রোবটের নাম ‘প্যারা নাই চিল’!
ফেসবুকে অনিক দাশের পোস্ট দেখে আগ্রহ জাগল। ২ সেপ্টেম্বর একটা লাইন ফলোয়িং রোবটের (নির্দিষ্ট রেখা ধরে চলতে পারে, এমন রোবট) ছবিসহ অনিক লিখেছিলেন, করোনাকালীন বন্ধে ঘরে বসে একটা রোবট তৈরি করেছেন তিনি। নাম দিয়েছেন—‘প্যারা নাই চিল’!
এমন অদ্ভুত নামের পেছনে যুক্তিটাও মজার। বিশ্ববিদ্যালয় যখন খোলা থাকে, ঘুরেফিরে নাকি বারবার এই কথা চলে আসে। দীর্ঘ অ্যাসাইনমেন্ট করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে কেউ—প্যারা নাই, চিল! পরীক্ষা সামনে, অথচ কিছুই পড়া হয়নি? পাশ থেকে এক বন্ধু হয়তো বলল, ‘প্যারা নাই, চিল!’ ক্যাম্পাস বন্ধ, তাই কথাটা মিস করছিলেন অনিক দাশ। সেই ভাবনা থেকেই রোবটের এমন নামকরণ।
রোবটটি বানাতে গিয়ে অবশ্য ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার প্রকৌশল বিভাগের এই শিক্ষার্থীকে বেশ ‘প্যারা’ সহ্য করতে হয়েছে। কখনো সোল্ডারিং মেশিন ব্যবহার করতে গিয়ে হাত পুড়িয়েছেন। কখনো একা সামলাতে না পেরে বাবার সাহায্য নিয়েছেন।
অনিক দাশ ছিলেন হবিগঞ্জের বৃন্দাবন সরকারি কলেজের ছাত্র। বছর তিনেক আগে কম্পিউটার হাতে পান তিনি। কিন্তু গেম খেলা আর সিনেমা দেখার বাইরে কম্পিউটার আর কোনো কাজে আসছিল না। একপর্যায়ে অনলাইন ঘেঁটেঘুঁটে প্রোগ্রামিং শুরু করেন তিনি। কলেজে পড়ার সময়ই বন্ধুদের নিয়ে অংশ নেন ন্যাশনাল হাইস্কুল প্রোগ্রামিং কনটেস্টে। জাতীয় পর্যায়ে টিকে গেলেও পরের ধাপে একটু পিছিয়ে গিয়েছিল অনিকের দল। এরপর উচ্চমাধ্যমিক আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা মিলিয়ে প্রোগ্রামিং চর্চায় ভাটা পড়েছিল।
কম্পিউটার প্রকৌশলে স্নাতক শ্রেণির ক্লাস শুরুর কিছুদিন পরই কোভিড-১৯ মহামারিতে আবার হবিগঞ্জে ফিরতে হয় অনিককে। দীর্ঘ দিনের বিরতির পর লম্বা ছুটি পেয়ে আবার প্রোগ্রামিংয়ে মন দেন তিনি। তবে এবার একটু ভিন্ন পথে। প্রোগ্রামিং করে আরডুইনো দিয়ে রোবট বানানোর পরিকল্পনা করেন আকাশ। ফেসবুকে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল তরুণকে খুঁজে বের করেন তিনি, যাঁরা ‘রোব আড্ডা’ নামে ফেসবুকভিত্তিক গ্রুপে রোবট বানানো শেখান। সেখানেই একটু একটু করে শিখতে শুরু করেন অনিক।
করোনার বন্ধে ঘরে থেকে থেকে হাঁপিয়ে উঠেছিলেন, কিন্তু কিছু একটা তৈরির রোমাঞ্চ নিয়ে লেগে থাকতে থাকতে অনুপ্রেরণা খুঁজে পান অনিক। বাসা থেকে বেরিয়ে, নানা জায়গায় গিয়ে সংগ্রহ করতে হয়েছে যন্ত্রাংশ। ঢাকার অনেক বন্ধুরাও সাহায্য করেছেন তাঁকে। ঝালাই করা (সোল্ডারিং) শিখেছেন স্থানীয় দোকানের মেকানিকের কাছ থেকে। দীর্ঘ দুই মাসের চেষ্টায় বাড়িতে বসেই অনিক বানিয়েছেন তাঁর জীবনের প্রথম রোবট। করোনার সময়টা তাঁর মন্দ কাটেনি।
ফোনের ও প্রান্তে তাঁর কণ্ঠস্বরেই আত্মতৃপ্তি টের পাওয়া যাচ্ছিল। তিনি বলছিলেন, ‘অনলাইনে সবকিছু করতে হবে ভেবে শুরুতে বেশ ভেঙে পড়েছিলাম। কিন্তু হতাশা কাটিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়াতে শিখেছি। করোনার এই মহামারিতে আর থেমে থাকতে চাই না। বরং আগের শেখা বিষয়গুলো নিয়ে নতুন করে কাজ করতে চাই।’ নিজের কাজের পাশাপাশি অনিক তাঁর মতো অনেকের কথা ভেবে বন্ধুদের নিয়ে শুরু করেছেন প্রগ থেটা (www.progtheta.com) ব্লগ। যেখানে যে কেউ চাইলে তাঁর শেখা বিষয়গুলো নিয়ে লেখা বা ভিডিও পোস্ট করতে পারেন, যা পড়ে বা দেখে অনুপ্রাণিত হতে পারেন অন্যরাও।
