আন্তর্জাতিক নারী দিবসে নুভিস তা ফার্মা নিবেদিত প্রথম আলো অনলাইনের বিশেষ আয়োজন নারী–নক্ষত্রের তৃতীয় পর্বে অতিথি ছিলেন ওজিএসবির প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. সামিনা চৌধুরী এবং সংগীতশিল্পী মেহরীন মাহমুদ। পর্বটি সঞ্চালনায় ছিলেন ডা. শ্রাবণ্য তৌহিদা।
নারী দিবসকে কে কীভাবে দেখছেন? ডা. সামিনা সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, ‘নারী দিবস নারীমুক্তির দিবস। এবারের থিম, করোনাকালে নেতৃত্ব গড়বে নতুন সমতার বিশ্ব। এই প্রতিপাদ্যের আলোকে বাংলাদেশের দিকে তাকালে আমরা দেখছি, যে নেতৃত্বে আমরা করোনাকালের মোকাবিলা করেছি, তিনি বঙ্গবন্ধুকন্যা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আমি প্রথমেই তাঁকে স্যালুট জানাই। তিনি প্রথম থেকেই করোনা মোকাবিলায় আমাদের যেভাবে নির্দেশ দিয়েছিলেন, আমরা সেভাবে চলার চেষ্টা করেছি এবং করোনা মোকাবিলা করে এগিয়ে গেছি। তাঁর নেতৃত্ব একটি উদাহরণ হিসেবে স্থাপিত হয়েছে।’
ডা. সামিনা বলেন, ‘এ ছাড়া আমাদের নারী চিকিৎসকেরা, যাঁরা সামনে এসে দিনরাত নির্দেশনা দিয়ে গেছেন, বিশেষ করে মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা এবং নাসিমা আপা, সেখানেও স্পষ্ট ছিল আমাদের নারী নেতৃত্ব কতটা গুরুত্বপূর্ণ। এরপর আমি স্মরণ করছি ওজিএসবিও চিকিৎসকদের কথা। যখন থেকেই সবার শঙ্কা ছিল একটি ভয়াবহ বিপদ আসতে যাচ্ছে, যাকে আমরা চিনি না, কখনো শুনিনি, তখন থেকেই সবাই আপডেট থাকার চেষ্টা করেছেন।
ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি থেকেই আমরা সেমিনার–সিম্পোজিয়াম শুরু করেছিলাম। আমরা বুঝতে পেরেছিলাম, নারীস্বাস্থ্যের ওপর একটি বিশেষ হুমকি তৈরি হবে। জন্মনিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে সচেতনতা তৈরির চেষ্টা করেছি যেন মাতৃত্বজনিত জটিলতা মোকাবিলা করা যায়। আমরা টেলিফোনে সেবা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। গ্রাম, শহর এমনকি বিদেশ থেকেও প্রচুর কল এসেছে। আমাদের নারীরা ওই পরিস্থিতি দক্ষতার সঙ্গে সামাল দিয়েছেন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আমাদের এই ভূমিকার প্রসংশা করেছে। আমিও সবাইকে আমাদের তরফ থেকে ধন্যবাদ জানাই।’
‘আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে নারী দিবসকে কতটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন?’ ডা. শ্রাবণ্যর এই প্রশ্নের উত্তরে মেহরীন মাহমুদ প্রথম আলোসহ সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ‘পৃথিবীতে নর এবং নারী দুজনেরই প্রয়োজনীয়তা আছে। একসঙ্গে হাত ধরে দুজনেরই এগিয়ে চলা। নর দিবসও আছে, কিন্তু আমরা নারী দিবসকেই বেশি প্রাধান্য দিই, বেশি উদ্যাপন করি। নারীদের জন্য একটি স্পর্শকাতর দিন এটি। এর ইতিহাসটা অনেক দুঃখময়। এটিও অন্য দিনগুলোর মতোই একটি দিবস।
