গণপরিবহন কি তবে ধর্ষকদের অভয়ারণ্য
২০১৯ সালের তুলনায় এ বছরের ১১ মাসেই গণপরিবহনে নারী নির্যাতনের সংখ্যা বেড়েছে ৩১ শতাংশ। এ বছরের নভেম্বর পর্যন্ত গণপরিবহনে ৬৮টি নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে ৩৪টি ছিল ধর্ষণের। ২০১৯ সালে এ সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৫২ ও ২৮। এসব তথ্য-উপাত্তই বলে দিচ্ছে গণপরিবহনে মেয়েরা কতটা নিরাপত্তাহীন। কেন ক্রমেই বাড়ছে এ সংখ্যা আর আগের মামলাগুলোরই–বা বর্তমানে কী হাল, খোঁজখবর করলেন নাজনীন আখতার।
মুখে চকলেট পুরে রস আস্বাদন করতে করতে দুরন্তপনায় মেতে ওঠার বয়সে মেয়েটি বাসে চকলেট ফিরি করত। অনুমান করতে কষ্ট হয় না, জীবন চালিয়ে নিতে চকলেট বিক্রির ওপর তাকে নির্ভর করতে হয়। সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছ থেকে ন্যূনতম যেটা তার পাওয়ার কথা, সেই নিরাপদ জীবনযাপনের অধিকারটুকুও সে পায়নি। গত বছরের ৭ নভেম্বর গাজীপুরে চলন্ত বাসে ধর্ষণের শিকার হয় এই কিশোরী। ধর্ষণের সহযোগী হিসেবে ওই সময় বাসচালক সাদ্দাম হোসেন গ্রেপ্তার হলেও পলাতক মূল অভিযুক্ত চালকের সহকারী শরীফ হোসেন।
মামলার বিষয়ে জানতে জয়দেবপুর থানায় যোগাযোগ করা হলে অফিসার ইনচার্জ মাহতাব উদ্দিন বলেন, কিশোরী ধর্ষণের ঘটনায় এ বছরের ৩০ মে দুজনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ। শরীফকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে কি না জানতে চাইলে বলেন, ‘একজনই (তাকওয়া পরিবহনের বাসচালক সাদ্দাম হোসেন) গ্রেপ্তার আছে বলে জানি, মামলাটি এখন আদালতে। মূল অভিযুক্ত আদালতে আত্মসমর্পণ করেছে কি না জানা নেই।’
গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি জানায়, এ বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে গণপরিবহনে ৬৮টি নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ২৩টি ধর্ষণ, ১১টি দলবদ্ধ ধর্ষণ এবং ৩৪টি যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটেছে। এর আগে ২০১৯ সালে সড়ক, রেল ও নৌপথে ৫২টি নারী নির্যাতনের ঘটনার মধ্যে ১৬টি ধর্ষণ, ১২টি দলবদ্ধ ধর্ষণ, ৯টি ধর্ষণচেষ্টা এবং ১৫টি যৌন হয়রানি ছিল।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য অনুসারে, করোনাপূর্ব সময় ২০১৯ সালের সঙ্গে তুলনা করলে এ বছরের ১১ মাসেই গণপরিবহনে নারী নির্যাতনের ঘটনা বেড়েছে ৩১ শতাংশ। এসব তথ্য-উপাত্তই বলে দিচ্ছে গণপরিবহনে মেয়েরা কতটা নিরাপত্তাহীন। গত ২৫ নভেম্বর প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ প্রকাশিত ‘চ্যালেঞ্জিং ফিয়ার অব ভায়োলেন্স’ (সহিংসতার ভয় মোকাবিলা) শিরোনামের জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, কিশোরী ও তরুণীদের ওপর সংগঠিত হয়রানি-নিপীড়নের ঘটনার ৮২ শতাংশই পথঘাট, গণপরিবহন, বাসস্টপেজ, রেলস্টেশনসহ জনসমাগম স্থলে ঘটছে। তার মধ্যে মামলা হচ্ছে ৩ শতাংশেরও কম।
কয়েকটি মামলার হাল হকিকত
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট চলন্ত বাসে দলবদ্ধ ধর্ষণ ও হত্যার শিকার চাকরিজীবী রূপা খাতুনের ঘটনাটি দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে। মাত্র ১৪ কার্যদিবসের পর ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে টাঙ্গাইলের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল চার আসামির ফাঁসি ও একজনকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেন। অনেক দ্রুত রায় দিয়ে উদাহরণ সৃষ্টি করা চাঞ্চল্যকর মামলাটি হাইকোর্টে এসে জটে পড়ে যায়।
রূপা খাতুনের বড় ভাই সিরাজগঞ্জের বাসিন্দা হাফিজুর রহমান গত শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, প্রায় চার বছরে হাইকোর্টে একবারও শুনানি হয়নি। বিচারপ্রক্রিয়া দ্রুত না হলে এ ধরনের অপরাধ কখনো থামবে না। নিম্ন আদালতের রায় অনুসারে ওই বাসটি রূপার পরিবারকে দেওয়ার নির্দেশ দিলেও সেটিও পাননি বলে জানান হাফিজুর।
