প্রত্ননিদর্শন ও জাতীয়তাবাদ
গত মাসে জার্মানির রাজধানী বার্লিনে পুনরায় উদ্বোধন হলো নয়েস মিউজিয়াম বা নতুন জাদুঘরের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বার্লিনে বোমা হামলায় নয়েস মুজিয়ামের প্রায় ৭০ শতাংশ ধ্বংস হয়ে যায়। এই জাদুঘরে এখন রাখা হয়েছে সাড়ে তিন হাজার বছরের পুরোনো মিসরের সুন্দরী রানি নেফারতিতির আবক্ষ মূর্তি। মূর্তিটি দেখার জন্য এখন নয়েস মুজিয়ামের সামনে হাজার হাজার মানুষের ভিড়। তবে এ মূর্তিকে ঘিরে শুরু হয়েছে নতুন এক সাংস্কৃতিক যুদ্ধ। মিসরের প্রত্নতাত্ত্বিক জাহি হাওয়াসের দাবি নেফারতিতির এই মূর্তির আসল মালিক তার দেশ এবং অবিলম্বে এই অমূল্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনটি তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হোক। আর তা না হলে জার্মানি প্রমাণ করুক যে প্রায় ১০০ বছর আগে সেটি মিসর থেকে অবৈধভাবে আনা হয়নি।স্পাইজেল অনলাইনকে দেওয়া সাক্ষাত্কারে জাহি হাওয়াস বলেন, ‘আমরা গুপ্তধন শিকারি নই। যদি এটা প্রমাণিত হয় যে নেফারতিতির এই অমূল্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনটি চুরি হয়নি, তাহলে তো আর কোনো সমস্যাই রইল না। কিন্তু আমি নিশ্চিত যে সেটি চুরি করা হয়েছিল।’জাহি হাওয়াস এর আগে ফ্রান্সের ল্যুভর জাদুঘরের কাছে পাঁচটি চিত্রকর্মের খণ্ডিত অংশ ফেরত চেয়েছিলেন। ২০০০ ও ২০০৩ সালে ল্যুভর মিউজিয়াম নিলামে এই চিত্রকর্মগুলো কিনেছিল। মিসরের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর লুক্সরের কাছে তিন হাজার ২০০ বছরের পুরোনো কবরে এসব চিত্রকর্ম রক্ষিত ছিল।মিসর আগেও এমন দাবি তুলেছিল, কিন্তু এবার তারা রাজধানী কায়রোর কাছে সাক্কারায় ল্যুভরের দীর্ঘদিন ধরে চলা খনন কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। বিশ্লেষকেরা বলছেন, মিসরের এসব প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন দাবির ও কঠোর অবস্থানের পেছনে অন্য কারণ রয়েছে। জাতিসংঘের সাংস্কৃতিক সংস্থা ইউনেসকোর মহাপরিচালকের পদে মিসরের সংস্কৃতিমন্ত্রী ফারুক হোসনির আবেদন খারিজ হয়ে যাওয়ার পরই মিসর এসব দাবি তোলে। গত মাসে এই পদে নিয়োগ পান একজন বুলগেরীয় কূটনীতিক।ফারুক হোসনি প্রথম আরব, যিনি ইউনেসকোর মহাপরিচালকের পদের জন্য আবেদন করেন। তাঁর এই আবেদনের খবর জানার পর ইহুদি গোষ্ঠীগুলো এবং ফরাসি ও জার্মান বুদ্ধিজীবীরা ফারুক হোসনির বিরুদ্ধে প্রচার শুরু করেন। এমন প্রচারেরও কারণ রয়েছে। গত বছর মিসরের পার্লামেন্টে আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরিতে ইসরায়েলি বইয়ের উপস্থিতি সম্পর্কে যখন ফারুক হোসনির কাছে জানতে চাওয়া হয়, তখন তিনি বলেছিলেন, ‘লাইব্রেরিতে যদি কোনো ইসরায়েলি বই থাকে, তাহলে সেগুলো পুড়িয়ে ফেলো। আমি নিজে আপনাদের সামনে সেগুলো পোড়াব।’ বিশ্লেষকদের ধারণা, তাঁর এ বিরূপ মন্তব্যের কারণেই তিনি ইউনেসকোর মহাপরিচালক পদে নিয়োগ পাননি। ২০০১ সালে ফারুক হোসনি মন্তব্য করেছিলেন, ইসরায়েলি সংস্কৃতি হচ্ছে ‘অমানবিক’ সংস্কৃতি, যা চুরির ওপর প্রতিষ্ঠিত।পরে অবশ্য ফারুক হোসনি ফরাসি একটি পত্রিকাকে বলেন, তিনি তাঁর মন্তব্যের জন্য দুঃখিত। ইহুদি সংস্কৃতি বা অন্য কোনো সংস্কৃতিকে আঘাত করার কোনো ইচ্ছা তাঁর ছিল না।ইউনেসকোর মহাপরিচালকের পদ পেতে ব্যর্থ হওয়ার জন্য ফারুক হোসনি ইহুদিদের ষড়যন্ত্রকে দায়ী করেন। তিনি মিসরের একটি সাপ্তাহিকীকে দেওয়া সাক্ষাত্কারে বলেন, আপনারা যেমনটা কল্পনা করছেন, এই ষড়যন্ত্র তার চেয়েও গভীর।ইউনেসকোর মহাপরিচালকের পদ পেতে ফারুক হোসনি ব্যর্থ হওয়ার পর জাহি হাওয়াস ফ্রান্স ও জার্মানিতে যান এবং সেখানকার জাদুঘরে রক্ষিত সামগ্রীকে নিজেদের বলে দাবি করেন। এ ব্যাপারে অবশ্য হাওয়াসের মন্তব্য হচ্ছে, ইউনেসকোর ওই সিদ্ধান্তের দুই মাস আগেই তিনি এসব দাবি তুলেছেন। দেশের মূল্যবান প্রত্নসামগ্রী ফিরিয়ে আনাই তাঁর উদ্দেশ্য। কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য এতে নেই।তবে জার্মানি বলেছে, ১৯১২ সালে মিসরের তেল এল আমারনা থেকে নেফারতিতির এই অমূল্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনটি আবিষ্কার করেন জার্মান স্থপতি লুডভিগ বরখ্হার্ড এবং সেটি বার্লিনে নেওয়ায় মিসরীয় অনুমোদনও ছিল। কোনোভাবেই এটি অবৈধ পন্থায় আনা হয়নি। এদিকে ইরাকও বারবার জার্মানির কাছে প্রাচীন শহর ব্যাবিলনের গেট অব ইশতার ফেরত চেয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে গেট অব ইশতার বার্লিনে নেওয়া হয়।মিসরের পার্লামেন্টের মুসলিম ব্রাদারহুডের একজন সদস্য মুহসিন রাদি স্থানীয় একটি দৈনিকে লিখেছেন, মিসরের একমাত্র শক্তিশালী অস্ত্র সম্ভবত তাঁর প্রত্নসামগ্রী। এগুলো দেশের মানুষের ভাবাবেগ ও জাতীয় গর্বের জায়গাকে উসকে দেয়। বহু বছরের সংগ্রহের ফসল এসব প্রত্নসামগ্রী। এর মধ্যে নীল নদে অনেক জল গড়িয়েছে। রাজা এসেছে, রাজা গেছে। কালের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এসব প্রত্নসামগ্রীর কোনো কোনোটি মিসর থেকে অন্য দেশে চলে গেছে। মিসর যে এসব প্রত্নসামগ্রী দাবি করছে, তার পেছনে রয়েছে জাতীয়তাবাদী ভাবধারা।মুহসিন রাদি বলেন, প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো পরিণত হচ্ছে রাজনৈতিক দাবার ঘুঁটিতে। এসব নিয়ে অযথাই উত্তেজনা ভরা পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হচ্ছে। এখন এসব প্রত্নসামগ্রী দাবি করার কোনো অর্থ হয় না। কারণ এটা প্রমাণ করা শক্ত যে সত্যিই এগুলো চুরি হয়েছে।