রুমকি পেরেছেন
৪৫তম জাতীয় অ্যাথলেটিকসে মেয়েদের হাইজাম্পে রেকর্ড গড়ে সোনা জিতেছেন উম্মে হাফসা রুমকি। অথচ অনুশীলনের সময় চোটে পড়ে থমকে যেতে বসেছিল তাঁর অ্যাথলেট–জীবন।
২০১৯ সাল। এসএ গেমসের আগে আগে অতিরিক্ত অনুশীলন করতে গিয়ে চোট পেলেন উম্মে হাফসা রুমকি। তা–ও তাঁকে দমানো গেল না, চোট নিয়েই ভারতে খেলতে গেলেন। কিন্তু একসময় ব্যথা অসহ্য হয়ে উঠলে চিকিৎসকের কাছে যেতে বাধ্য হলেন। সেবার চার মাস ধরে চলে চিকিৎসা। তারপরও শেষ রক্ষা হলো না। আবারও চোট। অস্ত্রোপচার ছাড়া আর কোনো বিকল্প রইল না। রুমকি বলেন, ‘দুই পায়ের হাড়ই ফেটে গিয়েছিল। শিনবোনে (হাঁটুর নিচে পায়ের সবচেয়ে বড় ও শক্ত হাড়) ২৪টি রড ঢোকাতে হয়েছিল। শিনবোনের এক পাশ দিয়ে ছিদ্র করে আরেক পাশ দিয়ে রড বের করে দেন চিকিৎসকেরা। তিন মাস পর সেই রড বের করি।’ ধীরে ধীরে চিকিৎসা পরবর্তী পুনর্বাসনের মাধ্যমে আবারও মাঠে ফেরেন রুমকি।
চোট সারলেও অস্ত্রোপচারের জের আজও টেনে চলেছে রুমকির পরিবার। চিকিৎসার খরচ লেগেছিল সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা। সিরাজগঞ্জ শহরের ক্ষুদ্র কাঁচি ব্যবসায়ী রুমকির বাবা আবদুর রহিমের এত টাকা জোগান দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না। বাধ্য হয়ে ব্যাংক ও আত্মীয়স্বজনের কাছে ঋণ নিলেন। রুমকি এখন সুস্থ আছেন, কিন্তু ঋণের কিস্তি তাঁর আজও শেষ হয়নি। আর শোধও করতে পারছেন না। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে রুমকির বাবাকে এখন বাড়ি বিক্রির কথাও ভাবতে হচ্ছে।
এসব বলতে গিয়ে কিছুটা যেন ভেঙে পড়লেন রেকর্ড কন্যা রুমকি। অথচ কে বলবে ৫ জানুয়ারি ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামে ৪৫তম জাতীয় অ্যাথলেটিকসে মেয়েদের হাইজাম্পে রেকর্ড গড়ে সোনা জিতেছেন তিনি। ১ দশমিক ৭১ মিটার উঁচু একটা লাফ দিয়েছেন। এই রেকর্ডের মাহাত্ম্য বুঝতে একটু পেছনে ফিরে যেতে হবে। তিনি যে উচ্চতায় লাফিয়েছেন, সেটা সর্বশেষ এসএ গেমসে কাঠমান্ডুতে রুপাজয়ী শ্রীলঙ্কার দুলাঞ্জলি রানাসিংহের চেয়েও বেশি। ১ দশমিক ৬৯ মিটার লাফিয়ে রুপা জেতেন দুলাঞ্জলি। এর মানে এসএ গেমসে পদক খরায় ভুগতে থাকা বাংলাদেশের অ্যাথলেটিকসের জন্য এটা যথেষ্ট আশাজাগানিয়া এক নৈপুণ্য। ২০১৯ সালেও জাতীয় রেকর্ড গড়ে সোনা জেতেন রুমকি।
যতবার পড়ে গেছি, উঠে দাঁড়িয়েছি
