হতে চেয়েছিলাম পাইলট, কিন্তু বিয়ে হয়ে গেল

‘হতে চেয়েছিলাম পাইলট, কিছুই হলো না। বিয়ে হয়ে গেল।’, লেখাটি পাওয়া যায় বিদ্যালয় ছেড়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসা এক শিক্ষার্থীর ফেলে যাওয়া খাতায়। বড় বোনের বাতিল সেই খাতায় বেশির ভাগ পাতা ছিল সাদা। তাই নিয়ে বিদ্যালয়ে এসেছিল ছোট ভাই। বিষয়টি একজন শিক্ষকের চোখে পড়ে। তিনি তা প্রধান শিক্ষকের কাছে নিয়ে যান। তাঁরা সবাই দেখে চমকে ওঠেন, বিদ্যালয়ের একজন মধ্যম সারির শিক্ষার্থীও এমন করে ভাবতে পারে!

শিশুরা যখন স্বপ্ন দেখতে শুরু করে, সে সময়ই অনেক মেয়েশিশুকে সেই স্বপ্ন ফেলে শ্বশুরবাড়ি চলে যেতে হয়। শুধু শিশু নয়, অনেক কিশোরী ও তরুণীকেও তাদের শৈশরেব লালিত স্বপ্নের কথা ভুলে যেতে হয়। হয়তো তারা শ্বশুরবাড়ি গিয়ে আবার নতুন কোনো স্বপ্নে জড়িয়ে পড়ে।

বিয়ের পিঁড়িতে বসা রাজশাহীর এক শিক্ষার্থী তাঁর খাতায় নিজের স্বপ্নভঙ্গের কথা লিখেছিলেন

নিজের খাতায় স্বপ্নের কথা লিখে শ্বশুরবাড়ি চলে যাওয়া শিক্ষার্থীর বাড়ি রাজশাহীর বাঘা উপজেলায়। তিনি বাঘার নওটিকা-আরিপপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। সেখান থেকে পাস করে পাশের একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। নবম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় তাঁর বিয়ে হয়ে যায়। তাঁর খাতাটি নিয়ে ছোট ভাই নওটিকা-আরিপপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়তে এসেছিলেন। এই বিদ্যালয়ে সাবেক শিক্ষিকা দুলারী খাতুনের কাছে খাতাটি পাওয়া যায়। তিনিই আগ্রহভরে খাতা নিয়ে প্রধান শিক্ষককে দেখিয়েছিলেন। কৌতূহলবশত তিনি খাতাটি নিজের কাছে রেখে দিয়েছিলেন।

ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কবিরুজ্জামান জানান, ওই মেয়েটি এত বড় স্বপ্ন দেখতে পারে, এটা তাঁর কিছুতেই বিশ্বাস হয়নি। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েটি ছাত্রী হিসেবে ছিল মধ্যম সারির। এই পর্যায়ে থেকে কীভাবে এত দূর চিন্তা করতে পারে—এটা কবিরুজ্জামান ভাবতে পারেননি। তিনি বলেন, ‘আবার এমনটিও হতে পারে, শিশুদের মনোজগৎ সম্পর্কে আমাদের ধারণা যথেষ্ট নয়।’

দুলারী খাতুন জানান, গ্রামের অধিকাংশ মেয়েই বাল্যবিবাহের শিকার হয়। বিয়ের ব্যাপারে কম মেয়েই আপত্তি করে। এই মেয়েটি আপত্তি করেছিল কি না, তা জানা যায়নি। তবে লিখে রাখা ভাবনাটি চমকে ওঠার মতো। তাই তিনি খাতাটি রেখে দিয়েছিলেন। মনে হয়েছিল এটা একটা দৃষ্টান্ত। একধরনের প্রতিবাদ।

