক্লাসের সুবাসও ফিরে পাচ্ছিলাম কিছু কিছু। যা যা এবং যত রকম দুষ্টুমি ওরা ক্লাসে করত, তার থেকে আরও সৃজনশীল দুষ্টুমির মুখোমুখিও হচ্ছি আমরা। এবার সব ডিজিটাল দুষ্টুমি!
এবার সবাই আমরা এক নতুন পথের পথিক। এই কটা মাস নিঃসন্দেহে আমাদের নতুন ভাবনায় পরিশুদ্ধ হতে বাধ্য করেছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকেও আমরা আমূল বদলে নিয়েছি।
সত্যিই তো এমন শুরু কখনোই কারও হয়নি। এই আমরা অন্য রকম ‘আমরা’। এবার নাহয় নতুন ভাবনা নিয়ে অন্য রকম একটা শুরু করি। চারপাশের মানুষের বেদনা, অসহায়ত্ব এবার যেন আমাদের বিদ্ধ করেছে ভীষণভাবে। এই ‘সময়’ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, শুধু নিজেকে নিয়ে ভাবনার দিন অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। ভোগ, বিলাসিতা, আমিত্ব, অহং, বেহিসাবি স্বেচ্ছাচারিতায় আমরা ডুবে ছিলাম ভীষণভাবে। মোহ মেঘে ঢেকে গিয়েছিল সমস্ত সুকুমার বোধ। বিষয় বাসনায় অন্ধ হয়েছিলাম নির্লজ্জভাবে। প্রকৃতি তাই এবার আমাদের বড্ড কোণঠাসা করে দিয়েছে।
একা কি কখনো ভালো থাকা যায়? না একা ভালো থাকা উচিত? একটা শিঙারা সবাই মিলে ভাগ করে নেওয়ার যে সুখস্মৃতি, সেটাই তো সারা জীবনের সম্পদ! দেব আর নেব, মেলাব আর মিলিব। সব আগল ভেঙে নতুন যৌবনের দ্বারপ্রান্তে যারা আজ উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করে আছ, ভাবছ, ‘এ কেমন শুরু?’ তোমরা নিজেকে বলো, ‘এই দীর্ঘ দগ্ধ দিনগুলোতে আমরা পরিমিতিবোধ শিখেছি। সহমর্মী হতে শিখেছি। সমবেদনা, সহানুভূতি সঞ্চারিত করতে পেরেছি অলিন্দ নিলয়ের সমস্ত প্রকোষ্ঠে।’
এই নতুন পরিস্থিতিতে আমরা দেখলাম, আমাদের ছাত্রছাত্রীরা কত দ্রুত মানিয়ে নিল। শুধু তা–ই নয়, কত রকম যে সৃজনশীল কর্মকাণ্ড করল এবং এখনো করে যাচ্ছে। আমরা যখন বছরের মাঝামাঝি সময়ে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করলাম, প্রথমে দুই পক্ষেরই একটু অসুবিধা হচ্ছিল, যা কাটিয়ে উঠতে বেশি সময় লাগেনি। তারপর থেকে পুরোনো ক্লাসের সুবাসও ফিরে পাচ্ছিলাম কিছু কিছু। যা যা এবং যত রকম দুষ্টুমি ওরা ক্লাসে করত, তার থেকে আরও সৃজনশীল দুষ্টুমির মুখোমুখিও হচ্ছি আমরা। এবার সব ডিজিটাল দুষ্টুমি! ওদের নানা কর্মকাণ্ড দেখে আমি কিন্তু বারবার মুগ্ধ হই।
সাইন ইন করে ক্লাসে ক্যামেরা ও মাইক অফ করে ঘুমিয়ে পড়া যেমন চলছে, আবার ফেসমাস্ক মাখা অবস্থায় কারও ক্যামেরা অন হয়ে গেলে হাসি চাপতে না পারার মতো ঘটনাও ঘটছে অহরহ। পড়া না শিখলে, ‘কানেকশন উইক, শুনতে পাচ্ছি না মিস!’—সেটা তো আছেই। এই ছেলেমেয়েগুলোই যখন নিত্যনতুন ভাবনা নিয়ে এগিয়ে আসছে, ওদের দক্ষতা দেখে বিস্ময়ে হতবাক হতে হয়। সত্যি বলতে কী, এ রকম অবাক হতে বারবার ইচ্ছা করে!
