
এভারেস্ট বিজয়ী প্রথম নারী জুনকো তাবেই বাংলাদেশে এসে গিয়েছিলেন সুন্দরবনে। বনের কাদাময় পথে হেঁটেছেন। এই সফরকে মনে রেখেছেন তিনি। আর তাঁর সঙ্গে থাকা দোভাষী ছাদেকুরের কাছে তো জীবনের স্মরণীয় ঘটনা এটা। হংকংয়ের এক তরুণীর সঙ্গে ছবি তুলেছিলেন জিহাদ। বেশ কবছর পর সেই তরুণী নিজে অফিসে এসে তাঁর হাতে তুলে দেন সেই ছবির প্রিন্ট। চীনা এক পর্যটককে চায়ে বিস্কুট চুবিয়ে খাওয়া শিখিয়েছিলেন শাহাদাৎ। পরে একদিন সেই পর্যটককে দেখা গেল চায়ে কলা চুবিয়ে খেতে। এমন অনেক মজার অভিজ্ঞতা দোভাষীদের। মাতৃভাষার পাশাপাশি ভিনদেশি ভাষা রপ্ত করে দুই ভাষার মানুষদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করাই যাঁদের পেশা ও কাজ। ভাষার প্রতি ভালোবাসা আর ভিন্ন সংস্কৃতি জানার আগ্রহ থেকেই মূলত দোভাষীর কাজ করেন তাঁরা। ফরাসি ভাষা শিখে কঙ্গো, মালির মতো দেশে জাতিসংঘ মিশনে কাজ করে শান্তিরক্ষীদের সহায়ক হয়েছেন সাজ্জাদ। সেখানে তাঁর বিচিত্র অভিজ্ঞতা। দোভাষীদের এমন কিছু অভিজ্ঞতার কথা নিয়ে এই প্রতিবেদন।

জাতিসংঘের শান্তি মিশনে
আফ্রিকার বনজঙ্গল ও দুর্গম পাহাড়ে দুই দফায় তিন বছর ঘুরে বেড়িয়েছেন বাংলাদেশি তরুণ মোস্তফা মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন। এই তরুণের প্রেম ভাষার প্রতি, কাজ করেন দোভাষী হিসেবে। ১৪ ফেব্রুয়ারি কথা হলো তাঁর সঙ্গে। জানালেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে পড়ার সময় একটি বিদেশি ভাষা শেখা বাধ্যতামূলক ছিল। আর তাই প্রথম বর্ষে থাকতেই ঢাবির আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে ফরাসি ভাষা শেখার এক বছরের একটি কোর্স করেন। সেটি ২০০৪ সালের ঘটনা। সাজ্জাদ বলেন, ‘কোর্স করার সময়ই ফরাসি ভাষা ভালো লেগে যায়। পরে আরও কয়েকটি উচ্চতর কোর্স করি।’
২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে পত্রিকায় একটি বিজ্ঞাপন দেখতে পান সাজ্জাদ। নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে একটি দল আসবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে, দোভাষী প্রয়োজন। সে সময় সাজ্জাদ ইংরেজি ভাষার দোভাষী হিসেবে প্রায় দুই সপ্তাহ কাজ করেছিলেন। শুরু হলো দোভাষী হিসেবে সাজ্জাদের কাজ।