এখানে প্রতিপাদ্য থাকে, যেটা সেই দিন সবার সামনে নতুন করে উপস্থাপিত হয়। আমরা যারা নারীদের বিষয়ে সরাসরি কাজ করি, এই দিনে আমাদের নিয়ে ছেলেরা হালকা কটাক্ষ করেন। আজ নাহয় আমি রান্না করি, আজ নাহয় তুমি একটু বিশ্রাম নাও, এমন অনেক হাস্যরসাত্মক ধ্বনি আন্দোলিত হয়। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়েও নারী দিবসের প্রয়োজনীয়তা আছে। কারণ, নারীদের অনেক কথা আছে, যা কখনো বলা হয় না। হাস্যরসের নিচেই যেগুলো চাপা পড়ে থাকে।
ছেলেদেরও অবশ্যই দুঃখ আছে। কিন্তু এই একটি দিনে মেয়েদের বিষয়গুলো আরেকবার উঠে আসা উচিত। ছেলেদের ভাবা উচিত, এই মেয়েই আমাদের জন্য সারা দিন পরিশ্রম করছেন, আমাদের ঘর সামলাচ্ছেন, অপেক্ষা করছেন, সন্তানের মা হচ্ছেন, আমার বাড়ির রান্নাটা করে দিচ্ছেন। এই মেয়েকে এবং সব নারীকে আমরা একটু সম্মানের চোখে দেখি। সেটি শুধু কাগজে–কলমে নয়, চিন্তা–চেতনা, কথা বলার উদ্দেশ্যে এবং আচরণ, সবকিছুর মধ্যেই পরিবর্তন আনা উচিত।’
তিনি বলেন, ‘এটি আমার কাছে একটি মানবতাবাদী দিন। ছেলেরা যেমন মেয়েদের সম্মান নিয়ে ভাববে, মেয়েরাও যেন ছেলেদের সম্মান নিয়ে ভাবে। এই দিবসের উদ্দেশ্যই আমার মনে হয়, সবাই মিলে, পারস্পরিক শ্রদ্ধা নিয়ে ভালো থাকা। পারস্পরিক শ্রদ্ধা থাকলে প্রতিটি দিবসই নারী দিবস, নর দিবস ও ভালোবাসা দিবস। প্রতিটি দিনই সুন্দর এবং তখনই জীবন সুন্দরভাবে এগোবে বলেই আমার বিশ্বাস।’
মেহরীনকে সমর্থন জানিয়ে ডা. সামিনা বলেন, ‘নারীর প্রতি সম্মানবোধ পরিবার থেকেই আসে। মা–বাবা যদি পরস্পরকে সম্মান করেন, এই সম্মানবোধ সন্তানের মধ্যেও চলে আসবে। জানবে, নারী-পুরুষে প্রভুত্ব বা দাসত্ব বলে কিছু নেই। পরস্পরের প্রতি আমাদের সহিংস মনোভাব পরিহার করতে হবে। কিন্তু আমরা জন্মের পরই ছেলেমেয়েদের আলাদাভাবে বড় করতে শুরু করি। চিকিৎসক হিসেবে আমরা দেখেছি, একটা ছেলেশিশুকে এবং একটা মেয়েশিশুকে কোলে তুলে দিলে সব মা–বাবাই খুশি হন। কিন্তু তার মাত্রা হয় আলাদা। অনেক মেয়ে থাকলেই বোঝা হিসেবে দেখা শুরু হয়ে যায়। সেসব ক্ষেত্রে নারীকে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করলে সম্মানপ্রাপ্তির একটি সুযোগ তৈরি হয়।
