সুস্থ হয়ে ওঠা করোনা রোগীর বাসা থেকে অক্সিজেন সিলিন্ডার আনতে গিয়েছিলেন স্বেচ্ছাসেবী রেজাউল করিম। ১৩ জুলাই সিলিন্ডারটি নিয়ে ফেরার পথেই ফোনকল পান তিনি। এক প্রসূতি মায়ের জন্য জরুরি রক্তের প্রয়োজন। রেজাউল করিম সিলিন্ডার নিয়েই ছুটে যান হাসপাতালে। রক্তের গ্রুপের মিল ছিল বলে তিনি নিজেই দান করেন রক্ত। এরপর সিলিন্ডার নিয়ে ছুটে যান শ্বাসকষ্টে ভোগা আরেক করোনা রোগীর বাসায়।
রেজাউল করিমের বাড়ি শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলায়। তিনি ‘সংযোগ: কানেকটিং পিপল’ নামে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্য। করোনাকালে গড়ে উঠেছে এই ফেসবুকভিত্তিক সংগঠন। রেজাউল করিমের মতো অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংযোগের হয়ে কাজ করছেন দেশের ৩৭ জেলায়। এসব জেলায় আছে সংযোগের ‘অক্সিজেন হাব’। করোনা রোগীদের সেবা দিতে এসব হাবে রয়েছে ছয় শতাধিক অক্সিজেন সিলিন্ডার। এসব হাব বা কেন্দ্রে শুধু অক্সিজেন সিলিন্ডার সরবরাহের জন্যই কাজ করছেন পাঁচ থেকে ছয় জন করে স্বেচ্ছাসেবী, যাঁরা সিলিন্ডার স্থাপন ও রোগীকে সঠিক মাত্রায় অক্সিজেন দেন। এ ছাড়া সংযোগের অন্য কর্মসূচিতে যুক্ত আছেন আরও কিছু স্বেচ্ছাসেবী।
যেমনটি আগেই বলেছি, সংযোগের যাত্রা গত বছরের মার্চে করোনা বিস্তারের শুরুতে। সে সময় পাঁচ হাজার মেডিকেল গাউন তারা বিলিয়ে দেয় দেশের ১০০টি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে। এরপর একে একে যুক্ত হয় নানা উদ্যোগ।
শুরুর সময়কার কথা বলেন সংযোগের প্রতিষ্ঠাতা আহমেদ জাভেদ, ‘তখন চারদিকে স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রীর সংকট। দরিদ্র মানুষের ঘরে খাবার নেই। এমন পরিস্থিতিতে ফেসবুকে একটি গ্রুপ খুলি। নাম দিই সংযোগ। প্রথমে স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা দিতে কাজ শুরু করেছিলাম আমরা।’ জাভেদের এই ‘আমরা’র মধ্যে রয়েছেন অনেকেই। তাঁদের মধ্যে পেশায় কেউ শিক্ষক, কেউবা প্রকৌশলী, আছেন সাংবাদিক, চিকিৎসক, নবীন নগর পরিকল্পনাবিদসহ নানা পেশার মানুষ। তাঁরাই সংযোগের বিভিন্ন কর্মসূচি ও দায়িত্ব সামাল দেন।
২০২০ সালের মার্চে যাত্রা শুরুর পর প্রথম তিন মাস স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই কাজ করছিল সংযোগ। কিন্তু করোনা তত দিনে পথে বসিয়েছে অনেক নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষকে। বিশেষ করে এমপিওভুক্ত নয়, এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের। গত বছরের পবিত্র ঈদুল ফিতরের সময়টায় তাঁদের পাশে দাঁড়ায় সংযোগ। সারা দেশে এক হাজার শিক্ষককে তিন হাজার করে টাকা দেওয়া হয় সংযোগের পক্ষ থেকে। ঈদুল আজহায়ও এক হাজার শিক্ষককে সমপরিমাণ অর্থসহায়তা দেওয়া হয়।
রক্ত, প্লাজমা আর অক্সিজেন সরবরাহ
গত বছরের জুনের দিকে যখন করোনা পরিস্থিতির অবনতি হলো, সে সময় সংযোগের স্বেচ্ছাসেবীরা নেমে পড়লেন রক্ত আর প্লাজমা সংগ্রহ করতে। আহমেদ জাভেদ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রক্ত দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেকের চেয়ে এগিয়ে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা বাড়ি চলে গিয়েছিলেন। ফলে রক্তের ব্যবস্থা করতে হিমশিম খাচ্ছিলেন সাধারণ মানুষ। তাই সংযোগের পক্ষ থেকে একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হয় রক্ত ও প্লাজমার ব্যবস্থা করার জন্য। তিনি জানান, এ সময় যাঁরা করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন, তাঁদের যেমন খোঁজ রাখা হচ্ছিল, তেমনি তাঁরা সুস্থ হওয়ার পর যাতে প্লাজমা দেন, সে জন্যও উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছিল।
