কাল (২ মার্চ) সারা রাত জেগে ছিলাম। রাত ১১টার দিকে প্রচণ্ড শব্দে বিস্ফোরণ হলো পরপর চারটি। পরে আরেকটি। ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের পিচেস্কিরায়ন এলাকায় থাকি। আমার বাড়ির ১০ থেকে ১৫ কিলোমিটারের মধ্যে এই বিস্ফোরণগুলো হলো। এর মধ্যে আছে রেলস্টেশন, দ্রুশবানারো, দারনিৎসা এলাকা। রেলস্টেশনটি নষ্ট করে ফেলার চেষ্টা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গরম পানির সঞ্চালনব্যবস্থাও। তবে পানির সঞ্চালন লাইন দ্রুতই সারিয়ে তোলা হয়েছে।
আমি কিয়েভে আছি আজ ৩১ বছর। মুন্সিগঞ্জের টঙ্গিবাড়ীতে আমার গ্রামের বাড়ি। আমি যেখানে থাকি, এর কাছাকাছি ইউক্রেনের পার্লামেন্ট ভবন। এই এলাকা মোটামুটি সুরক্ষিত আছে। তবে যুদ্ধ শুরুর ছয় দিন পর পার্লামেন্টের কাছাকাছি এলাকায় হামলা হলো। বিস্ফোরণের পরপরই সাইরেনের প্রবল শব্দ। স্ত্রী ও দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে চলে গেলাম সিঁড়ির নিচের বাংকারে। ইউক্রেনের প্রায় প্রতিটি বাড়ি বা ভবনেই এমন ভূগর্ভস্থ আশ্রয়স্থল আছে। সকাল সাতটা পর্যন্ত আমরা সেখানেই ছিলাম। তারপর ঘুমিয়েছি।
বাসার কাছেই একটি স্কুলে আমি চাকরি করি। ভোর চারটায় আমাকে উঠতে হয়। গত বৃহস্পতিবার ভোর পাঁচটার দিকে যখন প্রথম হামলা হলো, তখন স্কুলেই ছিলাম। চারদিক কেঁপে উঠল। কদিন থেকেই তো রাশিয়ার সঙ্গে উত্তেজনা চরমে। হামলা হবে হবে এমন অবস্থা চলছিল। শব্দ শুনে আর টিভি দেখে নিশ্চিত হলাম, শুরু হয়ে গেছে। ওই ভোরেই পরিচিত সবাইকে ফোন করে হামলার বিষয় জানালাম এবং সাবধানে থাকতে বললাম। স্কুলের প্রধান শিক্ষক পিয়নদের মূল ফটক বন্ধ করে দিতে বললেন। সব কাজ বন্ধ হয়ে গেল, সরকারি নির্দেশে স্কুলও বন্ধ করে দেওয়া হলো। বিস্ফোরণের শব্দের বেশ কিছুক্ষণ পর আমরা স্কুল থেকে বের হলাম। রাস্তায় দেখি হাজার হাজার গাড়ি। পোল্যান্ড সীমান্ত বা গ্রামের কোনো নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে ছুটছে মানুষ। আমার স্ত্রী ইউক্রেনীয়। পরিবারের সবাইকে আশ্বস্ত করলাম। বললাম, এই এলাকা আমরা ছাড়ছি না।
সন্ধ্যার পর এখন কারফিউ শুরু হয়। সকালে আবার মানুষের প্রয়োজনের জন্য কারফিউ তুলে নেওয়া হয়। যুদ্ধ শুরুর পর বারকয়েক বাসা থেকে বের হয়েছি। প্রতিবারই কেনাকাটা করতে। জিনিসপত্রের দাম যে খুব বেড়েছে, তা কিন্তু বলা যাবে না। বরং মাছের দাম প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে।
পার্লামেন্ট ভবন যেহেতু আমার এলাকায়, বিভিন্ন স্থানে তাই ইউক্রেনের সেনাসদস্যদের পাহারা থাকে। সেনারা বলেছে, সব সময় পাসপোর্ট কাছে রাখতে। ওরা এসব চেক করে। এসব সেনার সঙ্গে আছে স্বেচ্ছাসেবকেরা। তারাও যুদ্ধে যোগ দিয়েছে। দেশ বাঁচাতে সেনাবাহিনীর সঙ্গে মানুষ কাঁধে কাঁধ রেখে লড়ছে। আমাদের ফ্ল্যাটেই অনেক বৃদ্ধ বের হতে পারছেন না। তাঁদের জন্য বাজার পাঠানো হচ্ছে। আমি নিজেও তাঁদের জন্য বাজার করে দিয়েছি। একবার নিজের পয়সা দিয়েও দিয়েছি।
আমি যে ফ্ল্যাটে থাকি সেখান থেকে অনেকে চলে গেছে। আমি যাচ্ছি না। আমাকে এবং আমার ২৭ বছর বয়সী ছেলেকে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য ডাকা হয়েছিল। আমরা যেতে রাজি হইনি বলে কেউ জোর করেনি। তবে আবার ডাকলেই আমি যাব। আমি এ দেশের নুন খেয়েছি। এদের জন্য কিছু একটা করতে চাই। ছেলেকে নিয়েই রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে যেতে চাই।
অনুলিখন: পার্থ শঙ্কর সাহা