নিছক প্রদর্শনী নয়, সময়ের সঙ্গে সময়ের কথোপকথন

ঘরের এক পাশে অতিথি, সাংবাদিক আর আয়োজকদের মিলনমেলার জন্য অপেক্ষা করছে চেয়ার, টেবিল, মাইক্রোফোন। ‘মিট দ্য প্রেস’ শুরু হয়েছে আরও এক ঘণ্টা পর। সামনে এগোতেই পায়ে এসে ঠেকল ঝরা পাতা। বাঁশপাতা, কাঁঠালপাতা, জয়ফল আর আমপাতারা যেন খানিক বিরতি দিয়ে জায়গায় জায়গায় জড়ো হয়ে শীতের বিকেলের মিষ্টি রোদ পোহাচ্ছে। সেখানেই ঝুলছে নানান ধরনের শীতের পোশাক। কাঁথা ফোঁড়ের ব্লেজার, পকেটওয়ালা পঞ্চ, কোট, কোটি আরও কত কী! এসবই যশোরের পাঁচটা গ্রামের মানুষদের হাতে তৈরি।

হাতে তৈরি কাঁথা ফোঁড়ের শীতের কাপড়ের প্রদর্শনী দেখছেন এক দর্শক
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

দেখা হয়ে গেল ফ্যাশন ব্র্যান্ড কিউরিয়াসের শীতের এই কালেকশনের প্রধান ডিজাইনার চন্দ্র শেখর সাহার সঙ্গে। চোখাচোখি হতেই হেডমাস্টারের মতো জিজ্ঞেস করলেন, ‘বলুন তো, পোশাকগুলোর উপস্থাপনায় ঝরা পাতা কেন?’ আকাশ-পাতাল হাতড়ে কিছু একটা বলার সুযোগ দিলেন না। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নিজেই দিলেন নিজের প্রশ্নের উত্তর, ‘কারণ, এখন শীতকাল। আর প্রদর্শনীটা শীতের পোশাকের। আমরা তাই সমস্ত আয়োজনের ভেতর শীতের আমেজটা ধরে রাখতে চেয়েছি।’ বললাম, তাহলে ঘরে, বাইরে, দিনে রাতে, শীতকালটা জুড়ে গায়ে কেবল কাঁথা জড়িয়ে রাখব? মন্তব্য শুনে হো হো করে হেসে উঠলেন।

পোশাকের পর্ব পেরিয়ে ওপাশটা জুড়ে নানা গয়না। গয়নাগুলো রাখা হয়েছে বাঁশের তৈরি বিশেষ দোলনার ওপর। বাঁশগুলো আড়াআড়ি করে ঝুলছে সুতোর ওপর ভর করে। যেন গয়নাগুলোর সাধ জেগেছে ঝুলে ঝুলে দোল খাওয়ার। সেই গয়নার উপস্থাপনও মনোযোগ কাড়ে। কাপড়ের তৈরি গয়নাগুলো সাজিয়ে রাখা হয়েছে নারায়ণগঞ্জের এক গার্মেন্টস থেকে আনা ঝুট কাপড়ের ওপর।

দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কাঁথা আর রাজস্থাযনের গয়না
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

মেটালের গয়নাগুলোও রিসাইকেলড মেটাল থেকে তৈরি। কাঠের গয়নাগুলোর স্থান হয়েছে কাঠের আঁশের ওপর। আপনি যদি নিজের রাশির থিমের গয়না পরতে চান, সেটিও আছে। শুকনো বাঁশপাতার ওপরে রাখা বাঁশের কঞ্চির তৈরি গয়না। আর ছিল বীজের ওপর ও তামা, রুপার মিশেলে নিখুঁত নকশায় গড়া গয়না। এক পাশে রয়েছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী কাঁথা: চাঁপাইনবাবগঞ্জের লহরি কাঁথা, যশোরের পাড়ওয়ালা কাঁথা, সিলেটের খেস, পার্বত্য চট্টগ্রামের বুরগী...তার পাশেই শোভা পাচ্ছে রাজস্থানের ঐতিহ্যবাহী গয়না। দেয়ালে দেয়ালে এই প্রদর্শনী নিয়ে আরও কথা বলে এমন সব ছবি, শব্দ, বাক্য। রাজধানীর বনানীতে কিউরিয়াসের নিজস্ব ভবনে ‘শীতের প্রদর্শনী’তে যা দেখলাম, তা অনেকটা এ রকমই। আজ থেকে শুরু হলো, চলবে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত।