২০১৯ সালের ৬ মে কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে স্বর্ণলতা পরিবহনে নার্স শাহিনুর আক্তারকে দলবদ্ধ ধর্ষণের পর বাস থেকে ফেলে হত্যা করা হয়। ওই বছরের ২২ আগস্ট ৯ জনকে আসামি করে মামলার অভিযোগপত্র দাখিল হয়, এর মধ্যে ৬ জন গ্রেপ্তার ছিল। ঘটনার আড়াই বছরে বাকি আসামিদের গ্রেপ্তার করা গেছে কি না জানতে চাইলে বাজিতপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (তদন্ত) নজরুল ইসলাম বলেন, তিনি নতুন দায়িত্ব নেওয়ায় এ বিষয়ে বলতে পারছেন না, মামলাটি আদালতে বিচারাধীন।
এ বছরের ৬ নভেম্বর মানিকগঞ্জে যাওয়ার উদ্দেশে এক কলেজছাত্রী ধামরাই থানা রোড থেকে কালামপুর এন্টারপ্রাইজের একটি বাসে ওঠেন। কিছুদূর আসার পর বাসের সব যাত্রী নেমে গেলে ওই ছাত্রীও নেমে পড়তে যান। চালক তাঁকে গন্তব্যে নামিয়ে দেবেন জানিয়ে বাসে বসে থাকতে বলেন। একপর্যায়ে চালক তাঁর সহকারীকে বাস চালাতে দিয়ে মেয়েটিকে ধর্ষণের চেষ্টা করলে মেয়েটি চালককে ধাক্কা মেরে চলন্ত বাস থেকে লাফিয়ে পড়েন। ওই ঘটনায় মামলা হলে বাসচালককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। মামলাটির বিষয়ে জানতে চাইলে মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আশরাফুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশ চালককে একমাত্র আসামি করে মামলাটির অভিযোগপত্র দাখিল করে। তবে চালক এখন জামিনে মুক্ত হয়েছে কি না, তা জানা নেই।
সবশেষ এ বছরের ১৯ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জের বন্দর এলাকায় চলন্ত বাসে উচ্চ শব্দে গান বাজিয়ে এক গৃহবধূ দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। তিনি গাউছিয়া যাওয়ার উদ্দেশে যাত্রাবাড়ী থেকে রাত ১০টায় সায়েদাবাদ টু গাউছিয়া মুক্তিযোদ্ধা পরিবহনে ওঠেন। বাসটি চিটাগাং রোডে আসার পর সব যাত্রী নেমে গেলে তিনি একা হয়ে যান। এ ঘটনায় পুলিশ বাসচালক, হেলপারসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে। শনিবার ওই নারী মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, তিনি মামলার বিষয়ে জানতে থানায় যোগাযোগ করেছিলেন ২৪ ডিসেম্বর। পুলিশ তাঁকে বলেছে, ‘যখন দরকার হবে ফোন দেব।’ ওই নারী বলেন, ‘আমি চাই আসামিদের শাস্তি হোক, আমার স্বামীও চায়। এখন পর্যন্ত সে আমার সাপোর্টে (সমর্থন দিচ্ছে) আছে। আসামিদের শাস্তি না হলে সে কয়দিন সাপোর্ট দেবে কে জানে!’
তাহলে করণীয় কী
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম বলেন, একটি সমাজে অপরাধের বিস্তার হলে তার প্রতিফলন সব জায়গায় পড়ে, গণপরিবহনেও তা পড়েছে। সুশাসন ও আইনের বিচার প্রতিষ্ঠা না পেলে এসব অপরাধ থামবে না বরং বাড়বে। গণপরিবহনে নারী নির্যাতন বন্ধ করার জন্য গণপরিবহন নেতাদেরও মানসিকতা বদলাতে হবে। প্রতিটি ঘটনার জন্য বাসের মালিককে দায়বদ্ধ করতে হবে। সাংসদকেও দায়বদ্ধ করতে হবে কেন তাঁর এলাকায় এ ধরনের নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, নিপীড়ক, ধর্ষকদের বিরুদ্ধে মামলা, গ্রেপ্তার ও দ্রুত বিচার না হওয়ার কারণে নির্যাতনের ঘটনা বাড়ছে। গণপরিবহনে ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা, চালক, সহকারী ও সুপারভাইজারের নিয়োগপত্র, জাতীয় পরিচয়পত্র ও ছবি নিয়ে তথ্যভান্ডার তৈরির মাধ্যমে সহিংসতা ঠেকাতে বাসমালিকদের দায়িত্বশীল হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
বাসমালিকেরা কখনো ধর্ষণ-নিপীড়নকে প্রশ্রয় দেয় না উল্লেখ করে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, প্রয়োজনের তুলনায় ১২–১৩ লাখ চালক কম থাকায়, এই চালকেরা কোনো জায়গায় বেশিদিন থাকে না। ফলে নিয়োগপত্র দেওয়ার বিষয়টি খুব একটা কার্যকর করা সম্ভব হচ্ছে না। বড় পরিবহন সিসি ক্যামেরার আওতায়। সব পরিবহনে রাখা গেলে ভালো হতো। তবে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত হলে গণপরিবহনে ধর্ষণ, নিপীড়ন কমে আসবে বলে মনে করেন তিনি।