বড় করে ভাবুন, ছোট করে শুরু করুন

ইউএনডিপিকে সঙ্গী করে গ্রামীণফোনের উদ্যোগে ও প্রথম আলোর সহযোগিতায় বিশ্ব যুব দক্ষতা দিবস উপলক্ষে চলছে ‘গেট ফিউচার রেডি’ ট্যাগলাইনে মাস্টারক্লাস সিরিজ। তরুণদের দক্ষতা উন্নয়নে ‘রেজিলিয়েন্ট এন্টারপ্রেনারশিপ ফর ইয়ুথ’ বিষয়ের বিশেষ সেশনে প্রধান আলোচক হিসেবে কথা বলেছেন বিজিএমইএর (বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি) সাবেক সভাপতি রুবানা হক। এই অনুষ্ঠানে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন গ্রামীনফোনের ইনহাউসস্কিল একাডেমি - 'গ্রামীনফোন এক্সপ্লোরার' প্রোগ্রামের ৩০ জন তরুণ। সেশনটি পরিচালনা করেন শাম্মু ফারহানা।  

মাস্টারক্লাসে অংশগ্রহণকারীরা

রুবানা হক বলেন, তরুণেরা অনেক জানেন। তারুণ্যের শক্তির সঙ্গে অন্য কোনো কিছুর তুলনা চলে না। নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে প্রথমেই বললেন, তিনি তিন সন্তানের মা আর তাঁর তিনজন নাতি-নাতনি আছে। ক্লাস নেওয়ার জন্য তিনি কোনো প্রেজেন্টেশন বানিয়ে আনেনি। বলেছেন যে ছাত্রদের স্লাইড দেখিয়ে ‘বোর’ করতে চান না, বরং মাস্টারক্লাসে অংশগ্রহণকারীদের কাছ থেকে শুনতে চেয়েছেন তাঁদের জানার বিষয়। এভাবেই শুরু হয়েছে আলোচনা।

অনিশ্চয়তা একটা বৈশ্বিক সমস্যা। অনেক তরুণই তাই লক্ষ্যে এগোতে গিয়ে মাঝপথে এসে থেমে যান। স্বপ্ন ছেড়ে দেন। তাঁদের উদ্দেশে রুবানা হক বলেন, ‘যতবার পড়বেন, ততবার উঠে দাঁড়াবেন। ছাই থেকেই জেগে উঠতে হবে। সিসিপাসকে খাড়া পাহাড়ে পাথর টেনে তোলার শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। পাথর চূড়ায় পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই সেই পাথর গড়িয়ে গড়িয়ে নিচে পড়ে যায়। তাই অনন্তকাল ধরে চলছে সেই সাজা। এভাবেই অনন্তকাল ধরে তরুণদের ছুটতে হবে তাঁদের স্বপ্নের পেছনে।’ রুবানা জানান, একজন মানুষের জীবনে অনুপ্রেরণা খুবই জরুরি। যদি সেটা অন্য কেউ করেন, তাহলে ভালো। যদি অন্য কেউ না করেন, তাহলে নিজেই নিজেকে অনুপ্রাণিত করতে হবে।

মাস্টারক্লাসে কথা বলছেন রুবানা হক

কঠোর বিধিনিষেধে বাংলাদেশে তরুণ উদ্যোক্তাদের সংখ্যা বেড়েছে। অনেক উদ্যোগ হাঁটিহাঁটি পা–পা করে এগিয়ে গেছে। হবু উদ্যোক্তাদের উদ্দেশে সফল, আইকনিক এই নারী উদ্যোক্তা বলেন, যেকোনো উদ্যোগ শুরু করার আগে ‘ভোক্তাশ্রেণি’ কারা, সেটি নির্ধারণ করতে হবে। কাদের তিনি পণ্য বা সেবা দেবেন, সেটা আগে ঠিক করে নেওয়া জরুরি। ব্যবসায় নেটওয়ার্কিংটাও দরকার। একজন জানালেন, তিনি রেস্টুরেন্ট ব্যবসা করতে চান। তাই পরামর্শ চাইলেন রুবানা হকের কাছে। পরামর্শ দিয়ে রুবানা বলেন, ‘মহামারিকাল আমাদের জীবনযাপন, চিন্তা ও দর্শন বদলে দিয়েছে। এই অনিশ্চয়তায় সবাই স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে চায়। সবাই বেশি দিন বাঁচতে চায়। তাই রেস্টুরেন্ট ব্যবসার প্রথম ধাপ হবে স্বাস্থ্যকর খাবার ও পরিবেশ নিশ্চিত করা। তারপর সেই খাবারের স্বাদ ও পুষ্টিগুণ নিশ্চিত করা। ভার্চ্যুয়াল প্লাটফর্ম থেকে যাতে খাবার কেনা যায়, সেই দিকটি দেখতে হবে। নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট বা পেজ না, ভার্চ্যুয়ালি সেই ওয়েবসাইটকে সাজাতে হবে। আর অন্যের রেস্টুরেন্ট থেকে এটাকে আলাদা করতে হবে।’

