নীরবে স্বাস্থ্যসেবায় আইইডিসিআর

২০০১ সালে মেহেরপুরে অজ্ঞাত রোগে মানুষ মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটে। স্থানীয় স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা বুঝে উঠতে পারছিলেন না কী কারণে এ মৃত্যু হচ্ছে। জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় আক্রান্ত ব্যক্তিদের নাক বা মুখের লালা ও রক্তের নমুনা রাজধানীর রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (আইইডিসিআর) পাঠিয়ে দেন। আইইডিসিআরের বিজ্ঞানী ও গবেষকেরা নমুনা পরীক্ষা করে জানতে পারেন, নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মানুষ মারা গেছে। যারা খেজুরের রস খেয়েছিল, তারা মারা গেছে। ওই খেজুরের রসে ভাইরাস এসেছিল বাদুড়ের মাধ্যমে। আইইডিসিআর দেশবাসীকে পরে জানাল, বাদুড় খেজুরের রস খাওয়ার সময় রসে ভাইরাস ছড়িয়েছিল। আরও বলল, কাচা রস বিপজ্জনক। দেশের মানুষ আগে এ কথা জানত না।

আইইডিসিআর বহু বছর ধরে নীরবে এ কাজ করে চলেছে। সরকারি এ প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা ছিল কম। করোনা মহামারির কারণে নামটি সামনে চলে এসেছে। করোনাভাইরাস সম্পর্কে দেশের মানুষকে সজাগ, সতর্ক ও সচেতন করার পাশাপাশি মহামারি সম্পর্কে বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য দিয়ে চলেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন এ প্রতিষ্ঠান। মহামারি পরিস্থিতি জানার জন্য দেশের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআর। ২০২০ সালের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত করেছিলেন এর বিজ্ঞানী ও গবেষকেরা।

সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিতি না থাকলেও আইইডিসিআরের ইতিহাস বেশ পুরোনো ও সমৃদ্ধ। পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের মতো একসময় এ অঞ্চলে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ ছিল। ব্রিটিশ ভারতের শেষ বছর, অর্থাৎ ১৯৪৭ সাল তৈরি হয় সেন্ট্রাল ম্যালেরিয়া ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া। ওই বছর ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি ভিন্ন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। ১৯৫২ সালে ঢাকা শহরের টিপু সুলতান রোডে সেন্ট্রাল ম্যালেরিয়া ইনস্টিটিউট অব পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করে তখনকার সরকার। প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) ১৯৫৪ সালে কাজ শুরু করে। ১৯৬১ সালে টিপু সুলতান রোড থেকে ইনস্টিটিউট মহাখালীতে স্থানান্তরিত হয়। সে সময়ের ভিত্তিপ্রস্তর এখনো আছে। ম্যালেরিয়ার ওপর নজরদারি, গবেষণা ও মশা নিয়ন্ত্রণ করাই ছিল মূল কাজ।

১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হলো। মশার সঙ্গে ম্যালেরিয়াও কমে আসতে থাকল। প্রতিষ্ঠানটিও বদলে যেতে থাকে। ১৯৭৬ সালে এটি হয়ে গেল ইনস্টিটিউট অব এপিডেমিওলজি, ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড রিসার্চ বা আইইডিসিআর। তখন থেকে এর কাজের ধরনও পাল্টে গেল। রোগের ওপর নজরদারি, রোগের প্রকোপ অনুসন্ধান, গবেষণা এবং শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ নিয়েই এখন ব্যস্ত আইইডিসিআর।

রোগ পর্যবেক্ষণ

দেশে নতুন কোনো রোগ দেখা দিল কি না, পুরোনো রোগ ফিরে এল কি না, কোনো রোগের প্রাদুর্ভাব কমল বা বাড়ল কি না—এগুলো আইইডিসিআর দেখে। রোগের গতিবিধির ওপর নজর রাখে প্রতিষ্ঠানটি।

প্রতিষ্ঠানের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এ এম এম আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, ‘সমস্যার ব্যাপকতা জানতে, ভৌগোলিকভাবে দেশের কোন অঞ্চলে রোগটি ছড়াচ্ছে, রোগটির ইতিহাস কী, রোগটি প্রাদুর্ভাব কেমন বা গতিবিধি কী, তা জানার চেষ্টা করি আমরা।’ পাশাপাশি গবেষণার প্রস্তুতিও নেয় আইইডিসিআর এবং প্রয়োজনে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জরুরি পরিকল্পনা তৈরির পরামর্শ দেয়।

এ কাজ করার জন্য নির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে। যেমন সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির ফলে রোগ কমছে কি না, তা তারা দেখে। দেশের নির্দিষ্ট কিছু হাসপাতালে ইনফ্লুয়েঞ্জাসহ কয়েকটি রোগের তথ্য সারা বছর ধরে নিয়মিত সংগ্রহ করে। নিপাহ ভাইরাস পরিস্থিতি জানার জন্য দেশের পাঁচটি স্থানে (সাইট) নিয়মিত কর্মসূচি আছে তাদের। এ কাজে তাদের সহায়তা করে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান সিডিসি। অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ পরিস্থিতি জানার জন্য সরকারি–বেসরকারি ১০টি হাসপাতালে কাজ করে তারা।

