আশার কথা হলো, প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যানসার শনাক্ত করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা গ্রহণ করলে জটিলতা এড়ানো যায়। এর মধ্যে কিছু রয়েছে যার ওপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ নেই, আবার কিছু রয়েছে যেগুলো আমরা জীবনযাত্রার সঙ্গে পরিবর্তন করতে পারি। এর জন্য প্রয়োজন জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা। আর নিয়মমাফিক চলাফেরার মাধ্যমে ক্যানসার অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
তাই সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে এসকেএফ অনকোলজি নিবেদিত এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এ পর্বে অতিথি হিসেবে যোগ দেন অধ্যাপক ডা. স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়, এমডি, এমফিল, ক্যানসার বিশেষজ্ঞ, বিভাগীয় প্রধান, রেডিওথেরাপি বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
এ পর্বের আলোচনার বিষয় ছিল, ‘বাংলাদেশে হেড ও নেক ক্যানসার চিকিৎসা’। অনুষ্ঠানটি সরাসরি প্রথম আলো ও এসকেএফের ফেসবুক পেজে সম্প্রচারিত হয়। সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন ডা. মো. শাহরিয়ার ইসলাম।
ডা. স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, হেড অ্যান্ড নেক ক্যানসার বা মুখ ও মুখগহ্বরের ক্যানসার একটি দীর্ঘ পরিসর নিয়ে গঠিত এবং চিকিৎসা শাস্ত্রে হেড অ্যান্ড নেকের ভেতর অনেকগুলো আলাদা জায়গা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি যে অঙ্গটি ক্যানসারে আক্রান্ত হয় তা হলো ঠোঁট। এরপর যে অঙ্গটি আক্রান্তের হার বেশি তা হলো দাঁতের মাড়ি। ক্রমানুসারে তারপর আসে মিউকোসাল লাইনিং অর্থাৎ গালের ভেতরের মিউকোসাল লাইনিং থেকে ক্যানসারের উৎপত্তি ঘটতে পারে।
এ ছাড়া জিহ্বা ও জিহ্বাসংলগ্ন মুখের অংশ, রেট্রোমোলার এরিয়া, টনসিল (প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে), ল্যারিংস, হাইপোফ্যারিংস ও নেজোফ্যারিংস—এই অঙ্গগুলো ক্যানসারে বেশি আক্রান্ত হতে পারে। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ১৭ কোটি লোকের বসবাস এবং এর মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের সংখ্যা কম নয়। এই প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার তুলনামূলক র্যাঙ্কিং করলে ক্যানসারের ভয়াবহতার দিক থেকে হেড অ্যান্ড নেক ক্যানসার চতুর্থ স্থানে অবস্থান করছে এবং সামাজিক, পারিবারিক, আর্থিক ও ব্যক্তিজীবনে এটি মারাত্মক প্রভাব বিস্তার করছে।
মুখ ও মুখগহ্বরের ক্যানসারের লক্ষণগুলোর ক্ষেত্রে দুটি নির্দিষ্ট স্থানকে আমাদের নজরে আনতে হবে। প্রথমেই যে বিষয়টি বিবেচনায় আসে তা হলো কোনো ননহিলিং আলসার। কোনো ব্যক্তির মুখগহ্বরের যেকোনো স্থান যেমন গাল, নড়বড়ে দাঁতের গোড়া, আক্কেল দাঁতের পেছনের অংশ এবং জিহ্বায় ক্ষত তৈরি হলে ২ সপ্তাহের মধ্যে যদি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের চিকিৎসাসেবার মাধ্যমে তা নির্মূল না হয়, তাহলে রোগীকে অবশ্যই সতর্ক হতে হবে। এ ক্ষেত্রে রোগীর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে খেয়াল করতে হবে যে মুখের অভ্যন্তরের পরিবর্তন অর্থাৎ ধূসর, সাদা কিংবা লালচে বর্ণের ঘা বা ক্ষত দেখা যায় কি না।
আলসারের আগে একটি লেয়ার তৈরি হয়, সে লেয়ারটি যদি লালচে হয় তবে ঝুঁকি একটু কম। কিন্তু লেয়ারটি যদি সাদা হয় সে ক্ষেত্রে এর ঝুঁকি বেশি। এ সম্পর্কিত কারও কোনো সমস্যা দেখা দিলে অবশ্যই অভিজ্ঞ ডেন্টিস্টের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে। তখন তিনি হয়তো রোগীকে রিচেক করে পালপেশনের মাধ্যমে দেখবেন কোনো দানা বা ক্ষত পাওয়া যায় কি না। এ ছাড়া গলার আশপাশে কোনো দানা যদি কেউ পালপেট করে, যেটি দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে আছে, তবে অবশ্যই ক্যানসার বা এ জাতীয় কোনো ব্যাধি আছে কি না, তা চিকিৎসকের মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হবে।
হেড অ্যান্ড নেক ক্যানসারের কিছু রিস্ক ফ্যাক্টর রয়েছে। আমাদের দেশের প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ, বিশেষ করে ছেলেদের ক্ষেত্রে ১৫ বা তার বেশি ও মেয়েদের ক্ষেত্রে ১৮ বা তার বেশি বয়সের জনগোষ্ঠীর ধূমপানের প্রবণতা খুব বেশি, যা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এ ছাড়া পান, জর্দা, সাদাপাতা ও গুল কিংবা তামাকজাত অন্যান্য দ্রব্য মুখ ও মুখগহ্বরের ক্যানসার সৃষ্টিকারী উপাদানগুলোর মধ্যে অন্যতম। এ ছাড়া অনেকেই নিয়মিত দাঁত মাজার ব্যাপারে উদাসীন, বিশেষ করে আমাদের দেশের দরিদ্র ও অসচেতন জনগোষ্ঠীর মধ্যে এটি দেখা যায়; যা অনেক সময় মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
তাই তামাক বা এ জাতীয় দ্রব্য সেবনের বদ-অভ্যাস ত্যাগ করে প্রতিদিন দুবেলা যত্নসহকারে দাঁত মেজে পরিষ্কারের মাধ্যমে এ রোগের ঝুঁকি অনেকটাই কমিয়ে আনা যায়। প্রত্যেকে নিজের ব্যাপারে সচেতন হলে এবং প্রতি ছয় মাসে অন্তত একবার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করলে এ রোগের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। মনে রাখতে হবে, আর্লি স্টেজে ক্যানসার ধরা পড়লে উপযুক্ত চিকিৎসা প্রদানের মাধ্যমে রোগীকে সম্পূর্ণরূপে সুস্থ করে তোলা সম্ভব।
ক্যানসার পুরোপুরিভাবে প্রতিরোধ করা না গেলেও এর ঝুঁকির কারণগুলো জানা থাকলে আমরা সচেতন হতে সক্ষম হব। ফলে এর ঝুঁকি থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা পেতে পারব। বলা যেতে পারে, বর্তমানে বাংলাদেশে ক্যানসার চিকিৎসার ধরন আগের চেয়ে অনেক উন্নত এবং এখানে বিশ্বমানের ক্যানসার চিকিৎসা প্রদান করা সম্ভব।