কাস্টমারকে এমন কিছু দিতে হবে বা এমন কোনো ভ্যালু অ্যাড করতে হবে, যা তিনি অন্য কোথাও থেকে পান না। খাবারটা যেন শুধু খাবারের ভেতর সীমাবদ্ধ না থাকে। প্যাকেজিংটাও রুচিশীল হতে হবে। যেকোনো কিছু কতটা টেকসই, সেটা ভাবতে হবে।’
চারপাশে নানান আইডিয়া ছড়িছে–ছিটিয়ে আছে। সেখান থেকে আইডিয়া নিতে হবে। যেমন কোনো তরুণ যদি আইটি সেক্টরে অন্যদের সাহায্য করার কাজ শুরু করেন, তিনি নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ নেওয়ার প্রক্রিয়া সম্পর্কে সবাইকে জানাতে পারেন। আর সেই ঋণ নেওয়া যাতে সহজ হয়, সেটি নিয়েও কাজ করতে পারেন। ডেডলাইন, চাপ ও চ্যালেঞ্জকে ইতিবাচকভাবে নিতে হবে। যেকোনো সমস্যা, সীমাবদ্ধতা ও বাধা খাতায় লিখে নিয়ে একটা একটা করে সমাধান করতে হবে। হেরে যাওয়ার কোনো সুযোগই নেই। বরং বলেছেন, নেগেটিভ ইমোশনকে পজিটিভ এনার্জিতে পরিণত করতে হবে। সে জন্য বন্ধু, বাবা–মায়ের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে।

উদ্যোগের ক্ষেত্রে বাজেট একটা বড় সমস্যা। অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যায়, উদ্যোগ শুরু করার অল্প সময়ের মধ্যেই বাজেট শেষ হয়ে যায়। এমনভাবে শুরু করতে হবে, যাতে অন্তত দেড় বছর টিকে থাকা যায়। মূলধন খুব বেশি নেই, এমন সবাইকে উদ্দেশ করে রুবানা বলেন, ‘থিঙ্ক বিগ, বাট স্টার্ট লিটল। আপনারা চিন্তা ছোট করবেন না। তবে ছোট করে শুরু করুন। আমি আর আমার হাজব্যান্ড (ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, ঢাকা উত্তরের সাবেক মেয়র ও টেলিভিশন উপস্থাপক আনিসুল হক) ছোট করেই আমাদের ব্যবসাটা শুরু করেছিলাম। ভাড়া বাসায় থাকতাম। ব্যবসার প্রথম পুঁজি বিশ্বাসযোগ্যতা। ব্যবসা করতে আসলে খুব বেশি টাকা লাগে না। অনেক মানুষের অনেক টাকা থাকতে পারে। কিন্তু তার মানে এই না যে তিনি ভালো ব্যবসায়ী।’

নতুন উদ্যোগ শুরু করার আগে যদি সাহস বা আত্মবিশ্বাস না থাকে, সে ক্ষেত্রে দুজন বা তিনজন সমমনা মানুষকে সঙ্গী করে শুরু করতে হবে। ভয় করলে চলবে না। সাহসকে সঙ্গী করে এগিয়ে যেতে হবে। বন্ধুবান্ধব বা অংশীদারকে রেলিং বানান। তারপর রেলিং বেয়ে এগিয়ে চলুন। যাতে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা না থাকে। জীবনের কোনো পর্যায়েই ভয় পেলে চলবে না। নিজের সঙ্গে কথা বলারও কোনো বিকল্প নেই। প্রতিদিন নিজের সঙ্গে কথা বলা শুরু করতে বলেন রুবানা।

মন খারাপ হওয়া, ভেঙে পড়া, হতাশ হওয়া—এগুলো জীবনের অংশ, স্বাভাবিক ব্যাপার। মন খারাপ হলে একটু হাঁটলে বা ব্যায়াম করলে অথবা প্রকৃতির সঙ্গে সময় কাটালে ভালো লাগে রুবানা হকের। তিনি সেই অভিজ্ঞতাই ভাগ করে নিলেন উপস্থিত ব্যক্তিদের সঙ্গে। বললেন, ‘প্রতিটা সময়ের একটা স্ট্রেস থাকে। একসময় পরীক্ষা একটা বড় মানসিক চাপ সৃষ্টি করে। সম্পর্ক একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। এরপরও জীবনভর আমাদের বড় বড় পরীক্ষা দিতে হয়। বড় বড় চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হয়। প্রতিটি পরীক্ষায় পাস করতে হয়। আমি সকালে উঠে দিনটা শুরু করি উঁচু ভলিউমে গান শুনে। তারপর অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হই। গাছে পানি দিলেই গাছটা বড় হয়। আমাদের মন আর মস্তিষ্কও গাছের মতো। আমাদের প্রতিনিয়ত জিইয়ে রাখতে হয়।’

জীবনে বিরতি নেওয়ারও দরকার আছে বলে মনে করেন তিনি। বললেন যে মাঝেমধ্যে দায়িত্বহীন জীবনযাপনেরও দরকার আছে। দুই বছর বিজিএমইএর দায়িত্ব পালনের পর তিন মাসের জন্য ছুটি নিয়েছিলেন রুবানা হক। সেটিই মনে করিয়ে দিলেন সবাইকে। বললেন, স্বপ্নভঙ্গ হওয়া মানেই স্বপ্নের শেষ নয়। এর মানে, একটু থামা। ভুলটা খুঁজে বের করা। অভিজ্ঞতা নিয়ে নতুন করে ঝাঁপিয়ে পড়া। ‘জীবনের নানা রং। একেক সময় একেকটা রং মনে ধরে আমাদের। আর তখন আমরা সেই স্বপ্নের পেছনে সাহসের সঙ্গে নতুন উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়ি।’