হার্ডডিস্ক থেকে মনের অদলবদল
শফিউল আলম খানের সকালের ঘুমটা আচমকা এক ফোনকলে ভেঙে যায়। ফোনটা হাতে তুলে নিতেই আবারও পান কল। ধরতেই অপর প্রান্ত থেকে প্রশ্ন, ‘হ্যালো, ইফতি সাহেব বলছেন? আপনার হার্ডডিস্কটা নিতে চাই, জিনিসটা ভালো তো?’
২০০৮ সালের কথা। সাতসকালে ক্রমাগত ফোনকলের কারণ বুঝতে শফিউল আলম খানের অসুবিধা হয় না। প্রথম আলোয় ‘ইফতি’ নামে যে চিঠি পাঠিয়েছিলেন, সম্ভবত সেটাই ছাপা হয়েছে। তিনি তাড়াহুড়ো করে বাড়ির পাশের বাজারে যান। সেদিনের একটি প্রথম আলো সংগ্রহ করেন। যা ভেবেছিলেন, তা-ই ঠিক, প্রজন্ম ডটকম পাতায় অদলবদল বিভাগে তাঁর পাঠানো চিঠিটি ছাপা হয়েছে। তাঁর নাম–ঠিকানা আর ফোন নম্বরের আগে লেখা হয়েছে—হার্ডডিস্কের বদলে, একটি পেনড্রাইভ চাই।
দিনভর অসংখ্য ফোনকল পেলেন। খানিকটা বিরক্তই বোধ হচ্ছিল, কিন্তু কী করবেন, নম্বর যখন ছাপা হয়েছে, কথা তো বলতেই হবে। এমন করেই একটি কল এসেছিল বিকেলের দিকে। ফোনের অপর প্রান্তে নারী কণ্ঠ ভেসে আসে। পরিচয় দিয়ে জানালেন, ‘আমি অ্যানি, ঢাকা থেকে বলছি। হার্ডডিস্কটি আমার প্রয়োজন। পেনড্রাইভ দিয়ে আপনার হার্ডডিস্ক নিতে চাই।’
ইফতিও কথা বলে বুঝলেন, অ্যানি নামের মেয়েটি সত্যিই বদল করতে চান। বিষয়টি নিয়ে আরও একবার কথা বললেন। এবারের প্রসঙ্গ, একজন আরকজনের কাছে হার্ডডিস্ক আর পেনড্রাইভ কীভাবে পৌঁছাবেন, সেই বিষয়ে।
দুজনই ভাবলেন কুরিয়ার করে পাঠাবেন। আবার সন্দেহ দানা বাঁধল, যদি ফেরত না পান! ইফতি ভাবলেন, ঢাকায় তো প্রায়ই যাওয়া হয়, বরং দেখা করে অদলবদল করে নেবেন। এভাবেই কিছুদিন যোগাযোগ থাকল দুজনের। সিদ্ধান্ত নিলেন, শিগগিরই দেখা করবেন।
সাক্ষাৎ করার দিন-তারিখ ঠিক হলো। ইফতি ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ঢাকার পথে রওনা দিলেন। সারাটা পথে সাতপাঁচ ভাবতে থাকলেন। অচেনা এক মেয়ের সঙ্গে প্রথম দেখা, সে যে উদ্দেশ্যেই হোক, অনুভূতিটা অন্য রকম। সম্বোধনটা করবেন কী বলে।
কমলাপুর রেলস্টেশনে নেমে এসবই ভাবতে ভাবতে ইফতি চলে আসেন ধানমন্ডি। অপেক্ষা করেন অ্যানির জন্য। ঠিক সময়ই হাজির হন অ্যানি। নিজেদের মধ্য কুশল বিনিময়। এক ফাঁকে ইফতি বলেন, ‘আমার ভালো নাম শফিউল আলম খান।’
অ্যানিও হেসে উঠে বলেন, ‘আমার নামও অ্যানি নয়, সানজিদা খানম।’
এবার দুজনই হো হো করে হেসে ওঠেন। আরও এক কথা দুই কথায়, নিজেদের অনেক কথাই বলা হয়ে যায়। দুজনের বন্ধুত্বটা আরও পাকাপোক্ত হতে সময় লাগেনি নিজেদের সম্পর্কে জেনে। ইফতি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এ. মোনেম কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র। অ্যানিও একই ক্লাসে পড়েন রাজধানীর জরিনা সিকদার বালিকা উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজে।
ততক্ষণে হার্ডডিস্ক আর পেনড্রাইভ অদলবদল করে নিয়েছেন। সেই সঙ্গে দুজনের মনও।
বাড়ি ফিরে দুজনের কথা চলতে থাকে। এবার আর অদলবদলের কথা নয়। নিজেদের যৌথ স্বপ্ন বোনার গল্প। সেই গল্প চলে পরবর্তী দুই বছর।
২০১০ সাল সেটা। তত দিনে দুজনই বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া। দুম করে একদিন অ্যানি জানালেন, পরিবার থেকে তাঁর বিয়ের জন্য পত্র ঠিক করেছে, বিয়ে দিয়ে দেবে। এখন কী করা? এ যেন ইফতির কাছে নীরব প্রস্তাব। ইফতিও বলে দেন, তিনি বিয়ে করবেন। একদিন এক প্রহরে তাঁরা বিয়ে করলেন। বাড়িছাড়া হলেন দুজন। ইফতি তখন ফ্রিল্যান্সিং করেন। টোনাটুনির সংসার চলতে থাকল বেশ ভালোই।
বছর দুয়েক পর পরিবার মেনে নিল তাঁদের সম্পর্ক। আরও ছয় বছর পর তাঁদের ঘরে এল আরিশ। এই ছেলেকে নিয়েই এখন তাঁদের স্বপ্ন দেখা। স্বপ্ন চরানো এই জীবনে দুজনই তাঁদের প্রথম পরিচয়ের নামেই ডাকেন।
শফিউল আলম খান যেন জীবনগল্প বলতে বলতে ডুবে গিয়েছিলেন। মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন, ‘খুব সুখেই আছি আমরা।’
এই সত্য গল্পের মুখোমুখি হয়েছিলাম ১৬ নভেম্বর। বগুড়ায় এক তথ্যপ্রযুক্তি পেশাজীবীদের সম্মেলনে গিয়ে। প্রথম আলোর একজন কর্মী পেয়ে আবেগ আর খুশির মিশেলে নিজের ভালো লাগার গল্প শোনালেন শফিউল আলম খান। তিনি এখন ম্যাক্সজিওন আইটি নামের একটি তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। আয়োজক হিসেবে এসেছিলেন অনুষ্ঠানে।
আরও অনেক কথার পর জানালেন, সানজিদা ধানমন্ডির একটি স্কুলে শিক্ষকতা করত। এখন সেটা ছেড়ে ছেলেকে সময় দেয়।
কৃতজ্ঞতা জানাতে ভুললেন না প্রথম আলোকে, অদলবদল নামের বিভাগটি যে ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হয়েছিল, সেই প্রজন্ম ডটকমকে। শফিকুলের ভাষায়, ‘আমার জীবনটিই বদলে দিয়েছে অদলবদলের সেই চিঠিটি। আমি বন্ধুর মতো একজন স্ত্রী খুঁজে পেয়েছি। প্রথম আলোর প্রজন্ম ডটকমকে অনেক ধন্যবাদ।’