নারীর জীবনের এক-তৃতীয়াংশ সময় কাটে মেনোপজে

নারীর জীবনের এক-তৃতীয়াংশ সময় মেনোপজের মধ্য দিয়ে কাটে। মেনোপজ বা রজঃনিবৃত্তির বিষয়ে অনেক নারীর জ্ঞান সীমিত। তবে মেনোপজ হওয়া নারীদের নানা শারীরিক জটিলতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে হাড়ক্ষয়, ভিটামিন ডির অভাব, মানসিক অবসাদ, শরীরে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি ইত্যাদি। নারীদের হাড়ের ভেতর ঘনত্ব কমে যায়, সহজে হাড় ভেঙে যায়। তাই ৩৫ বছরের পর থেকে ক্যালসিয়াম, ভিটামিন ডি, প্রোটিনজাতীয় খাবার বেশি করে একজন নারীকে খেতে হবে। আর মেনোপজ কী, সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে তা বিস্তারিত নারীদের জানাতে হবে, তাঁদের সচেতন করে তুলতে হবে।

আন্তর্জাতিক মেনোপজ দিবসের প্রাক্কালে ১৪ অক্টোবর বাংলাদেশ মেনোপজ সোসাইটি (বিএমএস) আয়োজিত ‘হাড়ের স্বাস্থ্য’ বিষয়ে এক ওয়েবিনারে দেশের বিশিষ্ট স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা এসব কথা বলেন। ওয়েবিনারে দেওয়া বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য সংক্ষেপে এখানে তুলে ধরা হলো।

অধ্যাপক ডা. টি এ চৌধুরী, সাবেক সভাপতি, অবস্ট্রেটিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ (ওজিএসবি)

সহজাতভাবেই নারীরা মেনোপজ সমস্যায় ভোগেন। আমরা জানি, মেনোপজের সমস্যা কী? অনেক নারী জানেন না, অনেকে জানেনও। মেনোপজের সমস্যা নিয়ে যেসব নারী আসেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, তাঁরা আর্থিকভাবে স্বামী কিংবা সন্তানের ওপর নির্ভরশীল। মেনোপজ নারীদের রোগ, নারীদের সমস্যা, তবে সমাধান কিন্তু তাঁদের হাতে নয়। এ সময় নানাভাবে নারীকে সহযোগিতা করতে পারেন পুরুষ।

মেনোপজে যাওয়া নারীর হাড়ের ভেতর খনিজের ঘনত্ব কমে যাওয়া। বোন মিনারেল ডেনসিটির (হাড়ের মধ্যকার খনিজের ঘনত্ব) পরীক্ষা এক লাখ নারীর মধ্যে একজনও করার সুযোগ পান না। হাড়ের ভেতর ঘনত্ব কমে গেলে ভঙ্গুর হাড় সহজে ভেঙে যায়। তাই সরকারি উদ্যোগে বিনা পয়সায় ৬৫ বছর ওপরের নারীদের হাড়ের ভেতরের ঘনত্ব পরীক্ষার উদ্যোগ নেওয়া যায় কি না, সেটি ভেবে দেখা উচিত। মেনোপজের বিষয়ে স্বামী যদি না বোঝেন, সহযোগিতা না করেন, তাহলে কিন্তু ওই নারীর সুচিকিৎসা হবে না।

জাতীয় অধ্যাপক ডা. শাহ্‌লা খাতুন, সভাপতি, বাংলাদেশ মেনোপজ সোসাইটি

নারী কিংবা পুরুষের একটা নির্ধারিত বয়সের পর হাড় ভঙ্গুর হয়ে যায়। নির্দিষ্ট বয়সের পর শরীরে ক্যালসিয়াম কমে যেতে থাকে। বয়স যত বেশি হয়, হাড় তত ভঙ্গুর হয়। অর্থাৎ নারীর অস্টিওপোরোসিস হয়। হাড়ের ভেতর ঘনত্ব কমে যায়। হাড় অনেকটা মাকড়সার জালের মতো হয়ে যায়। এসব হাড় ভেঙে গেলে নানা জটিলতা তৈরি হয়। হাড়ের এই ক্ষয় সাধারণত নীরবে এবং ক্রমবর্ধমানভাবে ঘটতে থাকে।

