লোকে এখন জো–কে চেনে

আহসাবুল ইয়ামিন
ছবি: সংগৃহীত

আহসাবুল ইয়ামিনের ছোটবেলার প্রথম স্মৃতি হলো, বাবার সঙ্গে ড্রয়িংরুমে হাত-পা ছড়িয়ে বসে টিভিতে বাংলা সিনেমা দেখা। মা তো আরও এককাঠি সরেস। হলে নতুন কোনো সিনেমা এলেই নাকি বান্ধবীদের নিয়ে (ইয়ামিনের ভাষায় ‘অন্য আন্টিদের নিয়ে’) ছবি দেখতে চলে যেতেন। তাই আহসাবুল ইয়ামিন যে সুযোগ পেলেই স্কুল, কলেজ পালিয়ে রাজশাহীর কল্পনা আর উপহার সিনেমা হলে ঢুকে বসে থাকবেন—এ আর নতুন কী! কিন্তু একসময় নিজেও যে অভিনয় করে নাম করবেন এই তরুণ, কেউ কি ভেবেছিল?

চরকির ওয়েব সিরিজ শাটিকাপ যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই জয়নাল ওরফে জোকে চিনবেন। এই জো–ই আহসাবুল ইয়ামিন। কলেজে পড়ার সময়ই বন্ধু আর বড় ভাইদের নিয়ে একটা স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি বানিয়েছিলেন ইয়ামিন। এরপর নিজেরাই খুলেছেন একটা প্রোডাকশন হাউস: ফুটপ্রিন্ট ফিল্ম। ইচ্ছা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে টেলিভিশন অ্যান্ড ফিল্ম স্টাডিজ বিভাগে পড়বেন। কিন্তু সুযোগ পেলেন না। ব্যর্থ হয়ে ঠিক করলেন, বিদেশে চলে যাবেন। দেশের বাইরে থেকে চলচ্চিত্র নিয়ে পড়ে আসবেন। এর মধ্যে ত্রিশালের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগে ভর্তির সুযোগ হলো। ব্যস, প্রথম বর্ষ থেকেই শুরু হয়ে গেল ছবি বানানোর কাজ।

ছাত্রদের এই উৎসাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও অভিনেতা মনোজ প্রামাণিকের নজর এড়ায়নি। নিজের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান মনপাচিত্র থেকে শিক্ষার্থীদের নিয়ে তিনি ‘সাত দুগুণে চৌদ্দ’ নামে এক প্রকল্প শুরু করেন। এই প্রকল্পের অধীনে তৈরি হয় চৌদ্দটি স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি। এর মধ্যে জসুয়া সূর্যসেন জর্ডান বাসকে ছবির নির্মাতা ছিলেন ইয়ামিন। করোনার বন্ধের মধ্যেই পুরোদমে কাজ করেছেন তাঁরা।

বন্ধ যখন দীর্ঘায়িত হতে থাকল, ইয়ামিন চলে গেলেন রাজশাহীতে। মোহাম্মদ তাওকীর ইসলাম তখন রাজশাহীতে বসেই শাটিকাপ–এর চিত্রনাট্য লিখছিলেন। একে একে শাটিকাপদলে ভিড়ে গেলেন ইয়ামিন, ওমর মাসুম (‘বাবু’ চরিত্রে যিনি অভিনয় করেছেন)–সহ আরও অনেকে।

ইয়ামিন বলেন, ‘মাসুমের একটা বাইক ছিল। সেই বাইকের নাম আমরা দিয়েছিলাম সর্বনাশ।’ এই সর্বনাশের সওয়ারি হয়েই তাওকীর, ইয়ামিন, মাসুমরা রাজশাহী চষে বেড়াতেন। লোকেশন খুঁজতেন। মনের মতো লোকেশন পেলেই নেমে পড়তেন তাঁরা। লোকেশন রেকি শেষ করে, আশপাশটা দেখে সেখানে বসেই সেখানকার দৃশ্য, সংলাপ লেখা হতো। এভাবে ঘোরাঘুরি, গল্প, আড্ডায় এগিয়েছে চিত্রনাট্য।