ভবিষ্যতে রোবটিকস নিয়ে আরও পড়াশোনা করতে চান অনিক দাশ। এ ছাড়া নিজের উদ্যোগেই নানা রকম প্রকল্পভিত্তিক রোবট বানানোর ইচ্ছা আছে তাঁর।
শাহরিয়ারের বুদ্ধির খেলা
ক্যাম্পাস বন্ধের এই সময়টাতে অনেকেরই নিশ্চয় মুঠোফোনে গেম খেলে অনেকটা সময় কাটছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র শাহরিয়ার চৌধুরী একটু ব্যতিক্রম। গেম খেলে নয়, তিনি সময়টা কাজে লাগিয়েছেন গেম তৈরি করে! শাহরিয়ারের আশা, তাঁর তৈরি এই গেম খেলার মাধ্যমে বুদ্ধির চর্চা হবে, মগজ হবে আরও শাণিত।
রাঙামাটির দেবাশীষ নগরে বেড়ে ওঠা শাহরিয়ারের। তাই প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক ছিল আগে থেকেই। জন্মগতভাবে এক হাতে সমস্যা থাকলেও কারও থেকে কোনো দিকে পিছিয়ে থাকেননি তিনি। বরং সবার চেয়ে এগিয়ে থাকার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন সব সময়। কিন্তু ঢাকায় পা রাখার পর কেন যেন আর দশজনের মতো শহুরে যান্ত্রিকতা পেয়ে বসেছিল তাঁকেও। নিজের পছন্দের কাজগুলোতে সময় দেওয়া হচ্ছিল না। কোভিড–১৯ মহামারিতে শহর ছেড়ে আবার বাড়িতে ফেরার সুযোগ হলো। শুরুতে ভেবেছিলেন দিন দশেকের ব্যাপার। কিন্তু ধীরে ধীরে পরিস্থিতি খারাপ হতে শুরু করে। অলস সময়ে যেন হাঁপিয়ে ওঠেন শাহরিয়ার। তাই ঢাকা থেকে নিজের কম্পিউটারটাও নিয়ে যান রাঙামাটিতে।
শুরুতে যা কিছু ভালো লাগে, তা-ই শিখছিলেন একটু একটু করে। অনলাইন টিউটোরিয়াল দেখে ছবি সম্পাদনা শেখা শুরু করেন। সঙ্গে চলছিল ফটোগ্রাফিতে হাত পাকানোর চেষ্টা। কিছুদিন সেটা করতে করতে আবার শুরু করেন সাউন্ড ডিজাইনিং। নানা রকম গানের মিশ্রণে নতুন সুর বানাতে চেষ্টা করেন। তবে সেই শখও বেশি দিন স্থায়ী হয়নি।
এরপর শুরু করেন অ্যাপ বানানো। অনলাইনের নানা কিছু ব্যবহার করে অ্যান্ড্রয়েড ও আইএসও–চালিত স্মার্টফোনের জন্য অ্যাপ বানানো শিখতে থাকেন। এবার একটু থিতু হন শাহরিয়ার। নিজেই বুঝতে পারেন, এলোমেলোভাবে সব শেখার চেষ্টা করে লাভ নেই। বরং একটা কিছু ভালোভাবে শিখে সেটা নিয়ে কোনো প্রকল্প দাঁড় করানো দরকার। তাই এবার নিজেই ঠিক করলেন, গেম বানাবেন।
ইউনিটি ইঞ্জিন ব্যবহার করে বানালেন পাজলনির্ভর গেম ব্লকি বয়। অটোমাটা স্টুডিও নামের অ্যাপ তৈরির স্টুডিও খুলে সেখান থেকে প্রকাশ করেন তাঁর প্রথম পাজল গেম—ব্লকি বয়। ২৫ মেগাবাইটের এই গেমে নানা রকম ধাঁধা সমাধান করতে হয়। এটি দিয়েই গেম তৈরির হাতেখড়ি হলো শাহরিয়ারের।
মুঠোফোনে শাহরিয়ার বললেন তাঁর কথা, ‘করোনায় হতাশা পেয়ে বসেছে, কিন্তু থেমে থাকতে চাইনি। আমার এক হাতে যে সমস্যা আছে, সেটাও আমি কখনো মাথায় আনি না। কোডিং, ছবি সম্পাদনা, সাউন্ড ডিজাইন—সবই আমি এক হাতে করেছি।’ বারবার তাঁর মাথায় ঘুরছিল, ‘থেমে থাকা যাবে না। নতুন পৃথিবীর উদ্ভাবনে ঘরে থাকা কোনো বাধা নয়।’
ভবিষ্যতে অ্যাপ ডেভেলপমেন্ট নিয়ে আরও কাজ করতে চান এই তরুণ। বিনা মূল্যে অ্যাপের মাধ্যমে রক্তদানের সেবা পৌঁছে দিতে চান সবার কাছে।