অধ্যাপক ডা. রওশন আরা বেগম, সহসভাপতি, বাংলাদেশ মেনোপজ সোসাইটি

৪৫ বছরের পর একজন নারীর মেনোপজ শুরু হয়। নারীর জীবনের এক-তৃতীয়াংশ সময় চলে যায় এই মেনোপজ সময়ে। মাসিক বা পিরিয়ড যখন এক বছর সময় পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায়, পরের সময়টা আমরা ধরে নিই, মেনোপজ হয়েছে। আমরা যদি নারীস্বাস্থ্য নিয়ে আলোচনা করি, তাহলে সেরা সময়টা এই মেনোপজের সময়। এটা শুরু হয় ৪৫ বছর বয়স থেকে। অবশ্য বাংলাদেশের অনেক নারীর বেলায় মেনোপজ আরও আগে শুরু হয়। কারণ, বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ হয়। সেরা সময়টা যদি সেরা করা যায়, তবে আমাদের রাষ্ট্র, সমাজ—সবাই উপকৃত হবে।

মেনোপজের সময় অনেক নারী বিষণ্নতায় ভোগেন। মেনোপজের সময় হঠাৎ নারী ঘেমে ওঠেন। তিনি কিছু মনে রাখতে পারেন না। আস্তে আস্তে তিনি বিষণ্নতায় ভুগতে থাকেন। হাড়ের রোগ হতে থাকে। কোমর বাঁকা হয়ে আসতে থাকে। ঠিকমতো হাঁটতে পারেন না, কষ্ট হয়। ৩০ থেকে ৩৫ বছরের পর থেকেই কিন্তু হাড় ক্ষয় শুরু হয়ে যায়। ৩৫ বছর বয়স থেকে আমাদের শুরু করতে হবে। আগে থেকে ক্যালসিয়াম খেতে হবে।

অধ্যাপক ডা. সামিনা চৌধুরী, সাবেক সভাপতি, অবস্ট্রেটিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ

মেনোপজের সময় অনেক নারী নিজেকে একেবারই গুটিয়ে ফেলেন। এমন মায়েদের কথা আমাদের জানতে হবে। তাঁদের কাছে যাওয়ার জন্য আমাদের অনেক রাস্তা খোলা আছে। সেই রাস্তা ধরে আমাদের এগোতে হবে। আমরা কিন্তু প্রান্তিক পর্যায়ে যেতে পারি। আমাদের যদি সম্মিলিত উদ্যোগ থাকে, তাহলে এই নারীরা উপকৃত হবেন।

অধ্যাপক ডা. ফারহানা দেওয়ান, নির্বাচিত সভাপতি, অবস্ট্রেটিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ

মেনোপজের উপসর্গের মধ্যে আছে হঠাৎ ঘেমে যাওয়া, ঘুমের সমস্যা হওয়া, মানসিক সমস্যা ইত্যাদি। মেনোপজের সময় জীবনযাপনে পরিবর্তন আনার পরামর্শ দেন তিনি। মেনোপজের সময়ে নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে। যোগব্যায়ামও করা যেতে পারে। প্রতিদিন নিয়মিত ৩০ মিনিট করে হাঁটলেও অনেক উপকার। হাড়ের ছোট ছোট জোড় (জয়েন্ট) কিন্তু সচল রাখতে হবে। কারণ, মেনোপজের সময় হাড় পাতলা হয়ে যায়।

অধ্যাপক ডা. সালেহা বেগম চৌধুরী, সাবেক মহাসচিব, অবস্ট্রেটিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ

হাড়ের ক্ষয়রোধে দৈনিক যদি এক হাজার মিলিগ্রাম করে ক্যালসিয়াম নেওয়া যায়, তাতে অনেক উপকার হয়। মেনোপজ হওয়ার পর ভালো থাকতে হলে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খেতে হবে। শাকসবজি খেতে হবে। হাঁটাচলার মধ্যে থাকতে হবে। এই সময় ব্রকলি, শর্ষেশাক, মটরশুঁটি, ডাল, চিংড়ি মাছ, বাদাম, রুটি ইত্যাদি খেতে হবে। কারণ, এসব খাবারে ক্যালসিয়াম আছে। যাঁরা ভিটামিন ডির অভাবজনিত সমস্যায় ভুগছেন, তাঁদের ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্ট দিতে হবে।

অধ্যাপক ডা. ফেরদৌসি বেগম, সভাপতি, অবস্ট্রেটিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ

হাড়ের সুস্থতার জন্য ভিটামিন ডি এবং ক্যালসিয়াম খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নিয়মিত ব্যায়াম করা খুব জরুরি। ভিটামিন ডির অভাব থাকলে হাড়ের ক্ষতি হবে। মেনোপজের সময় ভিটামিন ডি আরও গুরুত্বপূর্ণ। নানাবিধ কারণে হাড় ক্ষয়ে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ে। তাই নিয়মিত ক্যালসিয়ামযুক্ত খাবার খেতে হবে। শীতের দিনে রোদে যাওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ।

অধ্যাপক ডা. লায়লা আরজুমান্দ বানু, সাবেক সভাপতি, অবস্ট্রেটিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ

মেনোপজ হলে জীবনটা শেষ হয়ে যায় না। মেনোপজ-পরবর্তী সময়ে হাড় ক্ষয় হয়। হাড়টা খুব নরম হয়ে যায়। হাড় ভালো রাখতে হলে ক্যালসিয়াম খেতে হবে। আমাদের হাঁটাচলা করতে হবে। আমাদের শুয়েবসে থাকলে চলবে না। আমাদের ভালো করে বুঝতে হবে, মেনোপজ কিন্তু একটা গুরুত্বপূর্ণ সময়। জীবনের এক-তৃতীয়াংশ সময় কিন্তু মেনোপজের সময়। এই সময়টা কিন্তু আমাদের সক্রিয় থাকতে হবে। ধূমপান করা যাবে না। ঠিকমতো ঘুমাতে হবে, আদর্শ খাবার খেতে হবে।

অধ্যাপক ডা. গুলশান আরা, মহাসচিব, অবস্ট্রেটিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ

মেনোপজের সময় হটফ্ল্যাশ হয়, যেটা খুবই কষ্টকর। হঠাৎ গরম লাগা, ঘাম হওয়া ইত্যাদি সব উপসর্গ। এ সময় হরমোন থেরাপি দেওয়া যেতে পারে। সঠিক সময়ে সঠিক পদ্ধতিতে সঠিক ডোজ দিতে পারলে উপকার পাওয়া যাবে অনেক বেশি।

অধ্যাপক ডা. শেখ জিন্নাত আরা নাসরিন, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশে মেনোপজ সোসাইটি

বয়স বাড়লে মাংসপেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় আর সার্কোপেনিয়ায় আক্রান্ত হলে মাংসপেশির পরিমাণ কমে যায়। এখানে পুষ্টির বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। মাংসপেশিকে রক্ষার জন্য নিয়মিত ক্যালসিয়াম খেতে হবে। ভিটামিন ডি খেতে হবে।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. সুরাইয়া রহমান, সহসভাপতি, বাংলাদেশে মেনোপজ সোসাইটি

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের হাত ধরে ২০০৫ সালে বাংলাদেশ মেনোপজ সোসাইটির প্রতিষ্ঠা হয়। সেই থেকে মেনোপজ হওয়া নারীদের মধ্যে সচেতনতা তৈিরর কাজ করে যাচ্ছে এই সংগঠন।

ওয়েবিনারটি সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশ মেনোপজ সোসাইটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. ফারজানা দিবা। আয়োজনটির সায়েন্টেফিক পার্টনার ছিল বিকন ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড। সহযোগিতায় ছিল ওভোক্যাল–ডি এবং মিডিয়া পার্টনার প্রথম আলো)