সালিসকারীই যখন অন্যায় করেন

গ্রাফিকস: মনিরুল ইসলাম

প্রেমের টানে বাড়ি ছাড়ে দুই কিশোর-কিশোরী। তাদের আটক করে ডাকা হয় সালিস। সালিসের মাধ্যমে কিশোর-কিশোরীর বাড়ি ছাড়ার ঘটনার সমাধান হবে। কিন্তু সবাইকে অবাক করে মাত্র ১৪ বছর বয়সী সেই কিশোরীকে বিয়ে করেন সালিসকর্তা ইউপি চেয়ারম্যান, যাঁর বয়স কিনা ৬০ বছর। পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার কনকদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. শাহিন হাওলাদারের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ ওঠে গত ২৫ জুন। এই বিয়েতে কনের পরিবার বাধ্য হয়ে রাজি ছিল, কিন্তু স্তব্ধ হয়ে যায় গ্রামবাসী। ৬০ বছরের বিবাহিত ব্যক্তির সঙ্গে ১৪ বছরের কিশোরীর বিয়ে! যাঁর কাছেই প্রতিকারপ্রার্থী হয়ে গিয়েছিল দুই পরিবার। তিনি সঠিক বিচারের বদলে করলেন অন্যায়। রক্ষক যখন ভক্ষক—এই প্রবাদের উৎকৃষ্ট উদাহরণ চেয়ারম্যানের বিয়ের ঘটনাটি।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ গণমাধ্যমে আলোচনা, সচেতন ব্যক্তিদের অভিযোগে স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন-২০০৯-এর ৩৪(৪)(ঘ) ধারার অপরাধ সংঘটিত করায় চেয়ারম্যানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। অন্যায় থেকে রক্ষা পেয়ে কিশোরী খুঁজে পেয়েছে নতুন জীবন।

কিন্তু সব কিশোরী কি এমন নতুন জীবন পায়? বাংলাদেশের আনাচকানাচে এমন ঘটনা খুব বিরল নয়, ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তি কিশোরীকে বিয়ে করে সংসার করছে দিব্যি। কিশোরী বধূ কষ্ট পায়, কিন্তু মুখ ফুটে মনের কথা বলার সাহস নেই তার। এই রকম রক্ষকের হাতে পড়ে নষ্ট হয় অনেক কিশোরী ও নারীর জীবন।

পটুয়াখালীর সেই কিশোরীর পরিবার চেয়ারম্যানের ক্ষমতার প্রভাবের কারণে বিয়েতে রাজি হয়েছিল। কিন্তু অনেক পরিবার তাদের মেয়েকে বিয়ে দিতে রাজিও থাকে না। তখন জোরজবরদস্তি করে তথাকথিত রক্ষকেরা। এখানে সামাজিক সচেতনতা খুব প্রয়োজন। সমাজের মানুষই পারে এমন ঘৃণ্য অপরাধ থেকে একজন নারী কিংবা কিশোরীকে মুক্ত করতে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মিতি সানজানা বলেন, ‘পটুয়াখালীর মেয়েটি শুধু সামাজিক সচেতনতার কারণে নিজের নতুন জীবন খুঁজে পেয়েছে। সমাজের সচেতন মানুষেরা যখন চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে আঙুল তুলেছে, তখন প্রশাসন পদক্ষেপ নিয়েছে। এই যে বিচারপ্রক্রিয়া, এতে ভবিষ্যতে অন্য কোনো ক্ষমতাধর ব্যক্তি একই রকম কাজ করতে গেলে চিন্তা করবেন বা সেই কাজের পরিণতির কথা ভেবে সরে আসবেন।’

সামাজিক সচেতনতার পাশাপাশি গ্রামে-গঞ্জে নিয়মিত হওয়া বাল্যবিবাহের শাস্তির কথা আইনজীবী মিতি সানজানা জানান, বাংলাদেশ সরকার বাল্যবিবাহ রোধ করার জন্য নানা উদ্যোগ নিয়েছে। বাল্যবিবাহের ২০০৭ সালের যে আইন, তাতে যে কেউ এই আইনের বিচার পেতে পারেন। ২০০৯ সালে করা হয় ভ্রাম্যমাণ বিচারপ্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় গ্রামের মানুষ খুব সহজেই আইনের আশ্রয়ে আসতে পারেন। অনেক সময় দেখা যায়, ক্ষমতাশালী ব্যক্তিটি কিশোরীর বয়স বাড়িয়ে দেন, যাতে বিয়ে আর বাল্যবিবাহ না থাকে। যদি এমন দেখা যায়, তাহলে নিপীড়িত মানুষ জালিয়াতির মামলা করতে পারবেন যে অন্যায় করে, প্রভাব খাটিয়ে বয়স বাড়ানো হয়েছে।

বাল্যবিবাহ বন্ধে সরকারি কর্মকর্তা এবং স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিদের সাধারণ ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি কোনো ব্যক্তির লিখিত বা মৌখিক আবেদন অথবা অন্য কোনো মাধ্যমে বাল্যবিবাহের সংবাদ পেলে ওই বিয়ে বন্ধ করবেন। অথবা নির্ধারিত পদ্ধতিতে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবেন।

আইন আছে। আইন তার নিজস্ব গতিতে বিচারের দিকেই অগ্রসর হয়। কিন্তু কীভাবে সেই আইনের আশ্রয়ে এই ভক্ষকদের উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া যায়, তার সঠিক উদাহরণ পটুয়াখালীর এই চেয়ারম্যানের বিচার। সামাজিক সচেতনতায় মানুষ যখন অভিযোগ করেন যে চেয়ারম্যান ক্ষমতার অপব্যবহার করে এই কাজটি করেছেন, তখন স্থানীয় সরকারের উদ্যোগে চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থা নেওয়া হলো, অনুরূপ ব্যবস্থায় শাস্তির আওতাধীন হবেন সব ভক্ষকই। তাই আপনার এলাকায় এমন অন্যায় ঘটলে প্রতিবাদী হয়ে উঠতে হবে সবাইকে। যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে সংবাদটি পৌঁছে দিলে স্থানীয় সরকারের পদক্ষেপ গ্রহণ করাটা সহজ হবে। এমন অপরাধ বিচারপ্রক্রিয়ায় থাকলে ভক্ষকেরা আর দানব হয়ে উঠতে পারবে না।