পড়া না শিখে আসা, ক্লাসের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটা; বা বেশি কথা বলার জন্য যাকে বকুনি দিয়েছি—সেই ছেলেটাকেই যখন দেখি কয়েকজন মিলে দুস্থ মানুষের জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাল জোগাড় করছে কিংবা উল্টো আমাকেই বকা দিয়ে বলছে, ‘কম দিলে হবে না কিন্তু মিস, বেশি করে সাহায্য করতে হবে বলে দিলাম’—আমার বড় ভালো লাগে। গোলগাল নাদুসনুদুস সেই ছেলেটা, যাকে দেখতাম বন্ধুরা টিফিনে ভাগ বসাবে বলে ক্যানটিনের পেছনে গিয়ে একা গপাগপ খাবার শেষ করছে, তাকেও যখন দেখি ছিপছিপে এক সুদর্শন তরুণ তুর্কি হয়ে বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে ‘তহবিল সংগ্রহ’ করছে; তখন কি আর কিছু বলার থাকে?
প্রাণটা একেবারে জুড়িয়ে যায়।
বুকটা ফুলে ওঠে গর্বে।
চোখ দুটোও বুজে আসে।
আর গলার কাছটাতে কেমন যেন, কী যেন দলা পাকিয়ে আসে। তখন দুই হাত তুলে সর্বশক্তিমানের কাছে বলতে ইচ্ছা করে, এই দিন দেখার জন্য চোখ দুটো আমার তৃষ্ণার্ত হয়ে ছিল। এমন দিন আরও যেন দেখতে পাই।
‘প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে
মোরে আরও আরও আরও দাও প্রাণ।’
পড়া না শিখে আসা, ক্লাসের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটা; বা বেশি কথা বলার জন্য যাকে বকুনি দিয়েছি—সেই ছেলেটাকেই যখন দেখি কয়েকজন মিলে দুস্থ মানুষের জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাল জোগাড় করছে কিংবা উল্টো আমাকেই বকা দিয়ে বলছে, ‘কম দিলে হবে না কিন্তু মিস, বেশি করে সাহায্য করতে হবে বলে দিলাম’—আমার বড় ভালো লাগে।
নাহয় এবার নাই–বা হলো এক শ ভাগ ঠিকঠাক পড়াশোনা। গ্রেড আর জিপিএ–৫–এর ঘোড়দৌড়টা এবার নাহয় তোলাই থাক। কী হবে এত কিছু করে? শতকরা নব্বই না পেয়ে নাহয় পঁচাশিই পেলাম। বিলেতফেরত কিংবা উঁচু বেতনের তকমা না-ই জুটল কপালে। কী এমন ক্ষতি বৃদ্ধি হবে?
অভিভাবকদের বলি, সন্তানকে যান্ত্রিক অতিমানব, পঙ্গু মানসিকতার না বানিয়ে যদি সহজভাবে নিতে শেখান সবকিছু, তাতে তো আখেরে বাবা মায়েরই লাভ। বৃদ্ধাশ্রমে পাশের বিছানায় খোকার আসার জন্য আর অপেক্ষা করতে হবে না।
প্রিয় অভিভাবক, পড়ার বই তো পড়ছেই, তার সঙ্গে যদি চারটি গল্পের বই লুকিয়ে লুকিয়ে পড়ে, পড়তে দিন। মাঝেমধ্যে ফুটবলের পরিবর্তে তরমুজ দিয়ে খেলতে দিন, যেমন আপনি খেলেছিলেন। একটু ছাড় দিয়েই দেখুন।
তথাকথিত সাফল্য, ইঁদুরদৌড়, জিপিএ–৫—সবকিছুই হয়তো আবার ওদের জীবনে ফিরে আসবে। ঝাঁ–চকচকে গাড়ি–বাড়ির স্বপ্নে আবার হয়তো ওদের বিভোর হতে হবে, আবার হয়তো প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে পঙ্গু হয়ে যাবে, আবার হয়তো কেউ কেউ ফ্রাঙ্কেনস্টাইন হয়ে যাবে ওরা...
তবু বলছি, একটা অন্য রকম সুযোগ যখন ওরা পেয়েই গেছে, অন্য রকম হতে দিয়ে দেখি একটু।
ওরা শিখুক, জানুক, বুঝুক যে শুধুই নিতে হয় না, দুই হাত ভরে উজাড় করে দিতেও জানতে হয়।
‘আমার নাইবা হল পারে যাওয়া।
যে হাওয়াতে চলত তরী
অঙ্গেতে সেই লাগাই হাওয়া।’
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ, ঢাকা