ব্যথার সাতকাহন

অর্থোস্কোপিক ও লিগামেন্ট ইনজুরি নিয়ে আলোচনা করছেন ডা. মোহাম্মদ খোরশেদ আলম

জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে গোড়ালি, হাঁটু, কোমর, কনুই বা হাত-পায়ের অন্যান্য জোড়ে ব্যথায় আক্রান্ত হই আমরা। তবে কোন ব্যথাটি লিগামেন্ট ইনজুরি, এ ধরনের ইনজুরিতে কী করণীয় এবং এ ক্ষেত্রে অর্থোস্কোপির ভূমিকা সম্পর্কে সবারই জানা প্রয়োজন।

সম্প্রতি বিষয়টি নিয়ে এসকেএফ নিবেদিত ও প্রথম আলো আয়োজিত ‘ব্যথার সাতকাহন’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে। অনুষ্ঠানের চতুর্থ পর্বে অর্থোস্কোপি ও লিগামেন্ট ইনজুরি নিয়ে বিশেষ অতিথি হিসেবে আলোচনা করেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের অর্থোসার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক, অর্থোস্কোপিক, অর্থোপেডিক ও ট্রমা সার্জন ডা. মোহাম্মদ খোরশেদ আলম। সঞ্চালক ছিলেন মীর আর্সিয়া রহমান। পুরো আয়োজনের সায়েন্টিফিক পার্টনার ছিল এসকেএফের দ্রুতগতির কার্যকর ব্যথানাশক ওষুধ ইটোরিক্স, ন্যাপরক্স প্লাস, নাবুমেক্স ও টোজাক।

আলোচনার শুরুতেই অর্থোস্কোপি সম্পর্কে ধারণা দেন ডা. মোহাম্মদ খোরশেদ আলম। হাড়ের জোড়ে ছিদ্র করে ছোট এন্ডোস্কোপ যন্ত্রের সাহায্যে ভেতরটা দেখে আঘাতটি সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যায় অর্থোস্কোপিতে। এতে কাটাছেঁড়া ছাড়া শুধু ছিদ্র করা হয় বলে রোগী দ্রুত সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারেন। অর্থোস্কোপির মাধ্যমে ইনজুরির অবস্থা দেখার সঙ্গে সঙ্গে কোনো রিপেয়ারিং বা ছোট শল্যচিকিৎসা তাৎক্ষণিকভাবে করা সম্ভব।

স্থিতিস্থাপক টিস্যুতে তৈরি জোড়ের চারদিকে অবস্থিত লিগামেন্ট আমাদের চলাফেরায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এরা আমাদের হাড়ের জোড়গুলো সঠিকভাবে নড়াচড়া করতে সাহায্য করে। কোনো দিকে বেশি বেঁকে, বেরিয়ে বা ঢুকে যেতে বাধা দেয় জোড়কে। এই লিগামেন্ট ইনজুরি সাধারণত হাঁটুতেই সবচেয়ে বেশি হয়। বিশেষত যাঁরা সক্রিয় জীবন যাপন করেন, অর্থাৎ ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী মানুষ এবং কিশোর ও তরুণ বয়সী যাঁরা খেলাধুলা করেন, তাঁদেরই লিগামেন্ট ছিঁড়ে যাওয়ার আশঙ্কা বেশি। অর্থোস্কোপির মাধ্যমে সহজে কম কেটে এই লিগামেন্ট বা মিনিস্কাস অর্থাৎ হাঁটুর তরুণাস্থির আঘাতের চিকিৎসা করা যায়।

লিগামেন্ট ইনজুরি চিনতে পারা যায় ব্যথার তীব্রতার বিচারে। সাধারণভাবে আমরা হোঁচট খেয়ে, কোনো কিছুর সঙ্গে আঘাত লেগে বা পড়ে গিয়ে যেসব ব্যথা পাই, তার সবই লিগামেন্ট ইনজুরি নয়। খেলতে গিয়ে বা দৌড়ের সময়ে পা কিছুটা ভাঁজ করতে হয় বারবার। এ সময়ে হাঁটুর পেছনে ও পাশের লিগামেন্ট একদম টান টান থাকে।

আবার হাঁটু হচ্ছে দেহের ওজন বহনকারী জোড়। তাই এ সময়ে যদি খুব বেশি আঘাত লাগে, যেমন খেলতে গেলে সজোরে কারও লাথি লাগলে বা সড়ক দুর্ঘটনায় আঘাত পেলে লিগামেন্ট ইনজুরি হতে পারে। এ ক্ষেত্রে ১৫ থেকে ২০ মিনিটের মধ্যে একেবারে ফুলে উঠতে পারে আঘাতপ্রাপ্ত স্থানটি। এ রকম ক্ষেত্রে খেলোয়াড়েরা প্রাথমিক চিকিৎসা বা ব্যথানাশক স্প্রে দেওয়ার পরও চলতে–ফিরতে পারেন না ব্যথার তীব্রতার কারণে। মিনিস্কাস বা তরুণাস্থির আঘাতে ফোলাটি ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা পরই বেশি খারাপ আকার ধারণ করে, সঙ্গে সঙ্গে ফুলে যায় না। তবে হাড়ের ফ্র্যাকচারেও হাঁটু ফুলতে পারে। তাই আঘাতের সময় জোড়টি কোন অবস্থানে ছিল এবং আঘাতের তীব্রতা কেমন, তা বিচার করতে হবে এ ক্ষেত্রে। তীব্র ব্যথা যদি ক্রমাগত বাড়ে বা দীর্ঘস্থায়ী হয়, তবে অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।