রোগীর জন্য রক্ত সংগ্রহে এখন একটি টিম দাঁড় করিয়েছে সংযোগ। ২৪ ঘণ্টা এই দল কাজ করে থাকে। সংযোগের গ্রুপে বিভিন্ন সময় পোস্ট দেওয়া, রক্তদাতাদের ফোন করে যাবতীয় বিষয়-আশয় নিশ্চিত করতে ২০ জনের একটি দল কাজ করে থাকে ২৪ ঘণ্টা।
ঢাকায় অক্সিজেন হাবগুলো নিয়ে সার্বক্ষণিক কাজ করেন ইমতিয়াজ আহমেদ। তিনি বলেন, ‘গত বছরের মাঝামাঝি যখন অক্সিজেন সিলিন্ডারের সংকট দেখা দেয়, তখন আমাদের কার্যক্রম শুরু হয়। সে সময় ছয় থেকে আট হাজার টাকার সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছিল ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকায়। এ সময় আমরা অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম, ঢাকার অনেকেই অক্সিজেন সিলিন্ডার কিনে রেখে দিয়েছেন ভবিষ্যৎ সংকট মোকাবিলায়। আমরা তখন নতুন প্রচারণা শুরু করলাম। অনেককে বোঝাতে সক্ষম হলাম, আপনার সিলিন্ডার প্রয়োজনের সময় আপনি পাবেন। কিন্তু এই মুহূর্তে যাঁরা শ্বাসকষ্টে ভুগছেন, যাঁদের এখনই অক্সিজেন প্রয়োজন, তাঁদের সিলিন্ডারটি ব্যবহার করতে দিন। এই উদ্যোগে সাড়া মেলে।’
একই সময় চট্টগ্রামেও ১৫টি সিলিন্ডার নিয়ে সংযোগের অক্সিজেনসেবা কার্যক্রম শুরু হয়। সেই কার্যক্রম এখন ৩৭ জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে। অক্সিজেনসেবা পেতে যোগাযোগ করতে হবে সংযোগের (০১৭১১৯৩০৯৩৫, ০১৭১৭৯০২১৬৩, ০১৮১৯২১০৩৪৪ ও ০১৮১৭০৪৯৯৯২) নির্দিষ্ট নম্বরে।
এই সেবার জন্য কি অর্থ নেওয়া হয়? প্রশ্ন শুনে ইমতিয়াজ বলেন, ‘এটা নির্ভর করে রোগীর সামর্থ্যের ওপর। অনেক রোগীকে বিনা মূল্যে দেওয়া হয়। কেউ চাইলে অর্থ দিতে পারেন। তবে আমরা তিন হাজার টাকার বেশি নিই না। কারণ, এই অর্থ হলেই সিলিন্ডারসংক্রান্ত খরচ উঠে যায়। এরপরও কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমাদের বেশি অর্থ ব্যয় হয়।’
সেই অর্থ ইমতিয়াজেরা পান শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাজে। জাভেদ জানালেন, দেশ ও দেশের বাইরে থেকে অনেকেই সংযোগের জন্য অর্থ দিয়ে থাকেন। আর এই অর্থ সামাল দেওয়ার জন্য কাজ করে থাকেন চার-পাঁচজন স্বেচ্ছাসেবী, যাঁরা নিয়মিত এ–সংক্রান্ত আপডেট সংযোগের গ্রুপে পোস্ট করে থাকেন। এ গ্রুপের সদস্যসংখ্যা এখন ৭৬ হাজারের বেশি।
মানুষে মানুষে সংযোগ
স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা দিতে কাজ শুরু করেছিল সংযোগ। কিন্তু সেই সংযোগ এখন করোনা রোগীদের পাশে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। করোনাকালে মানুষকে স্বাবলম্বী করতেও কাজ করে যাচ্ছে সংযোগ। এ জন্য সারা দেশে রয়েছে ৫০ জনের একটি দল। তাঁরা বিভিন্ন এলাকায় দুস্থ মানুষদের তথ্য সরবরাহ করেন। এসব দুস্থ মানুষের মধ্যে কাউকে দোকান দিয়ে দেওয়া হচ্ছে, কাউকে কিনে দেওয়া হচ্ছে লালন–পালনের জন্য গরু-ছাগল। কোনো নারী হয়তো পাচ্ছেন সেলাই মেশিন।
সংযোগের সব উদ্যোগ মানুষের জন্য। তারা মানুষের জন্য কাজ করছে। আহমেদ জাভেদ বলেন, ‘মানুষ কষ্টে আছে। সংযোগের মাধ্যমে এসব মানুষের পাশে যাঁরা দাঁড়াচ্ছেন, তাঁদের প্রতিও আমরা কৃতজ্ঞ।’