২০১০ সালে এসে নতুন দুয়ার খুলে যায় সাজ্জাদের। আগে শেখা ফরাসি ভাষা কাজে লাগানোর সুযোগ পেলেন। দেশে নয়, আফ্রিকার কঙ্গোতে। জাতিসংঘের শান্তি মিশনে দোভাষী হিসেবে কাজ শুরু করেন বাংলাদেশ থেকে যাওয়া প্রতিরক্ষা বাহিনীর সঙ্গে। এক বছর পর দেশে ফেরেন। ২০১৪ সালে দুই বছরের জন্য আবার মালিতে যান। সাজ্জাদ বললেন, কাজটা চ্যালেঞ্জিং। তবে ভিনদেশি মানুষের খুব কাছে যাওয়া যায়, তারা কেমন তা বোঝা যায়। পরিচিত হওয়া যায় অন্য একটি সংস্কৃতির সঙ্গে। তিনি জাতিসংঘের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে যেমন কাজ করেছেন, তেমনি মিশেছেন সাধারণ মানুষের সঙ্গেও। সম্প্রতি তিনি যোগ দিয়েছেন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে, ফরাসি ভাষার শিক্ষক হিসেবে।
সাজ্জাদ জানালেন দোভাষী হিসেবে মজার স্মৃতিও কম নেই তাঁর। ‘একবার কয়েকজন মার্কিন নাগরিক খুব অবাক হয়ে আমাকে জিগ্যেস করে বসেন, ‘‘এই তোমরা সবাই রিকশাওয়ালাকে মামা ডাকো কেন? মামা মানে তো আমরা মা বলে জানি।’’’

এভারেস্টজয়ী প্রথম নারীর সঙ্গে
জুনকো তাবেই নামটি হয়তো জানেন অনেকেই। এভারেস্টজয়ী বিশ্বের প্রথম নারী। এই নারীর সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা হয়েছে দোভাষী এ টি এম ছাদেকুর রহমানের। ২০১৩ সালে জুনকো এসেছিলেন বাংলাদেশে। সে সময় কেওক্রাডংয়ে আরোহণ করেছেন, ঘুরে বেড়িয়েছেন সুন্দরবন। সুন্দরবনে জুনকো তাবেইর সঙ্গে গিয়েছিলেন ছাদেকুর। পাহাড়-পর্বত মাড়ানো মানুষ জুনকো তাবেই। বয়স তখন সত্তরের বেশি। তাই হয়তো সুন্দরবনের হাঁটুসম কাদার মধ্যে হাঁটতে একটু কষ্টই হচ্ছিল তাঁর। ‘একদিন এ রকম একটা সময় মজা করে মুখ দিয়ে বাঘের আওয়াজ করেছিলাম। রীতিমতো ঘাবড়ে গিয়েছিলেন জুনকো। সফর শেষে অবশ্য এই ঘটনার কথা বেশ মজা করেই বেলছিলেন তিনি।’ বিশ্বখ্যাত এই নারীর সঙ্গে দোভাষী হিসেবে কাজ করাটা জীবনের সেরা অভিজ্ঞতা বলেই মনে করেন ছাদেকুর।
১৫ ফেব্রুয়ারি ছাদেকুরের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, তখনই ফেসবুকে তাঁকে বার্তা পাঠান জাপানি তরুণী কানা কোবায়াশি। খোঁজখবর নিচ্ছেন ছাদেকুরের। মজার ব্যাপার হলো, এই দুজনের মধ্যে কথা হচ্ছিল বাংলায়। ছাদেকুর যখন এসব বার্তা দেখাচ্ছিলেন, তখন একটু অবাকই হয়েছিলাম।। বিষয়টা পরিষ্কারও করলেন ছাদেকুর—‘টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন কানা। ২০১১ সালে এই তরুণীসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি দল এ দেশে এসেছিল। তখন তাদের সঙ্গে দোভাষী হিসেবে কাজ করেছিলাম। যোগাযোগটা এখনো রয়ে গেছে।’
১৯৯২ সালে কুমিল্লার ছাদেকুর পাড়ি জমান জাপানে। সেখানে গিয়ে সাড়ে তিন বছর শেখেন জাপানি ভাষা। এরপর কাজ
