রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার মানুষের মুখে মুখে শোনা যায় মতি মিয়ার নাম। তাঁর এই পরিচিতির কারণ, তাঁর পেশাগত কাজ। সে কাজ মৃতদেহ বহনের। বাগমারা থানা থেকে যেসব মৃতদেহ ময়নাতদন্তের জন্য রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়, মতি মিয়া ভ্যানগাড়িতে সেসব মৃতদেহ বয়ে নিয়ে যেতেন। হাসপাতাল থেকে পৌঁছে দিতেন মৃতের ঠিকানায়। কাজটি তিনি টানা ৩০ বছর ধরে করেছেন।
২ অক্টোবর গিয়েছিলাম মতি মিয়ার সঙ্গে দেখা করতে। বাগমারা থানার মোড়ের একখণ্ড জমিতে কুঁড়েঘর তাঁর। বাড়িতে যাওয়ার আগেই তাঁর চায়ের দোকান। ২০১৮ সালে মৃতদেহ বহনের কাজ ছাড়ার পর দোকানটি দিয়েছেন। স্নাতকপড়ুয়া ছেলে তাঁর কাজে সহায়তা করেন। চায়ে চুমুক দিতে দিতেই আলাপ শুরু হয় মতি মিয়ার সঙ্গে।
৬৩ বছর বয়সী মতি মিয়ার বাড়ি রংপুরে। রাজশাহী শহরে এসেছিলেন রিকশা চালাতে। বাগমারার জোবেদা খাতুনের সঙ্গে বিয়ে হয় একসময়। মতি মিয়া চলে আসেন বাগমারায়। তাঁর শ্বশুর ফয়েজ উদ্দিনের কাজ ছিল মৃতদেহ বহনের। ১৯৮৮ সালে শ্বশুরের সে কাজ শুরু করেন মতি মিয়া। তারপর টানা ৩০ বছর ভ্যানগাড়িতে বহন করেছেন মৃতদেহ। ২০২০ সাল থেকে রাজশাহী পুলিশ সুপারের উদ্যোগে মৃতদেহ বহনের উদ্যোগ শুরু হয়েছে।
মতি মিয়ার সঙ্গে কথা বলতে বলতেই তাঁর বাড়ির সামনে যাই। এক কোণে চোখে পড়ে একটি ভ্যানগাড়ি। বলা ভালো, ভ্যানগাড়ির কাঠামো। ভ্যানগাড়ির কাঠের পাটাতনটুকু নেই, লোহার কাঠামোতেও পড়েছে মরিচা। ভাঙাচোরা ভ্যানগাড়ির নিচের অংশে এখনো শক্ত করে বাঁধা আছে একটি ভাঙা হারিকেন। কত অন্ধকার রাতই না এই হারিকেন মতি মিয়াকে পথ চিনিয়েছে।
এই গাড়ির সঙ্গেই জড়িয়ে মতি মিয়ার ৩০ বছরের স্মৃতি। গাড়িটি ছিল তাঁর জীবিকার মাধ্যম। তাই তো এখনো রেখে দিয়েছেন স্মৃতি হিসেবে। মতি মিয়া বলেন, ‘কাজ ছেড়ে দিয়েছি তিন বছর হলো। লাশের সঙ্গে কত রাত যে কাটাতে হয়েছে, সব মনে পড়ে। এখনো নাকে লাশের গন্ধ পাই।’ তিনি জানান, প্রায় দুই হাজার মৃতদেহ বহন করেছেন এই ভ্যানগাড়িতে।
মৃতের সংখ্যার হিসাব বলেই মতি মিয়া যোগ করেন, ‘বাগমারা এক সময় সন্ত্রাসী জনপদ হিসেবে পরিচিত পেয়েছিল। এখানে প্রায়ই খুনখারাপির ঘটনা ঘটত। আত্মহত্যা ছাড়াও অপমৃত্যুর ঘটনা ছিল প্রচুর। এসব লাশের ময়নাতদন্তের জন্য রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ফরেনসিক বিভাগে নিয়ে যেতে হতো আমাকে।’
মতি মিয়ার অনেক রাত কেটেছে তাঁর মৃতদেহের পাশে। যখন হাসপাতালে পৌঁছাতে দেরি হতো, সম্ভব হতো না ময়নাতদন্তের, নিরুপায় মতি মিয়া লাশের পাশে রাত কাটিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘শুরুর দিকে ভয় পেলেও পরে সে ভয় ভেঙে যায়।’
মৃতদেহ বহনের কাজটি শুধু পেশা হিসেবে নয়, মতি মিয়া এর মাধ্যমে সেবাও করেছেন। অনেক সময় বিনা পয়সায় মৃতদেহ বহন করে মর্গে নিয়ে গেছেন, পৌঁছে দিয়েছেন বাড়িতে। দরিদ্র আর পরিচিতদের মৃতদেহ বহনের অর্থ নিতেন না। এমন অনেক উদাহরণ পাওয়া যায়, মতি মিয়াকে যাঁরা কাছ থেকে দেখেছেন তাঁদের মুখে। বাগমারা থানায় দুবার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করা র্যাবের অবসরপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার মির্জা গোলাম সারোয়ার তাঁর সম্পর্কে বলছিলেন, ‘মতি মিয়া ছিলেন বলেই ময়নাতদন্তের জন্য ফরেনসিক বিভাগে লাশ পাঠাতে কোনো চিন্তা করতে হতো না। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি বা লাশের অভিভাবকেরা যা দিতেন, তা-ই নিতেন। অনেক সময় বেওয়ারিশ ও দরিদ্র মানুষের মৃতদেহ বহনের জন্য কোনো টাকা নিতেন না।’