ভাগ্যিস, সেদিন বিয়েটি হয়নি

জাতীয় দলের আবাসিক ক্যাম্পে অনুশীলন করছেন ইতি খাতুন। টঙ্গীর শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার স্টেডিয়াম থেকে ১৭ সেপ্টম্বর ছবিটি তুলেছেন খালেদ সরকার

বিয়েটা হয়ে গেলে এত দিন হয়তো ইতি খাতুনের কোলজুড়ে থাকত ফুটফুটে সন্তান। ঘরকন্না সামলে আর আট-দশজন গৃহিণীর মতোই মিশে যেতেন সংসারের কোলাহলের মিছিলে।

কিন্তু এই মেয়ে যে সবার চেয়ে আলাদা! বিয়ের আসর থেকে সেদিন না পালালে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে এমন বিরল ইতিহাস কি লেখা হতো? গত বছর নেপালের পোখারায় দক্ষিণ এশিয়ান গেমসে আর্চারিতে ইতি জেতেন তিনটি সোনা। গেমসের ৩৫ বছরের ইতিহাসে এর আগে বাংলাদেশের কোনো নারী খেলোয়াড় নির্দিষ্ট একটি গেমসে তিনটি সোনা জিততে পারেননি। শুধু তা–ই নয়, আরেকটি কীর্তিও গড়েন ইতি এসএ গেমসে। মেয়েদের রিকার্ভ ইভেন্টের সোনার পদক জেতার পথে কোয়ার্টার ফাইনালে ইতি হারিয়েছিলেন ভুটানের আর্চার কারমাকে। ওই বছরই কারমা ভুটানের হয়ে সরাসরি অলিম্পিকে খেলার সুযোগ পান।

এত এত সাফল্য! অথচ আগের মতোই এখনো চুয়াডাঙ্গা শহরের বেলগাছি মুসলিমপাড়ায় রেলওয়ের পোড়ো জমিতে মা–বাবার সঙ্গে থাকেন ইতি। আগের মতোই ইতির বাবা ইবাদত আলী রেস্তোরাঁর কর্মচারী। তবে ইতির জীবনের মোড় সত্যি সত্যিই ঘুরে গেছে।

বিয়ের পিঁড়ি ফেলে পদকমঞ্চে ওঠার যে স্বপ্নটা দুই বছর আগে দেখতেন, সেটা সত্যি হয়েছে ইতির। ঘরোয়া টুর্নামেন্টের সাফল্যের পর এই তিরন্দাজ নিয়মিত আলো ছড়াচ্ছেন আন্তর্জাতিক আসরে। এ বছর বাংলাদেশ ক্রীড়ালেখক সমিতির পুরস্কার জেতার পর ১১ সেপ্টেম্বর পেয়েছেন ‘অনন্যা শীর্ষ দশ ২০১৯ সম্মাননা’। এসএ গেমসে সোনা জেতায় বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন (বিওএ) থেকে পেয়েছেন ১১ লাখ টাকা। সরকার থেকে চুয়াডাঙ্গা শহরের মনিরামপুরে দেওয়া হয়েছে ৫ শতক জমি। সেখানেই নিজেদের মাথা গোঁজার ঠাঁই করার স্বপ্ন দেখেন। পাড়ার যে ছেলেরা অনুশীলনে যাওয়ার সময় ইতিকে প্রতিদিন দু-চারটা বাজে কথা বলত, সেই ছেলেরাই ঘটা করে দিয়েছে সংবর্ধনা। বাবাকে একটা রেস্তোরাঁ খুলে দেওয়ার কথা ভাবছেন ইতি। সংসারের নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর অবস্থা কেটে গেছে ইতিদের।

ইতির বাল্যবিবাহের ঘটনাটা ২০১৬ সালের। তখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়তেন ইতি। পাড়ার সাথিদের সঙ্গে পুতুল খেলতেন নিয়মিত। আরেকটা খেলাও ভীষণ টানতো ইতির। তির–ধনুকের খেলায় এতটাই মজে গিয়েছিলেন যে মা–বাবার বকুনিকেও পরোয়া করেননি। খেলতে যেতেন বলে মায়ের হাতে মার খেয়েছেন অনেকবার। অনুশীলন শেষে একদিন বাড়িতে এসে দেখেন বাবা তাকে বিয়ে দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছেন। পাত্রপক্ষ বসা বাড়ির বারান্দায়। বিয়ের সব আয়োজন পাকা। শাড়ি পরে ঘোমটা মাথায় পাত্রপক্ষের সামনে গিয়ে দাঁড়ান ইতি। পাত্রপক্ষের পছন্দও হয়ে যায় ‘বালিকা বধূ’ দেখে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে বেঁকে বসেন ইতি। বিয়েটা আর হয়নি।

