রোগীদের জন্য নার্স খোদেজার অক্সিজেন

সখীপুর হাসপাতালের সামনে নার্সিং সুপারভাইজার খোদেজা খাতুন
ছবি: প্রথম আলো

অক্সিজেন স্যাচুরেশন ৮০–তে নেমে যাওয়া করোনায় আক্রান্ত রোগীকে যখন অক্সিজেন কনসেনট্রেটর যন্ত্র ব্যবহার করতে দেওয়া হয়, আর স্যাচুরেশন বেড়ে ৯০-৯২ হয়ে যায়, তখন রোগী স্বস্তি পান। চোখের সামনে রোগীর ভালো লাগা দেখে নার্স খোদেজা খাতুনের মন ভরে যায়। কারণ, গত ১৯ জুলাই এই যন্ত্রটি তিনি হাসপাতালে কিনে দিয়েছেন নিজের টাকায়।

টাঙ্গাইলের সখীপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নার্সিং সুপারভাইজার খোদেজা খাতুন। প্রায় ৩৫ বছর ধরে নার্স পদে চাকরি করছেন। অবসর নেবেন আগামী বছরের ডিসেম্বরে।

খোদেজা বলেন, ‘অক্সিজেনের অভাবে অনেককে মারা যেতে দেখেছি। এসব দেখতে আর ভালো লাগে না।’ তাই বেতনের ৫০ হাজার টাকা দিয়ে সখীপুর উপজেলা স্বাস্থ কমপ্লেক্সের রোগীদের জন্য অক্সিজেন কনসেনট্রেটর যন্ত্র কিনে দিয়েছেন। তিনি বললেন, ‘এ যন্ত্রটি আমার চোখের সামনেই ব্যবহৃত হচ্ছে। এরই মধ্যে আট থেকে দশজন রোগীকে ওই যন্ত্রটি দিয়ে সেবা দেওয়া হয়েছে।’

রোগীদের জন্য অক্সিজেন সরবরাহের যন্ত্র কিনে দেওয়ার পেছনে রয়েছে সেবিকা খোদেজা খাতুনের আছে একান্ত শোকগাথা। তিনি বলে যান সেই বেদনার কথা—দুই বছর আগের কথা। হাসপাতালে ডিউটি করছি। বিকেলবেলা বাড়ি থেকে একটা ফোন এল। আমার মা খুবই অসুস্থ। তাঁকে গাজীপুর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। প্রকৃত খবর হলো ওই সময় আমার মা মারা গেছেন। আমি যাতে খবর শুনে অচেতন না হই, এ জন্য আমাকে সত্যিটা বলা হয়নি।’ একটা গাড়ি ভাড়া করে রাত আটটার মধ্যে গাজীপুরে পৌঁছে যান খোদেজা। গিয়ে শুনলেন তাঁর মা প্রচণ্ড শ্বাসকষ্টে ভুগে মারা গেছেন।

হাসপাতালের জন্য অক্সিজেন কনসেনট্রেটর যন্ত্রটি কিনে দিয়েছেন খোদেজা খাতুন

খোদেজা বলেন, ‘বুঝতে পারলাম, আমার মাকে ওই সময় অক্সিজেন দিতে পারলে হয়তো তিনি বেঁচে যেতেন। অক্সিজেনের অভাবে আমার মায়ের মৃত্যু হয়েছে—এ কথা মনে করে আমি এখনো কাঁদি। মাঝেমধ্যে মাকে স্বপ্নে দেখে কেঁদে উঠি। বিভিন্ন হাসপাতালে চাকরি করে কত রোগীকে যে আমি অক্সিজেনের অভাবে মরতে দেখেছি! আমার মায়ের মতো অক্সিজেনের অভাবে আর কোনো মানুষ যেন মারা না যায়, সেই উপলব্ধি থেকেই এই যন্ত্রটি কিনে দিয়েছি।’

