আমার দেখা কিয়েভ শহরটা একেবারে পাল্টে গেছে। মানুষের কোলাহল নেই, প্রায় জনশূন্য রাস্তা, অনেক দোকানপাটও বন্ধ। এই শহরেই আমার জন্ম। কিন্তু কখনো শহরের এ চেহারা আমি দেখিনি, গত বৃহস্পতিবারের পর থেকে যা দেখলাম। সেদিন বিস্ফোরণের শব্দে ঘুম ভেঙেছিল। এত তাড়াতাড়ি যে হামলা হবে, ভাবিনি। আমার মতো অনেক মানুষই হয়তো ভাবেননি। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আমরা হামলার শিকার হয়েছি। আমরা একটা অন্যায্য যুদ্ধের মধ্যে আছি।
আমার বাবা ইসলাম গাউছুল বাংলাদেশি, মা ইউক্রেনের নাগরিক ইসলাম লিলিয়া। মা-বাবার আমি একমাত্র সন্তান। বাবা অবশ্য এখন দেশে নেই। উনি বাংলাদেশে গেছেন গত ডিসেম্বরে। ইউক্রেনে ফেরার কথা ছিল ১০ মার্চ। কিন্তু এখন তাঁর আসা অনিশ্চিত হয়ে পড়ল। কবে বাবার দেখা পাব, তা–ও জানি না।
পড়াশোনা শেষ করে এখন আমি চাকরিও করি। কিন্তু বৃহস্পতিবার থেকে অফিস-আদালত সব বন্ধ। আমরা থাকি কিয়েভের জাকরেভসকভা এলাকায়। ঠিক এই এলাকায় এখনো কোনো হামলার ঘটনা না ঘটলেও গোলাগুলি সব জায়গাতেই কমবেশি হচ্ছে। বুধবার থেকে বিস্ফোরণের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। আর কিয়েভের প্রায় সব মানুষ এখন ঘরেই দিন কাটাচ্ছে। রাত আটটা থেকে সকাল সাতটা পর্যন্ত কেউ ঘর থেকে বের হতে পারে না, এ সময় কারফিউ থাকে। দিনে অল্প কিছুসংখ্যক মানুষ বের হয় ওষুধ কেনার জন্য। কিন্তু খুব কম ওষুধের দোকানই খোলা থাকে আমাদের এলাকায়। দোকানগুলোর সামনে তাই অনেক বড় সারি, সব ওষুধ আবার পাওয়াও যায় না। বড় বিপণিবিতানগুলোর প্রায় ৯৫ শতাংশই বন্ধ। দূরের কিছু খোলা থাকলেও যেতে ভয় পাই। আর সেখানে তেমন কিছুই পাওয়া যায় না। পেট্রলপাম্পও বন্ধ। কারণ, পেট্রল নেই।
যুদ্ধে আক্রান্ত এই শহরের বাসিন্দা হিসেবে অন্য সবার মতো ভয়ে আছি, দুশ্চিন্তায় আছি। কিন্তু এত সবকিছুর মধ্যেও বড় শক্তি মানুষের সহানুভূতি। আমার বন্ধুদের অনেকেই স্বেচ্ছাসেবক হয়ে সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিলে ইউক্রেনের জন্য লড়ছে। আমি ওদের সমর্থন করি আর যতটা পারি সহযোগিতাও করি। এখন প্রচণ্ড শীত। সেনাবাহিনীর সদস্যদের অনেক বেশি করে গরম কাপড়ের দরকার হয়ে পড়েছে। বাবার কথামতো তাঁর দোকানের গুদাম থেকে টুপি, গ্লাভসসহ প্রয়োজনীয় অনেক কিছু দিয়ে দিয়েছি। বাবা বলেছেন, যখন যা চাইবে ওদের দিতে।
কিয়েভের প্রতিটি এলাকায় স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সদস্যরা সাধারণ মানুষকে সহযোগিতা করছেন। যাঁরা বের হতে পারছেন না, তাঁদের সহযোগিতা করছে। তাঁদের বয়স আমার মতোই হবে। এই তারুণ্যের শক্তি কিয়েভের মানুষকে শক্তি জোগাচ্ছে। শক্তিশালী একটি বাহিনীর সঙ্গে লড়াইয়ে আমরা কতটা কী করতে পারব, জানি না। কিন্তু আমি দেখেছি, মানুষের মনোবল অটুট। রুশ বাহিনী কিয়েভকে প্রায় অবরুদ্ধ করে ফেলেছে। তাদের হামলার পর সাইরেন বাজার রীতি আছে। এখন ঘন ঘন সাইরেন বাজে। আক্রান্ত এই শহরের অনেক মানুষের মতো আমি তখন বাড়ির নিচের বাংকারে আশ্রয় নিই। আবার পরিস্থিতি শান্ত হলে ফিরে আসি। এভাবেই চলছে কিয়েভের দিনরাত্রি।
অনুলিখন: পার্থ শঙ্কর সাহা