টার্ভির এক্সোগ্রামসের অদেখা জগত্!

‘স্টিলেট্টো’ হাগ টার্ভি, ১৯৯৮। ছবি: দ্য গার্ডিয়ান
‘স্টিলেট্টো’ হাগ টার্ভি, ১৯৯৮। ছবি: দ্য গার্ডিয়ান

চারপাশের চিরচেনা জগতেও লুকিয়ে থাকে কত মনোরম সুন্দর, বস্তুর অন্তর্গত কত বিস্ময়কর শৈলী। প্রতিদিনের জীবনে কত কাছে থেকেও আমরা তা দেখতে পাই না। খালি চোখে দেখা না মিললেও অদেখা সেই জগতের সুলুক-সন্ধান দিচ্ছে এক্স-রে আলোকচিত্র। গাছের পাতার শিরা-উপশিরা থেকে শুরু করে হাইহিল পরা নারীর পায়ের পাতার অসহনীয় কষ্টকর ভঙ্গিতে বেঁকে থাকা হাড়-গোড়-আঙুল সবই উঠে এসেছে ব্রিটিশ ‘এক্স-রে আলোকচিত্রী’ শিল্পী হাগ টার্ভির ছবিতে। দ্য গার্ডিয়ান এক প্রতিবেদনে এ খবর জানিয়েছে।

টার্ভি চারপাশের বাস্তবতার এমন এক ছবি নির্মাণ করেন যা আপনাকে চমকে দেবে। অদ্ভুত সুন্দর কিংবা মারাত্মক হোঁচট খাওয়ার মতো সব দৃশ্য তুলে আনেন তিনি। হাইহিল পরা নারীর পায়ের এক্স-রে ছবি তেমনই এক উদাহরণ। ওই ছবি দেখে একে একটা নির্যাতন বলেই মনে হবে। পায়ের পাতার হাড় প্রায় ৯০ ডিগ্রি কোণে বেঁকে আছে, হাইহিলের ভেতর বেঁকে আছে আঙুল ও নখ। যেন মধ্যযুগীয় বর্বরতায় ছোট্ট লোহার খাঁচায় বন্দি করে নিপীড়নের কোনো বিশেষ একটা ভঙ্গি এটা! অসহনীয় এই বাস্তবতা হয়তো আমাদের নজরে আসত না যদি হাগ টার্ভি চিকিত্সকেদের মতো এক্স-রে রশ্মি দিয়ে এই ছবি না তুলতেন।

‘সেজ কম্পোজিশন’, হাগ টার্ভি, ২০১৪। ছবি: দ্য গার্ডিয়ান
‘সেজ কম্পোজিশন’, হাগ টার্ভি, ২০১৪। ছবি: দ্য গার্ডিয়ান



প্রায় দুই দশকের পরিশ্রমে এই ‘এক্স-রে আলোকচিত্র’ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন টার্ভি। চিকিত্সাবিদ্যার এই পদ্ধতিকে কাজে লাগিয়ে শিল্পের নব দিগন্ত উন্মোচন করতে চেয়েছেন তিনি, যে শিল্প মাধ্যম তাঁকে চারপাশের জগতে লুকিয়ে থাকা বাস্তবতার ভিন্ন উপাখ্যান তুলে আনতে সাহায্য করবে। নিজের স্ত্রীর হাই-হিল পরা পায়ের ছবিকে টার্ভির এমন এক্স-রে আলোকচিত্রের অনন্য উদাহরণ বলা যেতে পারে। হাইহিল পরার স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে বহুদিন ধরে বিতর্ক চললেও পশ্চিমা দুনিয়ার মতই বিশ্বজুড়েই এখনও তা জনপ্রিয়। কিন্তু টার্ভির এমন চোখে আঘাত হানা ছবি এই বিতর্ককে নতুনভাবে সামনে নিয়ে আসতে পেরেছে।

এ ছবি প্রসঙ্গে টার্ভি বলেন, ‘এটা একটা পায়ের কষ্টকর দৈহিক ভঙ্গিমার একটা অদ্ভুত চিত্র...এক্স-রে আলোকচিত্র এর গভীর উপলব্ধির সুযোগ করে দিয়েছে। এটা এতটাই সরলভাবে আপনার সামনে উন্মোচিত হচ্ছে যে এই সত্যটা আপনি আর এড়াতে পারছেন না।’


