আমার প্রতি বসের আচরণ আপত্তিকর

পাঠকের প্রশ্ন বিভাগে আইনগত সমস্যা নিয়ে নানা রকমের প্রশ্ন পাঠিয়েছেন পাঠকেরা। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মিতি সানজানা নির্বাচিত প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন এবার।

মিতি সানজানা
ছবি: প্রথম আলো

প্রশ্ন: আমি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করি। ছয় মাস আগে যোগ দিয়েছি। চাকরির শুরু থেকেই আমার ঊর্ধ্বতন আমার সঙ্গে হয়রানিমূলক আচরণ করেন। অনেকবার তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি যে, তাঁর কিছু মন্তব্য ও আচরণ আমার পছন্দ নয়। তখন তিনি আমাকে বলেন, ‘আপনি সবকিছু সিরিয়াসলি নেন, জোকস বোঝেন না।’ কিন্তু আমার প্রতি তাঁর আচরণ যথেষ্ট আপত্তিকর। প্রায় প্রতিদিন তিনি আমাকে কারণে–অকারণে তাঁর রুমে ডেকে নেন এবং নানা ধরনের অপ্রয়োজনীয় ও আপত্তিকর কথা বলেন, যা আমার পক্ষে এখানে লেখা সম্ভব নয়। অনেক সময় ধরে আমাকে বসিয়ে রেখে তাঁর ব্যক্তিগত এবং দাম্পত্য জীবনের নানা কথা শুনতে বাধ্য করেন। কথায় কথায় তিনি আমাকে বোঝান, আমি অনেক সুন্দরী এবং আকর্ষণীয়। কিন্তু আমার সৌন্দর্য আমি কোনো কাজে লাগাচ্ছি না। এভাবে আমার পেশাগত কোনো উন্নতি হবে না। মাঝেমধ্যেই তিনি আমাকে তাঁর সঙ্গে লাঞ্চ বা ডিনার করার জন্য বাইরে যেতে বলেন। তিনি প্রায়ই আমাকে বলেন, ‘কিছু দরকার হলে আমাকে জানাবেন, আমি প্রয়োজনে সব সময় আপনার পাশে থাকব।’ তাঁর এ ধরনের বাজে ইঙ্গিতপূর্ণ কথাবার্তায় আমি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছি। তিনি আমার শারীরিক গঠন ও সৌন্দর্য নিয়ে অনেক মন্তব্য করেছেন, যা আমার কাছে অশালীন মনে হয়েছে। এ অবস্থায় আমি কী কোনো আইনি প্রতিকার পেতে পারি?

রেবা (ছদ্মনাম), বাড্ডা।

উত্তর: কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ অনেক বেড়েছে। সরকারি-বেসরকারি চাকরি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সব জায়গায় নারীদের সুযোগ বাড়ছে। পাশাপাশি নানা ধরনের সমস্যায়ও তাঁরা পড়ছেন। যেমন হয়রানি একটা বড় সমস্যা। শারীরিক, মৌখিক, মানসিক—বিভিন্নভাবে একজন নারী যৌন হয়রানির শিকার হতে পারেন।

কর্মক্ষেত্রে নারীর প্রতি সব ধরনের হয়রানি বন্ধের উদ্দেশ্যে ২০০৯ সালের ১৪ মে হাইকোর্ট একটি রায় দেন। এ রায়ে হাইকোর্ট দেশের সব সরকারি–বেসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, বহুজাতিক কোম্পানি, গণমাধ্যম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সব প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে ‘যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি’ নামে কমিটি গঠন করার আদেশ দেন। হাইকোর্টের নির্দেশনা মোতাবেক সব প্রতিষ্ঠানে ‘যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি’ গঠন করা বাধ্যতামূলক।

এ বিষয়ে সচেতনতা ও জনমত তৈরির জন্য হাইকোর্টের নির্দেশনায় বলা হয়েছে, সব প্রতিষ্ঠানে এ বিষয়ে সচেতনতা তৈরির উদ্দেশ্যে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও কর্মশালার আয়োজন করতে হবে এবং সংবিধানে বর্ণিত লিঙ্গীয় সমতা ও যৌন নিপীড়নসম্পর্কিত দিকনির্দেশনাটি বই আকারে প্রকাশ করতে হবে।

হাইকোর্টের এ নির্দেশনা আইনে রূপান্তরিত না হওয়া পর্যন্ত আমাদের সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এ নির্দেশনাই আইন হিসেবে কাজ করবে এবং সব সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য এই আইন প্রযোজ্য হবে।

হাইকোর্টের রায়ে যৌন নিপীড়নের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, শারীরিক, মানসিক, মৌখিক যেকোনো ধরনের নির্যাতনই যৌন হয়রানির মধ্যে পড়ে। ই-মেইল, এসএমএস, টেলিফোনে বিড়ম্বনা, পর্নোগ্রাফি, কোনো ধরনের অশালীন চিত্র, অশালীন উক্তিসহ কাউকে ইঙ্গিতপূর্ণভাবে সুন্দরী বলাও যৌন হয়রানির পর্যায়ে পড়ে।

কোনো ধরনের অশালীন উক্তি, কটূক্তি করা, কারও দিকে খারাপ দৃষ্টিতে তাকানো ইত্যাদিও আইনের দৃষ্টিতে যৌন হয়রানি হিসেবে গণ্য করা হয়। রায়ে বলা আছে, কোনো নারীকে ভয়ভীতি প্রদর্শন, যেকোনো ধরনের চাপ প্রয়োগ করা, মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে সম্পর্ক স্থাপন, অশালীন চিত্র, দেয়াল লিখন, আপত্তিকর কিছু করা যৌন হয়রানির মধ্যে পড়বে। আপনার বস আপনার সঙ্গে যে ধরনের আচরণ করছেন, তা আপাতদৃষ্টে হয়রানির মধ্যে পড়ে। সে ক্ষেত্রে আপনি অবশ্যই আপনার প্রতিষ্ঠানে ‘যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি’তে আপনার অভিযোগ জানাতে পারবেন। যে কেউ যৌন হয়রানি করলে ওই কমিটির কাছে ভুক্তভোগী ব্যক্তি অভিযোগ জানাতে পারবেন। সমস্ত পরিস্থিতি বিবেচনা করে, সাক্ষ্য–প্রমাণের ভিত্তিতে যদি আপনার বসের অপরাধ প্রমাণিত হয়, তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে অসদাচরণের জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে। এ ধরনের কোনো কমিটি না থাকলে আপনি অবশ্যই মানবসম্পদ বিভাগে আপনার অভিযোগটি জানাবেন। পাশাপাশি অপরাধের মাত্রা অনেক বেশি হলে দেশের অন্যান্য প্রচলিত আইনেও ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।

পাঠকের প্রশ্ন, বিশেষজ্ঞের উত্তর

আইন, ডায়েট এবং মন–সংক্রান্ত যে কোনো প্রশ্ন পাঠক পাঠাতে পারেন। প্রশ্ন পাঠানো যাবে ই–মেইলে, ডাকে এবং প্র অধুনার ফেসবুক পেজের ইনবক্সে। ই–মেইল ঠিকানা: [email protected] (সাবজেক্ট হিসেবে লিখুন ‘পাঠকের প্রশ্ন’)

ডাক ঠিকানা: প্র অধুনা, প্রথম আলো,

প্রগতি ইনস্যুরেন্স ভবন, ২০–২১ কারওয়ান বাজার, ঢাকা ১২১৫।
(খামের ওপর লিখুন ‘পাঠকের প্রশ্ন’) ফেসবুক পেজ: fb.com/Adhuna.PA