করেন সেখানে। ২০০০ সালে দেশে ফিরে কয়েক মাস পর যোগ দেন একটি পর্যটন প্রতিষ্ঠানে। তখন থেকেই ট্যুরিস্ট গাইড ও জাপানি ভাষার দোভাষী হিসেবে কাজ করছেন তিনি। বললেন, ‘দোভাষী হিসেবে কখনো কখনো কঠিন পরিস্থিতিতেও পড়তে হয়। জাপানের টোকিও ব্রডকাস্টিং সিস্টেমের (টিবিএস) একটি দল বাংলাদেশে এসেছিল সুন্দরবনের মধু আহরণ নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র তৈরির কাজে। তাদের দোভাষী ছিলাম আমি। আমরা
যখন সুন্দরবনে অবস্থান করছিলাম, তখন আঘাত হেনেছিল ঘূর্ণিঝড় আইলা। সবাই বেশ ভয় পেয়েছিলাম। সেই দুর্যোগের মধ্যেই কাজ শেষ করেছিলেন তাঁরা।’
পাঁচ ভাষা জানা জিহাদ বারী
অস্ট্রিয়ার দুই নাগরিক বাংলাদেশে ঘুরতে এসে তর্ক করছিলেন জিহাদ বারীর অফিসে, জার্মান ভাষায়। তাঁরা জানতেন না জিহাদ জার্মান জানেন। তাঁদের তর্কের বিষয় ছিল, বাংলাদেশে ঘোরার জন্য প্যাকেজ ট্যুর নেবেন কি না। এটা বুঝতে পেরে বেশ হাসিও পাচ্ছিল জিহাদের। এতে জিহাদ যে পর্যটন প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন, তাদের উপকারই হয়েছিল। একাধিক ভাষা জানলে বিশেষ সুবিধা পাওয়া যায়, জানালেন তিনি।
বাংলা, জার্মান, ইংরেজি, ইতালীয় ও স্প্যানিশ—এই পাঁচটি ভাষা রপ্ত করেছেন জিহাদ। বাংলার পর জার্মানটা একটু বেশি জানেন তিনি। নিজের চেষ্টায় শিখেছেন এসব ভাষা। ২০১১ সালে জার্মানি থেকে পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরে এই তরুণ যোগ দেন একটি পর্যটন প্রতিষ্ঠানে, কাজ করছেন যোগাযোগ ব্যবস্থাপক হিসেবে। মূলত জার্মান ভাষার দোভাষী তিনি।
মজার স্মৃতি আছে কি না, জানতে চাইলে জিহাদ বারী বলেন, ‘ঠিক মজার কি না, বলতে পারব না। তবে মনে রাখার মতো একটা স্মৃতি আছে। হংকংয়ের এক তরুণী পর্যটকের সঙ্গে ছবি তুলেছিলাম ২০১৩ সালে। দুই বছর পর একদিন হুট করে সেই মেয়ে আমার অফিসে এসে হাজির। তিনি আমাকে ছবিটা দেন। আমি তো পুরোই অবাক।’
চায়ে কলা চুবিয়ে খাওয়া
মো. শাহাদাৎ হোসেন ঢাকায় বেড়াতে আসা এক চীনা নাগরিককে শিখিয়েছিলেন চায়ের মধ্যে বিস্কুট চুবিয়ে খাওয়ানো। এর কদিন পরই ওই চীনা লোকটি শাহাদাতের সামনেই চায়ে কলা চুবিয়ে খেতে লাগলেন। হতভম্ব শাহাদাৎ! ওই লোকের সঙ্গে সম্পর্কটা আন্তরিক হয়ে ওঠে তার পর থেকেই। শাহাদাৎ ছিলেন তাঁর দোভাষী।
দোভাষী হিসেবে ২০১২ সাল থেকে কাজ করছেন শাহাদাৎ। তার আগে ২০০৬ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত কেটেছে চীনে। বড় ভাই চীনে থাকতেন। সেখানে ব্যবসা করেন। সে সূত্রে শাহাদাৎ ও তাঁর পরিবার পাড়ি জমায় চীনে। শাহাদাতের বড় ভাইয়ের স্ত্রী চীনা। তাঁর কাছ থেকেই শিখেছেন চীনা ভাষা। দেশে ফিরে তাই কাজ করছেন চীনা ভাষার দোভাষী হিসেবে।