‘চিৎকার কর মেয়ে, দেখি কত দূর গলা যায়, আমাদের শুধু মোমবাতি হাতে নীরব থাকার দায়।’ পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এই নীরবতাই নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বাড়ার অন্যতম প্রধান কারণ। আমাদের নীরবতা ভাঙে, আমরা রাস্তায় নামি, আন্দোলন করি ঠিক তখনই, যখন আমরা কিংবা আমাদের অতি আপনজন আক্রান্ত হন। এর আগমুহূর্ত পর্যন্ত আমাদের ঘুম ভাঙে না, আর জেগে থাকলেও আমরা থাকি নীরব!
সম্প্রতি বাসে ঢাকার বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের ছাত্রী ধর্ষণের হুমকি পেয়েছেন, তাঁর মতো কত নারীই হয়তো এমন ধর্ষণের হুমকি পেয়েছেন, কিন্তু লজ্জায় কারও কাছে মুখ খোলেননি। এমনকি মা-বাবার কাছেও না। ভয়, পাছে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়।
কত পুরুষের সামনেই তো চলন্ত বাসে নারীদের সঙ্গে অশোভন আচরণ করে কত চালকের সহকারী কিংবা চালক নিজে, কিন্তু কই প্রতিবাদ তো দেখিনি! দেখেছি কিছু নীরব দর্শক! যারা ভাবে, ওই নারী তো আমার কেউ না। কেন শুধু মিছে-মিছে ঝামেলায় জড়ানো!
শুধু চালকের সহকারী নয়, পুরুষ যাত্রীদের অত্যাচারেও লোকাল বাসে অতিষ্ঠ হয় নারীদের জীবন। নারীদের জন্য আলাদা করে আসন বরাদ্দ থাকলেও বেশির ভাগ সময় দেখা যায় ওই সব আসনে কোনো পুরুষ বসে আছেন। তাই তো অনেক সময় বাধ্য হয়েই নারীদের দাঁড়িয়েই যেতে হয় গন্তব্যস্থলে। অনেক পুরুষ নারীদের পাশের আসনে বসে কিংবা দাঁড়িয়ে বাসের গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাঁদের শরীরের গতি বাড়িয়ে নারীদের শরীর স্পর্শ করেন। বাসের চালকের হালকা ব্রেকেই তাঁরা নেতিয়ে পড়েন নারীর ওপর। আবার বাস থেকে নামার সময় নারীদের শরীরে কনুই দিয়ে ধাক্কা দেন।
লোকাল বাসে চড়ে চট্টগ্রামের নিউমার্কেট থেকে চকবাজারে কোচিংয়ে পড়তে গিয়ে এমন কত সহস্র ঘটনার সাক্ষী আমি তার ইয়ত্তা নেই। কয়েকবার আমি নিজেও এমন পরিস্থিতির শিকার। তাই লোকাল বাস আমার কাছে ‘দুনিয়াতেই জাহান্নাম’।
একদিন কোচিং শেষে সন্ধ্যায় চকবাজার থেকে বাড়ি ফিরছিলাম লোকাল বাসে চড়ে। আমার আসনের পাশে এক পুরুষ দাঁড়িয়েছিলেন। বাস একটু ব্রেক করলেই তিনি আমার শরীরের সঙ্গে বারবার তাঁর শরীরের ধাক্কা লাগাচ্ছেন। আমি চেঁচিয়ে উঠলে তিনি থামেন। ঘটনা এখানেই শেষ। বাসের অন্য যাত্রীরা কেউ কোনো প্রতিবাদ করলেন না। সবাই শুধু ছিলেন নীরব দর্শক! দুই টাকা বাঁচানোর আশায় হুড়োহুড়ি করে বাসে উঠতে-নামতে গিয়ে কত নারী যে কত লজ্জাজনক পরিস্থিতির শিকার হন, তা কারও অজানা নয়।
বেশ কয়েকবার দেখেছি দু-এক টাকা কম ভাড়া দেওয়ায় কত নারীকে হেলপারের কত গঞ্জনা শুনতে। মাঝেমধ্যে কেউ কেউ এগিয়ে আসেন, দু-এক টাকা তাঁদের পকেট থেকে বের করে দেন। তবে নারীর অপমানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে খুব কম পুরুষকেই দেখেছি লোকাল বাসে। উল্টো নারীদের বিপদে তাঁরা মুচকি-মুচকি হাসেন, এই ভেবে যে ‘নারীদের ঘরের বাইরে আসারই কী দরকার! কী হবে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা চাকরি করে? দিন শেষে ঠিকানা তো রসুইঘর।’ এই আমাদের লোকাল বাস আর সমাজের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি!
আর কত নারীর প্রাণ গেলে, আর কত নারী ধর্ষণের হুমকি পেলে, আর কত নারীর পড়াশোনা বন্ধ হলে লোকাল বাসে নিজের আসনে নীরবে বসে থাকা মানুষগুলোর মুখ খুলবে, তাঁদের মা-বোন-স্ত্রীর কথা চিন্তা করে হেনস্তার শিকার মেয়েটির জন্য প্রতিবাদ করবেন?