নৌবাহিনীর চুক্তিভিত্তিক অ্যাথলেট রুমকি। দীর্ঘ মেয়াদে বারবার চোটে পড়ায় ক্যারিয়ারটাই শেষ হয়ে যাওয়ার ভয় ছিল। হাসপাতালে ভর্তি হয়েও কখনো ফেডারেশন বা নিজের সংস্থা নৌবাহিনীকে ভয়ে জানাননি এত গুরুতর চোটের কথা। রুমকি বলছিলেন, ‘(অস্ত্রোপচারের পর) উঠে দাঁড়াতে পারব কি না, তা নিয়েও সংশয় ছিল। আমিও ভয় পেয়েছিলাম। যদি নৌবাহিনীকে জানাই তাহলে আমার চুক্তি শেষ হয়ে যেতে পারে। আমার পরিবারকে তখন কে দেখবে? তাই ঝুঁকি নিয়ে অস্ত্রোপচার করেছি। ফেডারেশন বা সংস্থাকে জানালে অবশ্যই সহযোগিতা করত। কিন্তু আমার প্রতি ওদের হয়তো আত্মবিশ্বাস থাকত না। চাইনি আমাকে কেউ দুর্বল ভাবুক। চেয়েছিলাম সুস্থ হয়ে রেকর্ড গড়ে সবাইকে জানাতে। সেটা করে দেখিয়েছি। যতবার পড়ে গেছি, উঠে দাঁড়িয়েছি।’
তুই কি ছেলে না মেয়ে?
সিরাজগঞ্জের আবদুর রহিম-পারুল বেগম দম্পতির পাঁচ সন্তান। পাঁচজনই মেয়ে। বোনদের মধ্যে রুমকি চতুর্থ। অন্যরা খেলাধুলায় আগ্রহী নয়। ব্যতিক্রম রুমকি। স্কুলেই হয়ে ওঠেন অলরাউন্ডার। ক্রিকেট, ফুটবল, অ্যাথলেটিকস, ভলিবল, ব্যাডমিন্টন—সব খেলায় সমান পারদর্শী। সিরাজগঞ্জ নওশের আলী মেমোরিয়াল গার্লস হাইস্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েই সবাইকে চমকে দিতে থাকেন। ২০১২ সালে বরিশালে জাতীয় আন্তস্কুল প্রতিযোগিতায় হাইজাম্প ও বর্শা নিক্ষেপে সোনা জেতেন, ২০০ মিটার স্প্রিন্টে রুপা। সেবার আন্তস্কুলের একক বিভাগে হয়েছিলেন দেশসেরা অ্যাথলেট।
স্কুল ক্রিকেটেও নিয়মিত রুমকি। ছিলেন স্কুল দলের উইকেটকিপার এবং ওপেনার। দুর্ভাগ্য, বিভাগীয় পর্যায়ের ট্রায়ালে বলের আঘাতে দাঁত ভেঙে যায়। ঠোঁটে সেলাই পড়ে কয়েকটা। এরপর ক্রিকেট ছেড়ে দেন। তবে ফুটবলটা ছাড়েননি। তবে সব ছাপিয়ে রুমকির বড় পরিচয় অবশ্য জাতীয় দলের হাইজাম্পার।
খেলোয়াড় হিসেবে নিজেকে তৈরি করতে অনেক সমালোচনা সইতে হয়েছে, ‘স্কুলে খেলাধুলা করার সময় ট্রাউজার, জার্সি পরে মাঠে গেলে ছেলেরা বলত, তুই কি ছেলে না মেয়ে? পড়শিরা বলতেন, ওর মা-বাবার লজ্জা নেই। বিয়ে দেবে কীভাবে মেয়েকে? আমি জাতীয় দলের খেলোয়াড়। অথচ হাসপাতালে আমার ভাঙা পা দেখে লোকে বলত, খেলাধুলা করলে শেষ পরিণতি এমনই হয়। কিন্তু হতাশ হইনি। এগুলো কানে নিলে কখনো উঠে দাঁড়াতে পারতাম না।’
হতাশ হননি বলেই রুমকি আজ খেলায় সেরা। শুধু খেলাতেই? রুমকি বুঝতে পারেন তাঁর পড়াশোনার কথা জানতে চেয়েছি। হাসিমুখে বলেন, ‘আমি এবার যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। পড়াশোনাটাও ভালোভাবে চালিয়ে যেতে চাই।’