এরপর এই তিনজনের সঙ্গে যুক্ত হন আরও একজন—খালিদ সাইফ শাওন। তিনি শাটিকাপ–এর ফার্স্ট এডি (প্রধান সহকারী পরিচালক)। এই চারজনের ওপর ভর করেই একটু একটু করে জন্ম নিয়েছে পুরো ওয়েব সিরিজটি। ইয়ামিন বলেন, ‘আমরা যে খুব পরিকল্পনা করে, যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে নেমেছি, তা নয়৷ হুট করে পাওয়া ছুটিতে কারও তেমন কিছু করার ছিল না। ফুটপ্রিন্ট ছিল, লকডাউন ছিল, আমরা ছিলাম, শাটিকাপ হলো। সবাই মিলে কিছু একটা করব, থেমে থাকা সময়টা গতি পাবে, এ জন্যই খেলার ছলে কাজটা করা। ছোট একটা দল নিয়ে ৬২ দিন শুটিং হয়েছে শাটিকাপ–এর। সব মিলিয়ে হেসে–খেলে এক্সপেরিমেন্ট করতে করতে সিরিজটা দাঁড়িয়ে গেছে।’

আহসাবুল ইয়ামিন নিজেই স্বীকার করলেন ‘চিপায় চুপায়’ থাকতে ভালোবাসেন তিনি। শাটিকাপ–এর প্রিমিয়ারের দিনও এক কোণে, অন্ধকারে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন সিরিজটা। সিরিজে অভিনয় করতে গিয়েই চরিত্রের প্রয়োজনে ন্যাড়া হয়েছিলেন। তাই হাততালি দিয়ে, শিস বাজিয়ে ইয়ামিনের অভিনয় উপভোগ করলেও অনেকে বুঝতে পারেননি, তাঁদের পাশেই দাঁড়িয়ে পর্দার জো। অতএব শাটিকাপ–এর জয়নাল যতটা পরিচিত, চিপায় চুপায় থাকা ইয়ামিন ততটা নন। শুধু ক্যাম্পাসে চলতে–ফিরতে অনেকে বলেন, ‘ভাই, আপনেই তো জো, হেব্বি হইছে ভাই। বেশি জোশ।’ ইয়ামিন কিছু বলেন না, ভ্যাবাচেকা খাওয়া হাসি দিয়ে কেটে পড়েন।

মনপাচিত্রের প্রথম প্রোডাকশন ছিল একজন তেলাপোকা৷ সেখানে আহসাবুল ইয়ামিন সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন, আবার অভিনয়ও করেছেন। এই প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের ব্যানারেই দূরযাত্রা নামে আরও একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বানিয়েছেন তিনি। চলছে এই তরুণ পরিচালকের যায় যায় দিন ছবির পোস্টপ্রোডাকশনের কাজ।

সামনের দিনগুলো নিয়ে কী ভাবনা? বললেন, ‘তৃতীয় বর্ষের সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা চলছে। এখানে আবার অভিনয়ের কোর্স আছে৷ আপাতত পরীক্ষায় পাস করতে চাই। আর জীবনে কোনো না কোনো দিন সিনেমা বানাতে চাই৷ চাই আমি যেমন হাত–পা ছড়িয়ে বসে, স্কুল-কলেজ পালিয়ে সিনেমা দেখেছি, অন্যদের জীবনেও আমার সিনেমা ভর করুক। সঙ্গে অভিনয়টাও চলবে৷ তবে এমনভাবে, যেন সবাই আমার চরিত্রটা চেনে, ব্যক্তি আমাকে নয়। তারকা হওয়ার কোনো ইচ্ছা আমার নেই। সিনেমাকে সঙ্গী করে নিত্যনতুন উপলব্ধি নিয়ে নিজের মতো করে একটা জীবন কাটাতে চাই।’