ইতিকে বিয়ে দেওয়ার কথা এখন ভুলেও মুখে আনেন না বাবা। প্রসঙ্গটা তুলতেই মুঠোফোনের অন্য প্রান্তে ইতির হাসিমাখা উত্তর, ‘বাবা এখন সবকিছু বোঝেন। আমাকে ডেকে প্রায়ই বলেন, তখন আমাদের সংসারের অবস্থা ভালো ছিল না। আমি তোমাকে বাধ্য হয়েই বিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এখন তোমার অবস্থা বদলেছে। তুমি যত দিন ইচ্ছা খেলতে পারো।’

জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের (এনএসসি) প্রতিভা অন্বেষণের আবিষ্কার ইতি। চুয়াডাঙ্গা স্টেডিয়ামে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে আর্চারির প্রাথমিক বাছাইয়ে হয়েছিলেন প্রথম। চুয়াডাঙ্গার ঝিনুক মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বর্তমানে নবম শ্রেণিতে পড়ছেন ইতি। দুই বছর আগে প্রথম জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিয়ে জেতেন ব্রোঞ্জ। পরের বছর জেতেন সোনা। এরপর আর্চারির জার্মান কোচ মার্টিন ফ্রেডরিখের নজরে পড়েন ইতি। সুযোগ পান জাতীয় দলের হয়ে আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে খেলার।

খেলার সুবাদে এরই মধ্যে ঘুরে এসেছেন ইন্দোনেশিয়া, স্পেন, থাইল্যান্ড ও নেপাল। বর্তমানে টঙ্গীর শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার স্টেডিয়ামে জাতীয় দলের সঙ্গে আবাসিক ক্যাম্পে আছেন ইতি। এরই মধ্যে বাংলাদেশ থেকে সরাসরি অলিম্পিকে খেলার সুযোগ পেয়েছেন আর্চার রোমান সানা। ইতিও স্বপ্ন দেখেন টোকিও অলিম্পিকে খেলার, ‘রোমান সানা ভাইয়ার মতো আমিও অলিম্পিকে খেলতে চাই। আমি এখন অলিম্পিক বাছাইয়ের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। আশা করি, আমিও অলিম্পিকে খেলব একদিন।’

এলাকায় ইতিকে নিয়ে গর্বের শেষ নেই। পাড়াপ্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন থেকে শুরু করে স্কুলের শিক্ষক, বন্ধুদের সবার প্রিয় ইতি। পাড়ার মোড়ে আড্ডা দেওয়া ছেলেবন্ধুরা ইতিকে দেখলেই বলেন, ‘তুই তো অনেক বড় হয়ে গেছিস। তোর মতো আমরা হতে পারলাম না। ওরা ছেলে হয়ে কিছু করতে পারেনি সত্যি, কিন্তু আমি মেয়ে হয়ে দেশের জন্য কিছু একটা করেছি। এগুলো ভাবলে নিজের কাছে খুব ভালো লাগে।’

বাল্যবিবাহ ঠেকিয়ে একটা যুদ্ধ জিতেছেন। ইতি এখন মাঠে প্রতিপক্ষের সঙ্গে লড়াইয়ে জিততে চান প্রতিনিয়ত। লড়াকু ইতি নিজের শেষটা কখনোই দেখতে চাননি, ‌‌‘মা অনেক বকতেন একসময়। বাবা বলতেন, মেয়ে হয়ে জন্মেছিস, কিসের খেলা এত? কিন্তু মা-বাবাকে বুঝিয়েছি। নিজেকে প্রমাণ করেছি। এত এত পুরস্কার পাচ্ছি, এগুলো আমার ভালো খেলার অনুপ্রেরণা।’

একদিন অলিম্পিকে খেলবেন, গলায় ঝোলাবেন সোনার পদক। লাল–সবুজের পতাকা উড়বে মাথার ওপর। এই স্বপ্ন দেখেই রোজ রাতে ঘুমোতে যান ইতি। এই স্বপ্ন দেখেই দিন শুরু হয় ইতির।