কিসের ছবি তুলবেন তার উপর নির্ভর করেই এক্স-রে আলোকচিত্রের জন্য মেশিন পাতির প্রস্তুতি নেন টার্ভি। হাতির মাথার ছবি তুলতে শিল্প-কারখানার বড় এক্স-রে যন্ত্রের মতো যন্ত্র ব্যবহার করেন তিনি। আর একটা ফুল বা পাতার ছবির জন্য তিনি ব্যবহার করেন দন্ত্য চিকিত্সকের ক্লিনিকের এক্স-রে যন্ত্রের মতো আকৃতির যন্ত্র। শিল্পী জানিয়েছেন, এক্স-রে প্রযুক্তি ব্যবহার করে এমন প্রায় সব শিল্পের যন্ত্রপাতিই ইতোমধ্যেই ব্যবহার করেছেন তিনি। হাসপাতাল থেকে শুরু করে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা এবং বিশাল শিল্প-কারখানার অনেক এক্স-রে যন্ত্রই কাজে লাগিয়েছেন এই ছবি তোলার কাজে।

‘ওমেন ড্রিংকিং ওয়াটার’, হাগ টার্ভি, ২০০৯। ছবি: দ্য গার্ডিয়ান
‘ওমেন ড্রিংকিং ওয়াটার’, হাগ টার্ভি, ২০০৯। ছবি: দ্য গার্ডিয়ান

১৯৯৬ সালে বিখ্যাত রক আলোকচিত্রী গেরেড মাঙ্কোভিেজর অধীনে শিক্ষানবিশ থাকাকালে প্রথম এই এক্স-রে আলোকচিত্রের ভাবনা মাথায় আসে হাগ টার্ভির। একটা অ্যালবামের প্রচ্ছদে এক্স-রের চিত্র ব্যবহার করার জন্য লন্ডনের নর্থ হ্যাম্পস্ট্যাডের রয়্যাল ফ্রি হসপিটালে যান টার্ভি। ওই হাসপাতালের রেডিওলজিস্ট এক ঝুড়ি বাতিল হয়ে যাওয়া এক্স-রের পাতা নেড়েচেড়ে দেখার সুযোগ দেন তাঁকে।

টার্ভির ভাষায়, ‘এইটা ছিল এমন এক মুহূর্ত যখন আপনার মনে হবে, হায় ঈশ্বর! কী চমত্কার! কী অদ্ভুত! ওই রেডিওলজিস্টের কাছে এগুলো প্রতিদিনের নৈমিত্তিক কাজের অংশ, আর আমার কাছে তা ছিল এক ঝুড়ি অদ্ভুত আলোকচিত্র। আর ওই দিন থেকেই আমার কাছে চারপাশের সব বস্তুর অর্থ পালটে গেল।’

বিশ বছর পর টার্ভি এখন ব্রিটিশ ইনস্টিটিউট অব রেডিওলজির আবাসিক শিল্পী (আর্টিস্ট ইন রেসিডেন্স) হিসেবে কাজ করছেন। এখানে মাথার টুপির ভেতরে খরগোশ থেকে শুরু করে আস্ত মটর সাইকেল পর্যন্ত অনেক কিছুরই এক্স-রে ছবি তুলেছেন তিনি। এক্স-রে যন্ত্রই তাঁর প্রাথমিক ক্যামেরা। আর ডিজিটাল আলোকচিত্র এড়িয়ে টার্ভি বরং ১১ বাই ৪ ইঞ্চি ফিল্ম ক্যামেরা ব্যবহার করতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন। তিনি মনে করেন ফিল্ম ফরম্যাটের এই ক্যামেরাতেই তাঁর আরাধ্য নিপুণতর চিত্র খুঁজে পাওয়া যায়।


টার্ভি বলেন, ‘এভাবে হাতে-হাতে ছবি তোলার পুরো পদ্ধতিটাই চমত্কার সব ভুলে ভরা থাকে। অনেক সম্ভাবনাময় সব ভুল। এসব দারুণ দুর্ঘটনা ডিজিটাল পদ্ধতিতে সম্ভব নয়।’

শিল্পী হাগ টার্ভি নিজের এই এক্স-রে আলোকচিত্রকে বলেন ‘এক্সোগ্রামস’। তিনি মনে করেন এভাবে ছবি তোলার বিষয়টা অনেকটাই একটা ভবনের পাশ দিয়ে যেতে যেতে ভবনটাকে নগ্ন করে দেখে ফেলার মতো। যেন ধীরে ধীরে ভবনের দেয়াল, ছাদ, দরজা জানালা খুলে এর ভেতরের স্থাপত্য-কঙ্কালটা দেখে ফেলছেন তিনি। অবশ্য শেষ বিচারে এটা তাঁর কাছে সত্যের উন্মোচন। পৃথিবীর অদেখা সত্যের উন্মোচন। আর সেই অদেখা সত্যটা যদি হয় হাইহিলের ভেতরে নারীর পা, তখন তা হয়ে ওঠে এক অসহনীয় সত্যের উন্মোচন।