খেলাধুলা বা এমন বিভিন্ন দুর্ঘটনাবশত আঘাত পাওয়া খুবই সাধারণ ব্যাপার। তবে আঘাত পেলে সেই স্থানে প্রথমেই বরফ বা ঠান্ডা পানি প্রয়োগ করতে হবে। আঘাতপ্রাপ্ত জোড় বা স্থানটিকে কোনো চাপ বা ওজন নিতে দেওয়া যাবে না। সেই জায়গা একটু উঁচুতে রাখতে হবে। বিশ্রাম নিলে অর্থাৎ জোড়টিতে আর ওজন না দিলে এতে আর বেশি ক্ষতি হতে পারবে না। ব্যথানাশক স্প্রে দেওয়া যেতে পারে, কিন্তু কোনো রকম মালিশ করা যাবে না। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী এসকেএফের ইটোরিক্স, ন্যাপরক্স প্লাস, নাবুমেক্স ও টোজাকের মতো দ্রুতগতির কার্যকর ব্যথানাশক ওষুধ সেবন করা যেতে পারে।

উপরিউক্ত সব কটি ধাপ অনুসরণ করার পরও ব্যথা যদি বেশি হয় অথবা প্রথমেই আঘাত যদি তীব্র হয়, তবে অবশ্যই চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। এক্স-রেতে ফ্র্যাকচার বা হাড়ের জোড় নড়ে যাওয়ার প্রমাণ পেলে প্লাস্টার করা হয়। এ ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে প্লাস্টারের মাধ্যমে নড়াচড়া থেকে জোড়কে বাধ্যতামূলক বিরতি দেওয়া নিশ্চিত করা হয়। ফ্র্যাকচারে লিগামেন্ট ইনজুরি ধরা পড়ে না। পরে তিন সপ্তাহ বিশ্রামের পর এমআরআই ও ফিজিকাল পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষার মাধ্যমে লিগামেন্ট ইনজুরি নিশ্চিত করা যায়। সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা থাকলে সঙ্গে সঙ্গে চেতনানাশক প্রয়োগ করে পরীক্ষা করে দেখে বোঝা যায় লিগামেন্ট ছিঁড়ে গেছে কি না। আবার প্রয়োজনমতো জোড়ে ছিদ্র করে এন্ডোস্কোপ ঢুকিয়েও অর্থোস্কোপির মাধ্যমে ইনজুরির তীব্রতা, ধরন ও অবস্থান নিশ্চিত করা যায় হাত ও পায়ের বিভিন্ন জোড়ের ক্ষেত্রে। যদি মেনিসকাসে অল্প ছিঁড়ে যায়, তবে তা কেটে দিতে হবে। বেশি ছিঁড়ে গেলে বিশেষ সুতা দিয়ে রিপেয়ার করতে হবে। আর যদি লিগামেন্ট ছিঁড়ে যায়, তবে শরীরের অন্য স্থান হতে টেন্ডন বা স্থিতিস্থাপক তন্তুর মতো টিস্যুর অংশ নিয়ে লিগামেন্ট তৈরি করে তা রিকনস্ট্রাকশন পদ্ধতিতে প্রতিস্থাপন করতে হয়। এই সার্জারির পর তিন সপ্তাহ পর্যন্ত একেবারে নিয়ন্ত্রিত চলাফেরা করতে হয়। পরামর্শ মেনে সঠিক ব্যায়ামের মাধ্যমে তিন থেকে ছয় মাস পর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেন আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তি।

ডা. মোহাম্মদ খোরশেদ আলম জানান, আগের আঘাতপ্রাপ্ত জায়গায় বয়স হলে ব্যথা ফিরে আসতে পারে। তবে সব ক্ষেত্রে তা পুরোনো ব্যথা নাও হতে পারে। হাড়ের জোড় ভালো রাখতে প্রোটিন ও ক্যালসিয়ামযুক্ত খাদ্য খাওয়ার অভ্যাস থাকতে হবে।

চলাফেরার প্রবণতা থাকতে হবে। ৩০ বছর পর্যন্ত হাড়ের বৃদ্ধি ঘটে। এরপরই শুরু হয় ক্ষয়। কিন্তু সে বয়সে যদি সক্রিয় জীবন যাপন করা যায়, দিনের একটা সময়ে সূর্যের আলোর সংস্পর্শে থাকা যায়, কাজকর্ম করা হয়, সুষম খাদ্য গ্রহণ করা হয়, তবে এই ক্ষয়ের মাত্রা অনেকটাই কম হয়। আবার কারও যদি লিগামেন্ট ইনজুরি থাকে হাঁটুতে, তবে ঊরুর কোয়াড্রিসেপ মাসল শুকিয়ে যায়, কার্যকারিতা কমে যায়। এ ক্ষেত্রে সার্জারির আগেই এই সরু হয়ে আসা ঊরুর মাসল ব্যায়ামের মাধ্যমে বিল্ডআপ বা পুনর্গঠন করে নিতে হবে। কারণ, সার্জারির পরও দীর্ঘমেয়াদি বিশ্রামের কারণে সেই মাসল আবারও শুকিয়ে যাবে। এ জন্য অপারেশনের ব্যথা কমলেই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী আবারও ব্যায়াম শুরু করতে হবে।

ডা. মোহাম্মদ খোরশেদ আলম বলেন, ‘লাইফ ইজ মুভমেন্ট, মুভমেন্ট ইজ লাইফ। আমাদের হাড়ের এবং সামগ্রিক সুস্থতার জন্য সচল ও সক্রিয় থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই সবাইকেই প্রতিদিন কিছুটা সময় বের করে ফ্রি-হ্যান্ড ব্যায়াম, হাঁটা ও জগিং করতে হবে।’