ঘুরে ঘুরে অতিথিদের প্রদর্শনী দেখাচ্ছেন আয়োজক আর ডিজাইনাররা
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক লুভা নাহিদ চৌধুরী, বিশেষ অতিথির আসন গ্রহণ করেছেন একশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির। আরও ছিলেন কিউরিয়াসের পরিচালক, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আর চেয়ারপারসন। ছিলেন কিউরিয়াসের কর্মকর্তা–কর্মচারী, সাধারণ দর্শক আর গণমাধ্যমকর্মী। তাঁরকে সঙ্গী করে মিট দ্য প্রেস পর্বটি সঞ্চালনা করেন এই প্রদর্শনীর কিউরেটর, ডিজাইনার চন্দ্র শেখর সাহা।

অতিথি আর আয়োজকেরা ‘সুঁই সুতোয়’ জানালেন, তাঁরাও পারেন কাঁথা সেলাই করতে
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

আলাপে উঠে আসে, প্রদর্শনীটির ভাবনা আর সেই ভাবনার পেছনের নানা ভাবনা। জানা যায়, যা কিছু পুরোনো, ফেলনা, তাকেই নতুন করে প্রাণ দেওয়ার বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে এখানে। গুরুত্ব পেয়েছে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি, জয়বায়ু পরিবর্তন আর তারই প্রেক্ষিতে পোশাকশিল্প আর ফ্যাশন দুনিয়ার দায়িত্বশীলতা। যে হারে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়ছে, এভাবে চলতে থাকলে ৫০ বছর পর শীতকাল বলে আর কিছু থাকবে কি না, তাই নিয়েও আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। আর শীতকাল না থাকলে থাকবে না শীতের প্রদর্শনী। তাই এই আয়োজনে ‘টেকসই ফ্যাশন’–এর নামে উঠে এসেছে নিজেদের অস্তিত্ব সংকটের কথা। জোর দেওয়া হয় ‘স্লো ফ্যাশন’–এর এপর। পুরোনো কাপড়ে একটু ‘এটা-সেটা’ করে ভ্যালু এড করে নতুন বছরে পরার পরামর্শও এল অতিথিদের পক্ষ থেকে।

ডিজাইনার চন্দ্র শেখর সাহা জানিয়েছেন, প্রদর্শনীটি নিছক প্রদর্শনী নয়
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

প্রদর্শনীটি নিছক প্রদর্শনী নয় জানিয়ে চন্দ্র শেখর সাহা বলেন, ‘ভাববেন না উপলক্ষটা কেবলই ব্যবসায়িক। এটাকে আমি দেখেছি সময়ের সঙ্গে সময়ের অভিজ্ঞতার কথোপকথন হিসেবে। যে দাদিকে শিশু দেখেনি, কিন্তু তাঁর বোনা সোয়েটার শরীরে চাপিয়ে তার বড় হওয়া। এই যে মানুষ একজন মানুষ আরেক মানুষের স্নেহের স্পর্শ গায়ে জড়িয়ে চলেছে—পোশাকের আজকের কালেকশন সেটিকে উদ্‌যাপন করার প্রয়াস। আর যেগুলোকে আপনারা গয়নারূপে দেখছেন, এর উপকরণগুলোকে আমরা বীজ, মেটাল, কাপড়, কাঠরূপে পরে থাকতে দেখি। কিন্তু কখনো সেগুলোকে গয়না হিসেবে কল্পনা করি না। আমাদের এই গয়নার কালেকশন তাই অলক্ষ্যে পড়ে থাকা টুকরো বাস্তবতা আর স্বপ্নের সম্মিলন।’ ততক্ষণে ঝুপ করে বাইরে নেমেছে কালোরঙা সন্ধ্যা। অনুষ্ঠানের শেষ ভাগে এই আয়োজনের সঙ্গে জড়িত সবার নাম ডেকে সামনে আনা হয়। পাদপ্রদীপের আড়ালে থাকা এই মানুষগুলোকে একটা লম্বা তালির মাধ্যমে অভিবাদন জানিয়ে শেষ হয় আয়োজন।