মেয়েটির বিয়ে হয়েছে রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার একটি গ্রামে। গত ৪ জুন রাতে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, তাঁর দুই ছেলে হয়েছে, এই দুই ছেলেকে ঘিরেই এখন তাঁর সব স্বপ্ন। বড় ছেলের বয়স আট বছর। তাঁকে তিনজন প্রাইভেট টিচার দিয়েছেন। আবার নিজেও বাড়িতে পড়াটা দেখিয়ে দেন। শ্বশুর-শাশুড়ি খুবই ভালো মানুষ। তিনি ভালো আছেন। গত ১০ বছরে তিনি খাতায় লিখে আসা স্বপ্নের কথা ভুলে গেছেন।

অনেক তরুণী আবার শৈশবের হারানোর স্বপ্ন নিয়েও ভাবেন। শ্বশুরবাড়ি এসে ভালো থাকলেও সেই স্বপ্ন তাঁকে পীড়া দেয়। নওগাঁর আত্রাই উপজেলার এক তরুণীর স্বপ্ন ছিল ব্যারিস্টারি পড়ার। অভিনয় ও নাচ শেখার ইচ্ছেও ছিল। বাবার আর্থিক অবস্থা ভালো। বাবা ভালো মনের মানুষও। এ জন্য তাঁর আশা ছিল, স্বপ্ন পূরণ হবে। কিন্তু উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার পরই বিয়ের একটা ভালো প্রস্তাব আসে। ছেলে সরকারি কর্মকর্তা। কোনো কথা না বলে তাঁকে বিয়ে দেওয়া হলো। তখন বলা হয়েছিল শ্বশুরবাড়ি থেকে পড়াশোনার ব্যাপারে কোনো আপত্তি করা হবে না।

মেয়েটি বাবাকে বলেছিল, ‘বিয়ের পরেও পড়াশোনা করব। ব্যারিস্টারি পড়ার খরচটা তুমি দিবে।’ বাবাও আপত্তি করেননি। ২০১৩ সালে বিয়ে হলো। পরের বছরই সন্তান হলো। এরপর পড়াশোনার বিষয়টি যেন ঐচ্ছিক হয়ে গেল। তবু তিনি পড়াশোনা করতে চান। তাতে শ্বশুরবাড়ির কারও আপত্তি নেই। আবার উৎসাহও নেই। এই অবস্থায় অগত্যা তিনি বাংলায় স্নাতক পড়লেন। এখন স্নাতকোত্তর শেষ পর্যায়ে। এ নিয়ে তাঁর মনে কোনো দুঃখ নেই। ছয় বছর বয়সী মেয়েটিকে ঘিরেই এখন তাঁর সব স্বপ্ন দেখা। যার গল্প বলছি, তিনি এখন রাজশাহী শহরে থাকেন। কথায় কথায় বলেন, ‘কখনো মনে হয় চাকরি করি, তাতে স্বামীর কোনো আপত্তি নেই। তবে বাচ্চার দিকেই নজর দেওয়া বেশি জরুরি কি না ভেবে দেখতেও বলেন।’

স্কুলে অভিনয় করে পুরস্কার পেয়েছিলেন তিনি। সেটাও তাঁকে খুব টানে। টানলেও সেটা সম্ভব নয়, তিনি জানেন। কাউকে না বলে নাচটা শিখেছিলেন। বাবা বলেছিলেন, ‘শিখেছ ভালো কথা, কিন্তু বাড়িতে করো, কোনো মঞ্চে না।’ সম্প্রতি একটি কবিতার সঙ্গে ‘সিনেমাটোগ্রাফি’ করে ফেসবুকে দিয়েছিলেন। এ ব্যাপারে তাঁর স্বামীর কোনো আপত্তি নেই। তবে শ্বশুরবাড়ির এক আত্মীয়া যারপরনাই নিন্দা করেছেন। অভিযোগ শ্বশুরের কান পর্যন্ত তোলা হয়েছে। শ্বশুর দেখে বলেছেন, ‘খুব একটা ভালো হয়নি। আরেকটু ভালোমতো করে ছেড়ে দিয়ো।’ তবে শাশুড়ি বলেছেন, ‘না, থাক।’