শুধু তা–ই নয়, কর্মক্ষেত্রেও বৈষম্য রয়ে গেছে। মজুরিতে পার্থক্য রয়ে গেছে। নারী দিবস উপলক্ষে সেখানে পরিবর্তনের সুযোগ আমাদের নিতেই হবে। মাতৃত্বকালীন ছুটির বিষয়েও আমি আলোকপাত করতে চাই। সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী নারীরা ছয় মাস মাতৃত্বকালীন ছুটি পান, যা অনেক প্রতিষ্ঠানেই দেওয়া হয় না। আমাদের মনে রাখা উচিত, একটি নবজাতক কেবল ওই নারীর সন্তান নন, সে দেশেরও সম্পদ। অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যেখানে ছোট শিশু থাকলে নারীকে চাকরি দেওয়া হয় না। এই বৈষম্যগুলো নিরসনে আমাদের কাজ করতে হবে। তাহলেই আমরা পরিপূর্ণ শান্তি ও সমতার পথে এগিয়ে যেতে পারব।’
সুন্দর সমাজের জন্য প্রয়োজন প্রতিবাদ এবং অধিকার রক্ষায় প্রশ্ন করার সাহস। মেহরীন বলেন, ‘সৃষ্টিকর্তা নারীদের চলন-বলন এমনকি কণ্ঠস্বরও ছেলেদের থেকে আলাদা করে তৈরি করেছেন। ঠিক একই সঙ্গে নারীকে এতটাই মানসিক শক্তি দিয়ে তৈরি করেছেন যে সে সৃষ্টিকে ধারণ ও সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু নারীদের কোমল দিকটিকেই তার দুর্বল দিক হিসেবে সব সময় মনে করিয়ে দিয়ে পিছিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়। সিদ্ধান্ত গ্রহণ, যেকোনো সভায় অংশগ্রহণ, বাইরে যাওয়া কিংবা যেকোনো কর্মক্ষেত্রে নারীর বৃদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতাকে এড়িয়ে যাওয়া হয়। নারী অবশ্যই পুরুষের সমান কর্মদক্ষতা দেখাতে পারে, যদি আমরা তাঁকে সেভাবে গড়ে তুলতে পারি।’
তিনি বলেন, ‘সম্পত্তির উত্তরাধিকারের বিষয়টি দেখেন। আমরা যদি ২ বোন হই, তাহলে আমি কেন আমার বাবার সম্পত্তির ৫০ শতাংশ পাব না? কেন এমন একজন মানুষকে তা দিতে হবে যে আমার বাবার জীবনে কোনো ভূমিকাই রাখেননি? দেখুন, আমি আমার বাবার মেয়ে। জন্মসূত্রেই কেন আমি সমান অধিকার নিয়ে জন্মাই না? একটি ছেলের আশায় মা–বাবা যদি ৯টি মেয়ের জন্ম দেন, সেটা কি সমাজের ওপর বোঝা নয়? অথচ এমনও তো হতে পারত যে ২টি বা ৩টি মেয়েকেই যদি পরিপূর্ণভাবে গড়ে তোলেন, তারপর আপনার ইচ্ছেমতো শুধু মেয়েদের মধ্যেই সম্পত্তি ভাগ করে দিয়ে যান। এটাও তো হতে পারে। কেননা সম্পত্তি বণ্টনের বিষয়টি আমাদের, অন্তত আমার আত্মসম্মানে বাধে।
যদি আমি কাউকে বলি এটি আমাকে দিন, এটি আপনার উচিত, এটা করুন—বিষয়টি আসলে সমাজের কোনো কাজে এল না। আমাকে প্রতিবাদ করতে হবে কেন? যা আমার অধিকার, তা আমাকে নিজ থেকেই তো দেওয়া উচিত।’
সবশেষে ডা. সামিনা বলেন, প্রতিবাদের ভাষা কিন্তু পেশিশক্তি নয়। প্রতিবাদের ভাষা অনেকভাবেই হতে পারে। একমাত্র নারীরই ক্ষমতা আছে একটা মানুষকে পৃথিবীতে নিয়ে আসার। নারীর এই অসীম ক্ষমতা অনুধাবন করতে পারলেই সম্মান ও অধিকার দিতে কারও পক্ষেই কার্পণ্য করা সম্ভব হবে না।