এ ধরনের আরও কাজ তাদের আছে। এসব কাজের মাধ্যমে সংগৃহীত তথ্য-উপাত্ত-পরিসংখ্যান তারা সংগ্রহ করে। এরপর নির্দিষ্ট রোগ সম্পর্কে দেশবাসী জানতে পারে।

প্রাদুর্ভাব অনুসন্ধান

কোথাও হঠাৎ কোনো রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে গেলে তা অনুসন্ধান করা আইইডিসিআরের দায়িত্ব। এ জন্য তাদের প্রশিক্ষিত কর্মী বাহিনী দিয়ে গঠিত দল আছে। নাম ‘র‍্যাপিড রেসপন্স টিম’।

সারা দেশে র‍্যাপিড রেসপন্স টিমের তিন স্তরের একটি নেটওয়ার্ক আছে। সবচেয়ে নিচের স্তরে আছে উপজেলা র‍্যাপিড রেসপন্স টিম। নয় সদস্যের এই দলের প্রধান হিসেবে কাজ করেন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা। এর ওপরে আছে জেলা র‍্যাপিড রেসপন্স টিম। ১৩ সদস্যের এই দলের প্রধান জেলা সিভিল সার্জন। জেলা পর্যায়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিনিধি সার্ভিলেন্স অ্যান্ড ইমুনাইজেশন মেডিকেল অফিসারও এই দলের সদস্য। ঢাকায় আইইডিসিআর কার্যালয়ে আছে ন্যাশনাল র‍্যাপিড রেসপন্স টিম। কেন্দ্রীয় দলটিতে কম পক্ষ সাতজন সদস্য থাকে। এর নেতৃত্বে থাকেন প্রতিষ্ঠানের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা।

দেশের মানুষ ডেঙ্গু, নিপাহ, বার্ড ফ্লু, সোয়াইন ফ্লু, অ্যানথ্রাক্স, চিকুনগুনিয়া, পটকা মাছের বিষক্রিয়া, গণমনস্তাত্ত্বিক রোগ—এসব প্রাদুর্ভাব সম্পর্কে জানা গিয়েছিল আইইডিসিআরের প্রাদুর্ভাব অনুসন্ধানের কল্যাণে।

গবেষণা ও শিক্ষাদান

রোগের ওপর নজরদারি ও রোগ নিয়ে অনুসন্ধান করার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটি রোগ নিয়ে গবেষণা করে। তাদের গবেষণা প্রবন্ধ আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সাময়িকীতে প্রকাশ পায়।

এসব কাজের পাশাপাশি তারা গবেষক ও রোগতত্ত্ববিদও তৈরি করে। ১৯৮০ সাল থেকে তারা মাঠ রোগতত্ত্ব প্রশিক্ষণের দুটি পৃথক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে চলেছে। এ কর্মসূচি থেকে প্রশিক্ষণ পাওয়া বা ডিগ্রি পাওয়া চিকিৎসকদের কর্মক্ষেত্রে বিশেষ কদর আছে।

বৈশ্বিক বন্ধন

শুরু থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) সঙ্গে আইইডিসিআরের সখ্য ছিল। এখনো তা আছে। সিডিসির বৈশ্বিক রোগ শনাক্তকরণ কেন্দ্র হিসেবে এখনো ফোকাল ইনস্টিটিউট হিসেবে কাজ করে আইইডিসিআর।

আরও কিছু দেশীয় ও বৈশ্বিক বিষয় বা প্রতিষ্ঠানের ফোকাল ইনস্টিটিউট হিসেবে কাজ করে আইইডিসিআর। এর মধ্যে আছে ন্যাশনাল ইনফ্লুয়েঞ্জা সেন্টার, গ্লোবাল হেলথ সিকিউরিটি অ্যাজেন্ডা, ওয়ান হেলথ সচিবালয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ইন্টারন্যাশনাল হেলথ রেগুলেশন ও ফুড বর্ন ইমার্জেন্সি রেসপন্স।

প্রতিষ্ঠানটির আন্তর্জাতিক পার্টনারদের তালিকায় আছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ, বিশ্ব কৃষি সংস্থা, জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল, আইইডিডিআরবি, সিডিসি, জনন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়, কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিনসহ আরও কিছু প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়।

আইইডিসিআরের পরিচালক তাহমিনা শিরীন নিজের প্রতিষ্ঠান নিয়ে গর্ববোধ করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে নতুন কোনো রোগ শনাক্তের খবর শুনলেই আমরা তৎপর হয়ে যাই। মাঠে সবার অলক্ষ্যে আমাদের কাজ শুরু হয়। আমাদের ল্যাবরেটরি প্রস্তুত হয়ে যায়। আমরা নতুন রোগ শনাক্তের চেষ্টা করি। ঠিক এ কাজই করেছি নতুন করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে।’