ভাইয়ের পর মাকেও হারালাম

মেহেরপুর জেলার গ্রাম গাড়াডোব। আলোচনায় এসেছে করোনা ও উপসর্গ নিয়ে মানুষের মৃত্যুর সংখ্যার কারণে। গাংনী উপজেলার গাড়াডোব গ্রামে ২৫ দিনে করোনা ও উপসর্গ নিয়ে ২১ জন মারা গেছেন। এই গ্রামের স্বজন হারানো একজনের শোকগাথা এখানে।

কিছুদিন আগেই আমার বিয়ে হয়। বাড়িতে তখন রীতিমতো উৎসবের আমেজ। বিয়ের দাওয়াতে নিকটাত্মীয়রা এসেছিলেন, ছিলেন প্রতিবেশীরাও। আমার বড় ভাই বাবর আলী বিয়ের সব দায়িত্ব একা সামলেছেন। যেভাবে তিনি বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে আমাদের চার সদস্যের সংসারটা সামলে আসছিলেন।

কয়েক দিন পর আবার সেই একই বাড়িতে আত্মীয়েরা এলেন। তবে এবার আনন্দ নেই। বাড়িজুড়ে শুধুই বিষাদ। আমার ভেতরে হারানোর বেদনা। তিন দিনের মধ্যে ভাইকে হারানোর পর মাকেও হারাই। করোনা আমাকে নিঃস্ব করে দিল, অভিভাবকহীন করে দিল। এই শোক আমি কীভাবে বয়ে বেড়াব, জানি না।

চলতি মাসের শুরুতে আশপাশের বাড়ির কাউকে কাউকে দেখছিলাম মৌসুমি জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছেন। সেরেও উঠেছেন অনেকে। এরই মধ্যে পাশের বাড়ির একজন সর্দি, জ্বর ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে মারা গেলেন। গ্রামের মানুষ তখনো করোনা সম্পর্কে অসচেতন। স্বাস্থ্যবিধি তেমন একটা মেনে চলেন না। কিন্তু তখনো বুঝতে পারিনি করোনা আমাদের পরিবারে আঘাত হানবে।

শোকে মুহ্যমান বশির আহম্মেদ
ছবি: প্রথম আলো

হঠাৎ ভাই জ্বরে আক্রান্ত হলেন। ভেবেছিলাম মৌসুমি জ্বর। যেদিন শ্বাসকষ্ট শুরু হলো, সেদিনই নিয়ে চললাম মেহেরপুর সদর হাসপাতালে। চোখের সামনে বাবার মতো বড় ভাই আমার ছটফট করছিলেন। তাঁর চিকিৎসা শুরু হলো।

আগে কখনো এভাবে হাসপাতালের যাওয়া হয়নি। ভাইকে নিয়ে ওই দিন হাসপাতালের বারান্দায় সারা রাত জেগে ছিলাম। হাসপাতালজুড়ে করোনা রোগীর ভিড়। একটু আগেও যাঁকে শ্বাসকষ্টে ছটফট করতে দেখলাম, একটু পর তাঁরই মৃতদেহ নিয়ে স্বজনেরা বাড়ি ফিরছেন। পরদিন ভোরের দিকে নির্মম সত্যটি আমার সামনে এসে হাজির। বড় ভাই মারা গেলেন। পুরো পৃথিবীটা তখন অন্ধকার মনে হচ্ছিল। বড় ভাই কাঠের ব্যবসা করতেন। আমাদের সামান্য আবাদি জমি আছে, দেখভাল করতেন। আমি ছিলাম তাঁর সহকারী। এখন আমি একা।

বড় ভাইয়ের দাফনের পর বাড়িতে এসে দেখি মা অসুস্থ বোধ করছেন। অসুস্থতা বাড়তে থাকল। মাকে নিয়েও হাসপাতালে ছুটলাম। হাসপাতালে যাওয়ার পথে মায়ের হাত-পা শীতল হয়ে আসছিল। পুরো পথ মায়ের পাশে থাকলাম। হাসপাতালে তাঁকে দ্রুত ভর্তি করে বারান্দায় দাঁড়াই। দায়িত্বরত নার্সরা মায়ের মুখে অক্সিজেন মাস্ক পরিয়ে দিলেন। মুখে অক্সিজেন লাগানোর পর মাকে একটু সুস্থ মনে হচ্ছিল। আশায় বুক বাঁধলাম।

মাকে হাসপাতালে ভর্তির দুই দিন পর তিনিও মারা গেলেন। নির্মম এই শোকের মধ্যে বুঝতে পারলাম, পকেটে টাকা নেই। মায়ের মৃতদেহ অ্যাম্বুলেন্সে করে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারলাম না। হাসপাতালের বাইরে গ্রামের পরিচিত এক বড় ভাইয়ের ইজিবাইকে মাকে নিয়ে বাড়ির পথে রওনা হলাম।

মায়ের মৃত্যুর খবরে প্রতিবেশীরা কেউ এগিয়ে এলেন না। তখন গ্রামজুড়ে করোনা-আতঙ্ক। মৃত্যুসংবাদ। ১০ জনের মতো আত্মীয় এসেছিলেন, তাঁদের সঙ্গে নিয়ে জানাজা পড়ানো হলো।

আমাদের গ্রামের কবরস্থানটি এখন যেন কাঁচা বাঁশের ছোট ছোট ঘরে পরিণত হয়েছে।

অনুলিখন: আবু সাঈদ, মেহেরপুর