খোদেজা খাতুন নার্স হিসেবে সব সময়ই মনপ্রাণ দিয়ে কাজ করেছেন। সখীপুর হাসপাতালে নিম্নবিত্ত মায়েদের প্রসূতিসেবার জন্য ডিএসএফ (মাতৃস্বাস্থ্য ভাউচার প্রকল্প) নামের একটি প্রকল্প আছে। ওই প্রকল্পের আওতায় কার্ডধারী এক মা প্রসবব্যথা নিয়ে হাসপাতালে এসেছেন। তখন রাত ১২টা। চিকিৎসক জানালেন, এখনই অস্ত্রোপচার না করলে রোগীকে হয়তো বাঁচানো যাবে না। অস্ত্রোপচার কক্ষের দায়িত্বপ্রাপ্ত (ওটি ইনচার্জ) হিসেবে খোদেজা খাতুনকে হাসপাতাল থেকে ফোন করা হলো। খোদেজা শোনান সেই রাতের কাহিনি—ঘুম বাদ দিয়ে হাসপাতালে চলে এলাম। সারা রাত ডিউটি করে ভোরে বাসায় ফিরে পরিবারের সদস্যদের জন্য সকালের নাশতা তৈরি করলাম। একদিকে ঘর সামলানো, অন্যদিকে চাকরি। এভাবে কত যে দায়িত্বের বাইরেও দায়িত্ব পালন করেছি তার কোনো হিসাব নেই।

৫৭ বছর বয়সী খোদেজা খাতুন টাঙ্গাইল জেলার সখীপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নার্সিং সুপারভাইজার পদে এখনো কর্মরত। তাঁর স্বামী ডি আই রেজাউল করিম একজন চিকিৎসক। ২০১৬ সালে তিনি অবসর নিয়েছেন। দুই মেয়ে রিজওয়ানা ফেরদৌস ও রেহনুমা ফেরদৌসও চিকিৎসক। খোদেজা খাতুন ৩৫ বছর ধরে সপরিবার সখীপুর পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। ১৯৯৮ সালে তিনি জেলার ‘সেরা সেবিকা’ সম্মাননা পান। এ ছাড়া ২০০৬ সালে সারা দেশে বেশ কয়েকজন নার্স স্বর্ণপদক পেয়েছিলেন। খোদেজা ছিলে তাঁদের একজন। ডিএসএফ প্রকল্পে প্রসূতি মায়েদের নিরবচ্ছিন্ন সেবা দেওয়ার স্বীকৃতি হিসেবে তিনি এই পুরস্কার পান।

খোদেজা খাতুনের এই অক্সিজেন কনসেনট্রেটর যন্ত্রটিতে কোনো সিলিন্ডার লাগে না। এটি প্রাকৃতিকভাবে বাতাস থেকে অক্সিজেন তৈরি করে রোগীকে সরবরাহ করে বলে জানালেন সখীপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা নাজমুল হাসান মাসুদ খান। তিনি জানান ওই যন্ত্র দিয়ে গত দুই সপ্তাহ ধরে ৮-১০ জন করোনা রোগীকে অক্সিজেন সেবা দেওয়া হচ্ছে। ভবিষ্যতে আরও অনেক রোগীর প্রাণ বাঁচাবে ওই যন্ত্র।

সখীপুরের সাধারণ মানুষের কাছেও প্রিয় খোদেজা খাতুন। উপজেলার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা লাভলী আক্তার (৩৫) ঈদের আগে করোনা পজিটিভ হন। ঈদের আগের দিন লাভলীর শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায়। লাভলীকে ওই দিনই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের করোনা ইউনিটে ভর্তি করা হয়। তাঁর অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে যাচ্ছিল। খোদেজা খাতুনের দেওয়া অক্সিজেন কনসেনট্রেটর লাভলীকে দেওয়া হয়। তাঁর স্যাচুরেশন স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। লাভলী এখন অনেকটাই ভালো। লাভলীর স্বামী জিয়াউর রহমান বলেন, ‘খোদেজা খাতুন প্রতিদিনই একজন সেবিকা হিসেবে আমার স্ত্রীর খোঁজখবর নিয়েছেন। তাঁর দেওয়া যন্ত্রটি আমার স্ত্রীর অনেক কাজে লেগেছে। এটি না থাকলে হয়তো আমাকে টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালে যেতে হতো।’

এমনই তো চেয়েছেন খোদেজা খাতুন। অক্সিজেনের অভাবে রোগীরা যেন শ্বাসকষ্ট না পায়, তাঁর মায়ের মতো যেন মারা না যায়।